বাড়ির সব খবর ভালো। মাহ্বুবা বিবি বর্তমানে মাতুলালয়-বাসিনী। সোফিয়া বিবি তেপসে-যাওয়া মালসার মতন নাকি আজকাল মুখ ভার করে থাকেন। রবিয়ল সাহেবের এসরাজ-সারেঙ্গির কোঁকানি একটু মন্দা পড়েচে। আমার এখন লেখাপড়ার চিন্তার চেয়ে বোঝাপড়ার চিন্তাটাই বেশি। – ওই যাঃ, একটা হুতুম-প্যাঁচা ডেকে উঠল রে – বড্ড অলুক্ষণে ডাক! শুয়ে পড়ি ভাই, মাথা নুয়ে আসচে!
তোর বিয়োগ-কাতর
মনুয়র
বাঁধনহারা – পরিচ্ছেদ ০৬
[চ]
করাচি সেনানিবাস,
(শ্রীঘর)
১৭ ফেব্রুয়ারি
বাঁদর মনো!
শুয়োর পাজি-ছুঁচো-উল্লু-গাধা-ড্যাম-ব্লাডিফুল-বেল্লিক-বেলেল্লা-উজবুক-বেয়াদব-বেতমিজ!– ওঃ আর যে মনে পড়ছে না ছাই, নইলে এ চিঠিতে অন্য কিছুই না লিখে শুধু হাজার খানেক পৃষ্ঠা ধরে তোকে আষ্টে-পিষ্টে গাল দিয়ে তবে কখনও ক্ষান্ত হতাম! একটা অভিধানও পাওয়ার জো নেই এই শালার জিন্দানখানায়, নইলে দিনকতক ধরে এমনিতর চোখা চোখা গাল পসন্দ করে তোকে বিঁধতাম যে, যার জ্বলনের চোটে তুই বিছুটি-আলকুসি-লাগানো ছাগলের মতন ছুটে বেড়াতিস – আর তবে না আমার প্রাণের জ্বালা হাতের চুলকুনি কতকটা মিটত! আচ্ছা, তোদের ভাই-বোন সবারই ধাত কি একই রকমের? তোদের ধর্মই কি মরার ওপর খাঁড়ার ঘা দেওয়া? তোরা কী সুখ পাস এমন বে-দিলের মতন বেদনা-ঘায়ে ভোঁতা ছুরি রগড়ে? বল, ওরে হিংস্র জানোয়ারের দল, বল এতে তোদের কোন্ জিঘাংসা-বৃত্তি চরিতার্থ হয়! কী বলব, ভাগ্যিস তুই আমার হাতের নাগালের মধ্যে নেই, নইলে কামড়ে তোর বুকের কাঁচা মাংস তুলে ছাড়তাম! হায়, আমার জান যে আজ কীরকম তড়পে তড়পে উঠছে তোদের এই মুরগি-পোষা ভালোবাসার জুলুমে, তা ভাষায় ব্যক্ত করতে না পেরে শুধু এই চিঠির কাগজটাকে কামড়িয়ে – নিজের হাতের গোশত নিজে চিবিয়ে আমার অতৃপ্ত রোষের ক্ষোভ মিটাচ্ছি! এখন আমার মনে হচ্চে, হনুমানের সাগর-লঙ্ঘনের মতন মস্ত এক লাফে এই দু হাজার মাইল ডিঙিয়ে তোর ঘাড়ের ওপর হুড়মুড় করে ঝাঁপিয়ে পড়ে তোকে একদম ‘কীচক-বধ’ করে ফেলি। তোর ওই বাঁকুড়া কলেজটাকে গন্ধমাদন পর্বতের মতন চড়চড় করে উপড়ে ফেলে সটান গন্ধেশ্বরীর গর্ভে নিয়ে গিয়ে ফেলাই! তার পর ভাবিসাহেবার ঘরটাসুদ্ধ সারা সালারটাকে অযুত বিসুবিয়াসের অগ্নিস্রাবে একদম নেস্ত-নাবুদ করে ফেলি! ভারি সব পণ্ডিত মনস্তত্ত্ববিদ কিনা, তাই এইসব ডেঁপোমি করে চিঠি লেখা! আমি নিজেকেই বা আর কী বলব, তোদর একটু পথ দেখাতেই তোরা ‘খাইবার-পাস’-এর মধ্যের গোরা সৈন্যের মতন সেই পথ দিয়ে অবিশ্রান্ত গোলাগুলি বর্ষণ করে আমাকে ঘায়েল করে ফেললি! যত দোষ এই আমি-শালার! তোর আগেকার চিঠিটা পেয়ে খুশি হয়ে যে উত্তর লিখেছিলাম, তা আলসেমি করে আর ডাকে দিইনি, তারপর তোর পরের বিশ্রী চিঠিটা পেয়েই তক্ষুণি সে-চিঠিটা ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলেচি! মনে করেছিলাম, তুই ভালো, – আরে ‘তওবা’! সব শিয়ালের একই ডাক! পরের চিঠিটার পুরো উত্তর যে এখন দেবই না, তা বোধ হয় আর লিখে জানাবার দরকার নেই! যদি কোনোদিন আমি শান্ত হয়ে তোর অপরাধ ক্ষমা করতে পারি, তবেই উত্তর দেব – নইলে নয়। ভাবিসাহেবার চিঠিও তোরই মতো ‘রাবিশ’-যতসব মনগড়া কথায় ভরা। হবে না? হাজার হোক, তিনি তো তোরই বোন! আর কাজেই তুইও যে তাঁর সহোদর, তা মর্দের মতই প্রমাণ করলি! … খোদা তোদের মঙ্গল করুন!
