ওহ্, মাথাটা বড্ড দপদপ করচে রে। গা-টাও শির শির করচে। কী লিখতে গিয়ে কী যে ছাই-পাঁশ এক ঝুড়ি বাজে বকলাম, তা ভেবে উঠতে পারছিনে। চিঠিটা আর একবার যে পড়ে দেখতে পারব তারও কোনো আশা নেই, এমনই শরীর-মনে অবসাদ আসচে। তার ওপর আবার আর এক জুলুম, করাচিতে এখন খুব বসন্ত আরম্ভ হয়েচে, খোদা এখন দুনিয়ার কিছু খরচ কমাতে ইচ্ছে করেন বোধ হয়। বসন্ত-রোগাক্রান্ত রোগীর চেয়ে যাদের বসন্ত হয়নি, তাদের জুলুমেই আমরা সুদ্ধ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। আমাদের লাইনের ওপারেই ‘সোলজার বাজার’ বলে একটা জায়গা আছে সেখানেই বসন্তভীতু আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা মিলে এমন বীভৎস কণ্ঠে হরি-সংকীর্তন করে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সামনের সাগর-শয়ান নারায়ণকে মুগ্ধ করে প্রসাদ লাভ করবার চেষ্টা করচে যে নারায়ণের যদি এতটুকুও সংগীত-জ্ঞান থাকে, তাহলে এতক্ষণ তিনি শ্বশুরবাড়ি ক্ষীরোদ সাগরের আয়েশ, লক্ষ্মীর পরিচর্যা ইত্যাদি সব কিছু ছেড়ে সোজা আমেরিকা-মুখো হয়ে ছুট দিয়েছেন। লক্ষ্মী সম্বন্ধে কিছু বলতে পারিনে, কেননা তাঁর সতিন ব্যতীত তাঁর সংগীত-জ্ঞান সম্বন্ধে আমার সঠিক কোনো খবর জানা নেই। নারায়ণ দেখেন যে, দায়ে দৈবে না পড়লে এইসব মনু-সন্তানগণ তাঁর প্রতি অতিভক্তি দেখিয়ে চোরের লক্ষণ প্রকাশ করে না, বা তাঁর সুখ-নিদ্রার ব্যঘাত জন্মায় না, তাই তিনি অনেক সময় সমস্যায় পড়ে যান যে, তাঁর শ্বশুরালয় –সমুদ্রের গভীরতা বেশি, না এই ভক্তগুলি ভক্তির গভীরতা বেশি! আর, তাঁর এইরকম সমস্যা সমাধান করতে করতে ততক্ষণে অসহায় মানবকুলের অবস্থা ‘গুড়োয় মুড়ি দু-আঙুল’ গোছ হয়ে পড়ে এবং তাই তারা খঞ্জনি বাজিয়ে খোল পিটিয়ে ছাগ-মোষ বলি দিয়ে জোর চেঁচামেচি আরম্ভ করে দেয়!
যাক, নারায়ণ তো এখন এইরকম কোনো প্রকারের লটপটিয়ে এক দিকে ছুট দিয়েচেন, কিন্তু এদিকে ‘গোদের উপর বিষফোড়া’র মতো আর এক আপদের আমার নাকের ডগায় অভিনয় হচ্চে। আমাদের খাকি-গেরুয়াধারী অতি ভক্ত সৈনিকবৃন্দ ‘হরির কৃপায়-দাড়ি গজায়, শীতকালে খায় শাঁখালু’ শীর্ষক ভক্তিরসাপ্লুত কীর্তনগানের সাথে সাথে ‘কাছা খুলে বা্হু তুলে’ যেরকম প্রলয় নৃত্য শুরু করে দিয়েচে, তাতে নিঃসন্দেহে মহাদেবও তাঁর ভূত-প্রেত-বলদাদিসহ কৈলাস-হিমালয় ছেড়ে এতক্ষণে তিব্বত পেরিয়ে পড়েছেন। খোলের প্রচণ্ড চাঁটির মাঝে মাঝে ‘গিজাং তাল ভটাভট’ গোছের একটা সমস্বর তীক্ষ্ণ ঋষভ চিৎকারের চোটে ‘ওই – নিলে রে’ বলে তাঁর ভূত-প্রেত-ডাকিনী-যোগিনীপর্ব যেমন অস্বাভাবিক ছুট ছুটচে, হরগৌরীপৃষ্ঠে ঊর্ধ্ব-লাঙ্গুল বৃষভ সিংহও পিট-টান দিয়েচে তেমনই উল্কা বেগে, – এ আমি আমার মনের চোখে বায়োস্কোপের মতো সাফ দেখতে পাচ্চি! আজ আমি নেই বলে ওদের দলে কেউ আর ‘ন্যাংটা নিতাই’ সাজতে পারেনি। আমার হাত-পা নিসপিস করে উঠচে – মনে হচ্চে এই হাজতখানার লোহার শিকলগুলো ভেঙে ওদের মাঝে গিয়ে খুব এক চোট দড়াম দড়াম করে উলঙ্গ নাচ নেচে দিয়ে আসি। …
