আরো আঘাত সইবে আমার, সইবে আমারও,
আরো কঠিন সুরে জীবন-তারে ঝংকারও!
এই রকমে আমার দিনগুলো এখন যাচ্চে, ‘আদম-গাড়ি’র (রিকশ) মতন একঘেয়ে হচং হচং করে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে।
শুনচি, কয়েদ হওয়ার দরুণ আমায় নাকি যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে দেওয়া হবে না। যদি তা হয়, তাহলে আর এক কাণ্ড করে বসে থাকব। তা এখন বলছিনে। এ ব্যাটারা তো বুঝবে না যে, আমি কী জন্যে পলটনে এসেছি। তাই সকলেই শুধু ভুল বোঝে। অধিকাংশ সৈনিক যখন পদোন্নতির জন্য লালায়িত, তখন আমাকে প্রমোশন দিতে গেলেও আমি নিই না দেখে ওরা আমাকে ‘কাঠখোট্টা’, ‘গোঁয়ার’, ‘হোড়’ প্রভৃতি দুষ্পাচ্য গালাগালি দেয়। কিন্তু আমি জানি, দুঃখকে পাওয়ার জন্যেই আমি এমন করে বাইরে বেরিয়েচি। আমি রাজা ও দেশের জন্যে আসিনি। অত বড়ো দেবতা বা স্বার্থত্যাগী মহাত্মা হয়ে উঠতে পারিনি এখনও; আত্মজয়ই করতে পারলাম না আজও, তা আবার দেবতা! তাই আজও আমি রক্তমাংসের গড়া গোঁয়ার গর্দভ মানুষই রয়ে গেলাম।… পরে বরং দেবতা হওয়ার অভিনয় ও কসরত করে দেখা যাবে, যদি এই দুঃখ-কষ্ট-বেদনার আরাম আর আনন্দকে এড়িয়ে চলতে না হয়। কেননা, শুনেছি, দেবতাদের দুঃখ-কষ্ট বেদনা-ব্যথা বলে কোনো জিনিস জানা নেই, যদি তাই হয়, তবে ও আনন্দ-বিহীন নির্বিকার দেবত্বকে দূর থেকেই হাজার হাজার সালাম! যদি দুঃখই না পাওয়া গেল জীবনে, তবে সে জীবন যে বেনিমক, বিস্বাদ! এই বেদনার আনন্দই আমাকে পাগল করলে, ঘরের বাহির করলে, বন্ধন-মুক্ত রিক্ত করে ছাড়লে, আর আজও সে ছুটেছে আমার পিছু পিছু উল্কার মতো উচ্ছৃঙ্খলতা নিয়ে! দুঃখও আমায় ছাড়বে না, আমিও তাকে ছাড়ব না। সে যে আমার বন্ধু – প্রাণপ্রিয়তম সখা, – আমার ঝড়-বাদলের মাঝখানে নিবিড় করে পাওয়া সাথি! এ পাওয়ার আনন্দের যে তীব্র নির্মমতাভরা মাধুর্য, তাকে এড়িয়ে যাওয়ার সব শক্তি ওই পথে পাওয়া বন্ধু দুঃখই হরণ করেছে। তাই বাউল গানের অলস সুরে সামনের উদাসীন পথে আমার ক্রন্দন-আনন্দ একটা একটানা বেদনা সৃজন করে চলেছে, দিগন্তের সীমা ছাড়িয়ে অনন্তের পানে প্রসারিত হয়ে গেচে সে-পথ। বুকের ভিতর ক্রন্দন জাগে তার সেই চিরন্তন প্রশ্ন নিয়ে, ‘এ পথ গেছে কোনখানে গো কোনখানে?’ মূক পথের সীমাহীন আধ-আবছায়া আঁখির আগে ক্লান্ত চাওয়ার মৌন ভাষায় কইতে থাকে, ‘ তা কে জানে, তা কে জানে!’ এই অশেষের শেষ পেতে ততই প্রাণ আকুলি-বিকুলি করে ওঠে। তাতেও কত আনন্দ! এই যে নিরুদ্দেশ যাত্রা আর পথহীন পথচলার গূঢ় আনন্দ, তা থেকে আমার অতৃপ্ত আত্মতৃপ্তিকে বঞ্চিত করব কেন? তোরা অনুভূতিহীন আনন্দবিহীন পাথরের ঢেলা, – হয়তো একে ‘সোনার পাথর বাটি’ বা ‘কাঁঠালের আমসত্ত্ব’-এর মতোই একটা অর্থহীন অনর্থ মনে করে প্রশ্ন করবি, ‘যার সীমা নেই, শেষ নেই সে অজানার পিছনে ছোটার আবার আনন্দ কী?’ ওই তো মজা! এই অসীমের সীমা খোঁজায়, নিরুদ্দেশের চেষ্টায় যে দীর্ঘ অতৃপ্তির আশা-আনন্দ, সেই তো আমার উগ্র আকাঙ্ক্ষার রোখ চড়িয়ে দিচ্চে। শেষ হলে যে এ পথ চলারও শেষ, আর আমার আনন্দেরও শেষ, তাই আমি পথ চলি আর বলি, – যেন এ পথের আর শেষ না হয়। পাওয়ার আনন্দের শান্তির চাইতে, তাই আমি না-পাওয়ার আনন্দের অশান্তিকেই কামনা করে আসচি। যার জন্যে আমার অগস্ত্য-যাত্রা, আমার সেই পথ-চাওয়া ধনকে কি এই পথের পারেই পাব? সেও কি তবে আমার আশায় এই সীমার শেষে তার অনন্ত যৌবনের ডালি সাজিয়ে জন্ম জন্ম প্রতীক্ষা করে কাটাচ্চে? শুধু আমিই তাকে পেতে চাই? সে কী পথ চলে না আমার আশায়? না, না, সেও পেতে চায়, সেও পথ চলে; নইলে কে আমায় আকর্ষণ করবে এমন চুম্বকের মতো? কীসের এমন উন্মাদনাস্পন্দন আমার রক্তে-রক্তে টগবগ করে ফুটচে? – তার বাঁশি আমি শুনেচি, তাই আমার এ অভিসার যাত্রা ; আমার বাঁশি সে শুনেচে, তাই তারও ওই একই দিক-হারা পথে অভিসার-যাত্রা! আমি ভাবচি আমার এ-যাত্রার শেষ ওই পথহীন পথের অ-দেখা পথিকের কুটিরদ্বারে, – পথের যে-মোহনায় গিয়ে পথহারা পথিক ওই চেনা বাঁশির পরিচিত বেহাগ-সুর স্পষ্ট শুনতে পায়। সে বেহাগ-রাগে মিলনের হাসি আর বিদায়ের কান্না আলো-ছায়ার মতো লুটিয়ে পড়ে চারিপাশের পথে। কারণ, ক্লান্ত পথিক এই চৌমাথায় এসে মনে করে, বুঝি তার চলার শেষ হল; কিন্তু সেই পথেরই বাঁক বেয়ে বেহাগের আবাহন তাকে অন্য আর এক পথে ডেকে নেয়। তার পর সকালের পথ তাকে বিভাসের সুরে, দুপুরের পথ সারঙ-রাগে আর সাঁঝের পথ পুরবির মায়াতানে পথের পর পথ ঘুরিয়ে নিয়ে যায়! হায়, একী গোলকধাঁধা? কোথায় সে পথের বধুঁ যার বাঁশি নিরন্তর বিশ্বমানবের মনের বনে এমন ঘর-ছাড়া ডাক ডাকচে? যার অশরীরী ছোঁয়া শয়নে-স্বপনে-জাগরণে সারাক্ষণই বাইরে-ভিতরে অনুভব করচি, যে শুধু দুষ্টুমি করে পথই চলাচ্চে, ধরা দিয়ে ধরা দিচ্চে না? পেয়েও তবে এই না-পাওয়ার অতৃপ্তি কেন? এর সন্ধান কে দেবে? যে যায়, সে তো আর ফেরে না। এ অগস্ত্য-যাত্রার মানে কী?…