তোদের খবর যদি ইচ্ছা করিস, দিতে পারিস। চিঠিপত্র বন্ধ করলে বা খবর না পেলে যে খুব বেশি চিন্তিত হব তা ভুলেও মনে করিসনে যেন। সেদিন আর নেই রে মনু, সেদিন আর নেই! এখন সারা দুনিয়া গোল্লায় গেলেও আমি দিব্যি শান্তভাবে পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে গোঁফে তা দিতে থাকব। জাহান্নামে যাক তোর এই দুনিয়া! আমার তাতে কী? দুনিয়ার সঙ্গে আমার সম্বন্ধ কী যে, আমি তার জন্যে ঝুরে মরব? মনে রাখিস, – দুনিয়া যদি হয় বুনো ওল, তবে আমি বাঘা তেঁতুল; দুনিয়া যদি হয় সাপ, তবে আমি নেউল: দুনিয়া যদি হয় রাধা-শ্যাম তবে আমি শ্রী কাঁধে-বাড়ি বলরাম!…আর কত বলব? কতই বা যা তা বকব! এক কথায়, আমি এখন থেকে সংসারের মহা শত্রু! সে যদি যায় পুবে, আমি যাব পশ্চিমে! এই তিন সত্যি করে দুনিয়ার সঙ্গে দুশমনি পাতালাম, দেখি কে হারে – কে জেতে … দূর ছাই! রাজ্যের ঘুমও আসচে যেন একেবারে আফিমের নেশার মতন হয়ে, – একেবারে মরণঘুম এলেও তো বাঁচি! আর, ঘুমকেই বা দোষ দেব কী! হাবিলদারজি আজ যে রকম দু ঘণ্টা ধরে আমায় মাটি খুঁড়িয়েচে! এমন ‘কেঠো’ হাতেও ফোসকা পড়িয়ে তবে ছেড়েচে! – হাঁ, এই হাবিলদার কিন্তু এক ব্যাটাছেলে বটে! একেই তো বলতে হয় সৈ-নি-ক পু-রু-ষ! আমায় পুরো দুটি ঘণ্টা গাধার চেয়েও বেহেজ্ খাটিয়েচে, একবার কপালের ঘাম মুছতেও দেয়নি – এমনি জাঁক! অত কষ্টের মধ্যেও আমার তাই একটা তীব্র তীক্ষ্ম আনন্দ শিরায় শিরায় গরম হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছিল, এবং তা এই ভেবে যে, আহা আর কেউ তো এমন করে দুঃখ দিয়ে আমার সব কিছু ভুলিয়ে দেয় না! এমনি কঠোরতা – না, এর চেয়েও সাংঘাতিক পরুষতা – আমি সব সময় চাইছি, কিন্তু পাই খুব কম! তাই আমার শাস্তির দরুণ ওই দু ঘণ্টা খাটুনি হয়ে যাওয়ার পর আমি হাবিলদার সাহেবের পাটাতন করা বুকে জোর দুটো থাপ্পড় কষিয়ে বাহবা দিয়েছিলাম! তীক্ষ্ণ উৎসাহের চোটে থাপ্পড় দুটো এতই রুক্ষ আর বে-আন্দাজ ভারি হয়ে পড়েছিল যে, তাঁর চোখে সত্য সত্যই “ভুগজুগুনি’ জ্বলে উঠেছিল! তাঁর চোখের তারা আমড়ার আঁটির মতন বেরিয়ে পড়লেও লজ্জার খাতিরে তিনি ‘কিছুই হয়নি’ বলে কাপাস-হাসি হাসতে চেষ্টা করেছিলেন। পরে কিন্তু তিনি সানন্দে স্বীকার করেছেন যে, আমি বাস্তবিকই তাঁকে একটু বেশিরকমই বেসামাল করে ফেলেছিলাম এবং তিনি এখন বিশ্বাস করেন যে, এরকম কারে পড়লে দিনেও তারা দেখা যেতে পারে! তবু এই হাবিলদারজিকে বাহাদুর পুরুষ বলতে হবে; কারণ অন্যান্য নায়ক হাবিলদারদের মতন সে অপরাধীকে না