থাক – বাপ্স্! এসব প্রলয়কাণ্ড এতক্ষণে একটু শান্ত হল!…
আজ বুঝি অমাবস্যার রাত্তির। নিবিড়-কালো যামিনী। আকাশের ছায়াপথ দেখে মনে হচ্চে, ও-ছায়াপথ যেন এই কালো যামিনীর সিঁথিপাটিপরা সিঁথি। অস্তোন্মুখ সন্ধে-তারা সেই সিঁথির মুখে সতীর জালে সিন্দূর বিন্দুর মতো রক্তরাগে জ্বলচে। তার এলিয়ে-দেওয়া কালো চুলের মাঝে মাঝে তারায় ফুল গোঁজা রয়েচে। আকাশ-বেয়ে পড়া ওই গভীর কালো এলোকেশের কুঞ্চিত রাশ ধরণির বুকে-মুখে লুটিয়ে পড়েচে। এক একটা তারা খসে পড়চে আর মনে হচ্চে অসংবৃত এই কালো রূপসির মাথা থেকে অসাবধানে এক আধটি করে কুসুম খসে পড়চে।… কোন্ কান্তের আশায় রজনি রোজ তার এ কালো রূপ নিয়ে অভিসারে বেরোয়? কেন সে অনন্তকাল ধরে এমন যামিনী জেগে আসছে? কোন্ আলো-করা-রূপের রাজকুমারের আসার আশায় তার প্রতি রজনি এমন করে ভোরের পাণ্ডুর ক্লান্ত হাসিতে মিলিয়ে যায়? প্রভাতের ভৈরবী-সুর-সিক্ত শীতল বায়ু – হা হা স্বরে যেন তারই না-পাওয়ার নিরাশা-ক্লান্তি আর পাওয়ার আশার আনন্দ ব্যক্ত করে। যামিনীর যেমন এ-প্রতীক্ষার অন্ত নেই, আমারও তেমনি এ পথ-চলার আর শেষ নেই!…
আমার এত ইচ্ছে করচে এই যামিনী অভিসারের আশা-নিরাশা নিয়ে একটা সুন্দর কবিতা লিখতে, কিন্তু – আ রে তওবা, আমার কবিতা লেখা যা আসে, তা কতকটা এই রকম, –
নেবুর ফুল আর করমচা,
লাও এক কাপ গরম চা!
এইবার ‘ক্ষেমা’ দিই, হাতে খাড় ধরে গেল। তোরও নিশ্চয় মুখে ব্যথা ধরবে পড়তে। এইবার ‘শ্রান্ত বায়ে ক্লান্ত কায়ে ঘুমে নয়ন আসে ছেয়ে।’
যদি কষ্ট দিয়ে থাকি ক্ষমা করিস।
স্বেচ্ছাচারী
নূরুল হুদা
বাঁধনহারা – পরিচ্ছেদ ০৭
[ছ]
সালার,
১২ই ফাল্গুন
ভাগ্যবতীসু,
আমার বুক-ভরা স্নেহ-আশিস নাও। তারপর কীগো সব ‘কলমিলতা’ ‘সজনে ফুল’-এর দল, বলি – তোমরা যে-লতা যে-দলই হও তাতে আমার বিশেষ আপত্তি নেই, কিন্তু পথের পাশের এই ‘আলোক-লতা’, ‘ঘলঘসি ফুল’ দু-একটারও তো সেই সঙ্গে খবর নিতে হয়। তাতে তোমার হয়তো কলসিভরা ভালোবাসাতে খাঁকতি পড়বে না। পোড়াকপাল আমাদের ভাই, তাই আমাদের আর কোনো লতা-পাতা ফুল-ফল জুটল না। সে যা-ই হোক, এখন তোমার গুর্বী এই গরিব “ভাবিজি’কে কি এক-আধখানা চিঠি-পত্তর দেবে? না, তাতে তোমার সখা-সখীর মধু-চিন্তায় বাধা পাবে? এখন তোমাদের সই-এ সই-এ কত কথাই না হবে, আমাদের মতো তৃতীয় ব্যক্তির তাতে শুধু হাঁ করে চেয়ে থাকাই সার। এখন ‘সজন সজন মিল গিয়া, ঝুট পড়ে বরিয়াত!’ আচ্ছা, দেখা যাবে, – এক মাঘে শীত পালায় না! যদি তোমায় এই ঘরে আনতে পারি, তা হলে এই একচোখোমির হাড়ে-হাড়ে শোধ তুলব। মনে থাকে যেন, আমি এখন এই ঘরের কর্ত্রীঠাকুরণ!