তার পর, আমার জন্যে বিশেষ কোনো চিন্তিত হওয়ার দরকার নেই এখন সম্প্রতি মাসখানেকের জন্যে। কারণ, গত পরশু এক শুভলগ্নে আমি আমার কোম্পানির সেনানী এক কাপ্তেন সাহেবকে একই ঘুষিতে ‘চাঁদা মামা’ দেখিয়ে এখন বন্দীখানায় বাস করচি! বড়ো দুঃখেই তাঁর সঙ্গে এরকম খোট্টাই রসিকতা করতে হয়েছিল, কেননা তিনি কিছুদিন থেকে নাকি আমার প্যারেড ও কাজে অসাধারণ চটক, নৈপুণ্য এবং কর্তব্যপরায়ণতা দেখে আসছিলেন, তাই সেদিন যখন মেসোপটেমিয়া যাওয়ার জন্যে আমাদের ‘বিবাহের খাকি-চেলি পরিধানপূর্বক’ নববধূর মতো আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আড়-চোখে-চোখে আমাদর পতিদেবতাস্বরূপ প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষের শুভাগমন প্রতীক্ষা করছি আর ঘেমে তেতে লাল হচ্চি – অবশ্য লজ্জায় নয়, খর চাঁদি-ফাটা রোদ্দুরের তাপে, – তখন হঠাৎ তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আমাদের কোম্পানির সুবাদার সাহেবকে বললেন যে, আমার মেসোপটেমিয়া যাওয়া হবে না, নতুন রংরুটদের শিক্ষা দেওয়ার জন্যে করাচিতেই থাকতে হবে এবং আমাকে ওই খেসরতের ক্ষতিপূরণস্বরূপ লান্সনায়কের পদে উন্নীত করা হবে। কথা শুনে আমার অঙ্গ জুড়িয়ে গেল আর কী! তাই তাঁর এ অন্যায় আবদারে প্রতিবাদ করায় তিনি বেদম খাপ্পা হয়ে চোখ রাঙিয়ে উঠলেন, – ‘মেরা হুকুম হ্যায়!’ তোর হুকুমের নিকুচি করেনি! জানিস তো পুরুষের রাগ আনাগোনা করে, – যেই দাঁত খিঁচিয়ে উঠেচে, অমনি চোস্ত গোছের পরিপক্ব একটি ঘুঁষি সাহেবের বাম চোয়ালে, – তিনিও অবিলম্বে পপাত ধরণিতলে এবং সঙ্গে সঙ্গে ‘পতন ও মূর্ছার’ হাতে-কলমে অভিনয়! তারপর, আমায় ঠেলে ঢোকানো হল ‘কোয়ার্টার গার্ডে’ বা সামরিক হাজতে; তারপর বিচারে ২৮ দিনের সশ্রম কারাদণ্ড ও সামরিক গারদখানায় বাস! কুছ পরোয়া নেই।আমি এই সশ্রম কারাদণ্ডকে ভয় করলে আর জান দিতে আসতাম না। দুঃখকষ্টই তো আমার অপার্থিব চিরদিনের চাওয়া-পাওয়া ধন। ও যে আমার অলংকার! তাই হাসিমুখেই তাকে বরণ করে নিয়েছি! আমাদের সৈন্যাধ্যক্ষ আমায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমি সাহেবকে ওরকম আপ্যায়িত করেছিলাম কেন? তাতে আমি শুধু এইটুকু বলেছিলাম, – সাহেব ! সৈনিক হয়ে এসেচি মারামারি করবার জন্যই, প্রেম করবার জন্যে নয়!’ তাছাড়া, দেখ না ভাই, একে আমার মনের ঠিক নেই এবং মনের সে তিক্ত ভাবটাকে কোনোরূপে চাপা দিতে চাইছিলাম দু-দিন বাদে আগুন দেখতে পাব এই আনন্দে, – আর ঠিক সেই সময় কিনা তিনি এসে আমায় ‘কেতার্থ’ করে দিলেন!