ঘাঁটিয়ে বসে থাকতে দিয়ে সৌজন্য প্রকাশ করে না – কর্তব্যে অবহেলা করে না। তাই আমাদের সৈনিক-সংঘ এঁর নাম রেখেছে, পাষণ্ড দুশমন সিং। এ বেচারা লেখাপড়া জানে কম, কিন্তু ‘নাচো কুঁদো ভুলো মৎ’ অর্থাৎ কাজের বেলায় ঠিক – একদম ঘড়ির কাঁটার মতো! তাই আমাদের শিক্ষিত হামবাগের দল এখনও সাধারণ সৈনিক এবং ইনি শিগগিরই ভারপ্রাপ্ত সেনানী হতে যাচ্ছেন।… পলটনে এসে গাফেলিই তো এক মহা অন্যায়, তার ওপর ব্যাটাচ্ছেলের আবার দুর্বলতা দেখো দেখি – পাছে বাংলার ননীর পুতুলদের নধর গায়ে একটু আঁচ লেগে তা গলে যায়, তাই তাঁদের কাজ থেকে রেহাই দিয়ে উচ্চ সেনানীদের দিনকানা করা হয়। যেই কোনো লেফটেন্যান্ট কাজ দেখতে আসেন, অমনি তারা এমনই নিবিষ্ট মনে, এত জোরে কাজ করতে থাকেন যে, তা দেখে স্বয়ং ব্রহ্মারও ‘সাবাস জোয়ান’ বলবার কথা! কিন্তু সে যখন দেখে যে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যা কাজ হওয়া উচিত ছিল, তার এক-চতুর্থাংশও হয়নি, তখন বেচারার বিস্ময়ের আর অবধি থাকে না! গভীর গবেষণা করেও তার গোবরগাদা মগজে এর কারণটা আর সেঁদোয় না – আর কাজেই তাকে বলতে হয় ‘বাঙালি জাদু জানতা হ্যায়!’ অবশ্য সবাই নয়, কিন্তু এইরকম করে অনেকেই বাঙালি ছেলেগুলোর কাঁচা মাথা চিবিয়ে খাচ্চে। কাজেই আমার সঙ্গে এই ধরনের সব সৈনিকের প্রায়ই মুখোমুখি এবং সময়ে হাতাহাতিও হয়ে যায়, আর শাস্তি ভোগটা করতে হয় আমাকে সবসে জিয়াদা!রাজার জন্য কাজ নাই-ই করলি, কিন্তু এও তো একটা শিক্ষা! যে-সামরিক শিক্ষা লাভের সৌভাগ্য বাঙালি এই প্রথম লাভ করেচে, তাকে এই রকম নষ্ট হতে দেওয়া কি বিবেকসম্মত? আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত সামরিক শিক্ষাই আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। দেশের লোকের এত আশা, আমাদের প্রতি তাঁদের এত স্নেহ-আদরের সম্মান আমাদের প্রাণ দিয়েও রাখতে হবে। প্রাণ তো দিতেই এসেছি, তাই বলে লক্ষ্যচ্যুত হলে চলবে কেন? এ-ভীরুতা যে সৈনিকের দুরপনেয় কলঙ্ক।… পুরুষ-কা বাচ্চা পৌরুষকে বিসর্জন দেব কেন? সৈনিকের আবার দয়া-মায়া কীসের? সিপাই-এর দিল হবে শক্ত পাথর, বুক হবে পাহাড়ের মতন অটল, আর বাহু হবে অশনির মতন কঠোর! – গর্দানে একটা ‘রদ্দা’ বসালেই যেন বুঝতে পারে, হাঁ পৃথিবীও ঘোরে, আর স্বর্গ মর্ত্য পাতাল বলেও তিনটে ভুবন আছে! মরদের যদি মর্দানিই না রইল, তবে তো সে নিমোরাদে। মানুষের এরকম ‘মাদিয়ানা’ চাল দেখে মর্দমী আজকাল বাস্তবিকই লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছে না।