দুঃখ বলেছে সে আমাকে ওই পথের শেষ দেখাবে। সে নাকি আমার ওই বঁধুয়ার সখা। কোন্ পিয়াল বনের শ্যামলিমার আড়ালে লুকিয়ে থেকে সে চোর-চপল তার বাঁশি বাজাচ্ছে, তাই সে দেখিয়ে দেবে! তার সাথে গেলে সে এই লুকোচুরি ধরিয়ে দেবে। তাই দুঃখকে বরণ করেছি, তাকেই আমার পথের সাথি করেছি। সুখে যে-ক্লান্তি আছে, এ দুঃখে তা নেই; এর বেদনা একটা বিপুল অগ্নি-শিখা বুকের মাঝে জ্বালিয়েই রেখেছে – সে-শিখা ঝড়ে নেবে না, বাদল-বর্ষায় ঠান্ডা হয় না। এই আগুন-শিখার নামই অশান্তি। আমার জীবন-প্রদীপ ততক্ষণই জ্বলচে আর জ্বলবে, যতক্ষণ এই অশান্তির ‘রওগন’ বা স্নেহপদার্থ এই প্রদীপকে জ্বালিয়ে রেখেচে আর রাখবে। আগুন, ঝড়-ঝঞ্ঝা, বৃষ্টি, বিদ্যুৎ, বজ্র, আঘাত, বেদনা – এই অষ্টধাতু দিয়ে আমার জীবন তৈরি হচ্চে, যা হবে দুর্ভেদ্য – মৃত্যুঞ্জয় – অবিনাশী! – আমার এ-পথ শ্বাশত সত্যের পথ, – বিশ্বমানবের জনম জনম ধরে চাওয়া পথ। আমি আমার আমিত্বকে এপথ থেকে মুখ ফিরাতে দেব না। পথ-বিচ্যুতি ঘটাতে সুখ তো প্রলোভন দেখাবেই ; কেননা তার দুশমন ‘দুঃখ’ যে আমার সাথি। কিন্তু আর ফিরছিনে। এই যে দুঃখের বুক আঁকড়ে ধরেচি, এ আর ছাড়চিনে! আমি আজ আমার এই বিশ বছর বয়সের অভিজ্ঞতা এবং দশ-বিশে দুশো বছরেরও বেশি আঘাত-বেদনা নিয়ে সত্য করেই বুঝেছি যে, দুঃখী যখন আনন্দকে পেতে সুখের পেছনে মরীচিকা-ভ্রান্ত মৃগের মতন অনুসরণ করে, তখন সে তার দুঃখের দৌলতে যে আনন্দটুকু পেয়েছিল তা তো হারায়ই, উলটো সে আরও অনেকখানি পেছনে অসোয়াস্তির গর্তে গিয়ে পড়ে। তার পর তাকে সেই আগে-চলা দুঃখের পথ ধরেই চলতে হয়। মৃগ তৃষ্ণিকার মতো সুখ শুধু দূর-তৃষিত মানবাত্মার ভ্রান্তি জন্মায়, কিন্তু সুখ কোথাও নেই – সুখ বলে কোনো চিজের অস্তিত্বও নেই ; ওটা শুধু মানুষের কল্পনা, অতৃপ্তিকে তৃপ্তি দেওয়ার জন্যে কান্নারত ছেলেকে চাঁদ ধরে দেওয়ার মতো ফুসলিয়ে রাখা। আত্মা একটু সজাগ হলেই এ প্রবঞ্চনা সহজেই ধরতে পারে।…