অতএব এখন কী করে আমার দিন কাটচে, আন্দাজেই মালুম করে নিতে পারবি। কিন্তু সে রকম ভাবতে পারাটাও তোমাদের অসামরিক লোকের পক্ষে এক রকম অসম্ভব ব্যাপার ; কারণ, সৈনিকের খাটুনি ধস্তাধস্তি কুস্তাকুস্তিও দেখনি এবং তাদের মিলিটারি শাস্তি বা গারদখানার ধারণাও তোমাদের বুদ্ধির অতীত, এ আমি হলফ করে বলতে পারি। এখন খোদার নাম নিয়ে ভোরে উঠেই আমার গারদের ভিতর বসে হাত-পায়ের শিকলগুলো ঝংকার দিই। আহ্, সে কী মধুর বোল! আমার কানে তা যে কোনো তিলোত্তমা-তুল্যা ষোড়শী কুমারীর বলয় নূপুর ও রেশমি চুড়ির মধু শিঞ্জনের চেয়েও মিষ্টি হয়ে বাজে! তারপর শ্রীমান গুপিচন্দ্রের শিঙের (বিউগল্) আওয়াজ ‘কখন শুনি কখন শুনি’ করে যুগল কর্ণ উৎকর্ণ হয়ে ওঠে। রাই বিনোদিনীর মতোই অহম পু্ং-বন্দিনী তখন হাঁশ-পাঁশ করে ঘন শ্বাস ফেলতে থাকে আর সঙ্গে সঙ্গে বুকের খাকি বসনও ভীতি-সংকোচে আন্দোলিত হতে থাকে এবং আয়ান ঘোষ-রূপ এই লান্সনায়েক নারাণ ঘোষের গোয়াল বা গারদঘরে বসে শুনি, – ‘ওই বুঝি বাঁশি বাজে!’ অবিশ্যি, তা বন-মাঝে নয়, সন্ত্রস্ত মন-মাঝে! – হায়, সে কোন্ শ্যাওড়াতলায় হেলমেট-চূড়াশিরে রাইফেল-বংশী হাতে আমার সান্ত্রি-কালাচাঁদ ত্রিভঙ্গ ঠামে দাঁড়িয়ে আছেন! আমার এই শ্যামকান্তের ত্রিভঙ্গ নাম সার্থক, কেনা বুটপট্টি পরার পর তাকে ঠিক তিন জায়গায়ই ভঙ্গ বলে মনে হয়। প্রথম, পট্টি-লেপটানো পায়ের উপরে হাঁটুতে ‘দ’-এর মতো একটা ভঙ্গ; দ্বিতীয়, তাঁর কোমর-বন্ধের বাঁধনের ঠেলায় এবং কতকটা স্বভাবতই ভঙ্গ; তৃতীয়, তাঁর স্বর ভঙ্গ! আরও আছে, – তাঁর পৃষ্ঠদেশ অষ্টাবক্র মুনির মতন বাঁকা বলে আমরা তাঁর নাম দিয়েচি, ‘ফ্লাগব্রোকেন’ অর্থাৎ কিনা ধ্বজ-ভঙ্গ! কিন্তু ওই অষ্টাবক্রিয় ভঙ্গটাও হিসেবের মধ্যে ধরলে উনি চতুর্ভঙ্গ হয়ে যান বলে ওটা এখন ধরতার মধ্যে ধরিনে। … হ্যাঁ, তার পর আমায় কী করতে হয় শোন। শ্রীদামরূপ ধড়া-ধারী তাঁর এক সখা এসে আমায় কালার গোষ্ঠে নিয়ে যান ; আমিও মহিষ-গমনে আনত নেত্রে তাঁর অনুগমন করি। পথের মাঝে আমার লাজবিজড়িত শৃঙ্খল-পরা চরণে পঞ্চমেবোলা বাণী বেজে ওঠে, – ‘রিনিক ঝিনিকি রিনি ঝিনি রিনিঝিনি ঝিন্নিরে!’ তার পর এই মুখর ‘মঞ্জু মঞ্জু মঞ্জীরে!’ পথের যুবকবৃন্দকে চকিত করে গোষ্ঠে গিয়ে ঘণ্টা দুই গোষ্ঠবিহার! অর্থাৎ শ্যামের হুকুম মতো সামনের একটা ছোট্ট তাল-তমালহীন পাহাড় বারকতক দৌড়ে (ডবল মার্চ করে) প্রদক্ষিণ করে আসা – সেই দৌড়ানোর মাঝে মাঝে ‘ডবল মার্ক টাইম’ করা বা শিব ছাড়া যে সৈনিকেও তাণ্ডব নৃত্য করতে পারে, তা দেখিয়ে দেওয়া, – মধ্যে পরিখা-খাল ডিঙিয়ে মর্কট-প্রীতি প্রদর্শন করা ইত্যাদি! এসব লীলা রে লীলা, একেবারে রাসলীলা! এই দুই ঘণ্টা অমানুষিক কসরতের পরেও যখন পৈতৃক প্রাণটা হাতে করে ঘরে ফিরি, তখন স্বতই মনে হয় – নাঃ, ‘শরীরের নাম মহাশয়’ হওয়াটা কিছুই বিচিত্র নয়! এ মহাশয়কে যা সওয়াবে তাই সয়। তারপর বেলা এগারো-বারোটায় যে আ-কাঁড়া রেঙ্গুনি চালে সফেন ভাতের মণ্ড আর আ-ছোলা আলুর ঘেঁট খেতে পাই, তা দেখে আমরা বলদের চেয়ে উচ্চ শ্রেণির জীব বলে তো মনে হয় না। ডাল যা দু-একদিন হয়, তাতে নাকে-কানে সরষের তেল দিয়ে ডুব মারলেও কলাই-এর সন্ধান পাওয়া যাবে না! সকালে একবার ভেলি গুড় দিয়ে তৈরি এক হাতা যা চা পাই, তা না বলে দিলে বহু গবেষণাতেও কেউ চিনতে পারবে না যে, এ আবার কোন্ চিজ! এ যেন রোগীকে জবরদস্তি করে পথ্য গেলানোর মতো, ‘খাবি তো খই খা, না খাবি তো খই খা!’ যা হোক, অতক্ষণ খাবি খাওয়ার পর ওই জাব খাওয়াই তখন পরম উপাদেয়, অমৃত বলে বোধ হয়। তার পর একটু বাদেই পাথর কুড়ানো, ভাঙানো, আবার সন্ধ্যেয় ওই রকম প্যারেড বা গোষ্ঠবিহার এবং আরও কত বিশ্রী-সুশ্রী কাজ। সেসব শুনলে তোমার চক্ষু কাঁকড়ার মতন কোটরের বাইরে ঠেলে বেরিয়ে পড়বে।… তবু কিন্তু বুক ফুলিয়ে বলচি বেড়ে আরামেই আছি। আমি এই পিঁজরা-পোলে আটক থেকেও কী করে হরদম গান গাই, তা এখানকার সান্ত্রিসংঘ বুঝে উঠতে পারে না। এই দ্যাখ না, তোকে চিঠি লিখতে বসেছি – আর সঙ্গে সঙ্গে গানও ধরে দিয়েছি, –