বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়,
অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময়
লভিব মুক্তির স্বাদ!
আছে তোর এ সাহস? বল তাহলে আমিও বিস্মিল্লাহ্ বলে কাছা এঁটে একবার লেগে পড়ি।…
হাঁ, তারপর – ঝড়-বৃষ্টির মাতামাতিতে তোর কোন্ জাঁদরেল-তন্বীর বা জাহাঁবাজ-কিশোরীর দাপাদাপি মনে পড়েছিল রে? আমি তো ভেবেই পাচ্চিনে। শুনি, কবিকুল নাকি কল্পলোকের জীব ; তারা স্রেফ কল্পনা নিয়েই মশগুল, তাঁদের কথায় বাস্তবতা একরকম ‘নদারদ’ বললেই হয়। আর, এই যদি হয় কবির সংজ্ঞা, তাহলে তুইও কবি (এবং সেই জন্যেই তোকে প্রথমেই কবিসৈনিক বলে সম্বোধন করেছি)। আচ্ছা, এই যে তোর খেলার সাথি দুষ্ট চপল প্রিয়া. ইনি তোর মানসী-বধূ, না কোনো রক্ত-মাংসের শরীরধারিণী সত্যিকার মানবী? রাজকন্যা, স্বপ্নরানি, পরিস্থানের বাদশাজাদি, ঘুমের দেশের আলোক-কুমারী বা ওই কেসেমেরই যত সব উদ্ভট সুন্দরীদের রাঙা চরণের আশা যদি থাকে তোর, তবে দ্বিতীয় ভাগের সুবোধ বালকের মতন ওসব খামখেয়ালি এক্ষুণি ছেড়ে দে, ছেড়ে দে! গোলে-বকাওলিতেই লেখা থাক, বা আরব্য উপন্যাসের উজিরজাদিই বলুন, – কিন্তু কই কাউকে তো সত্যি সত্যিই কোনো পাখনাওয়ালি পরি এসে উড়িয়ে নিয়ে গেছে বলে শুনলাম না। পালঙ্কসুদ্ধ উড়িয়ে না নিয়ে যাক রে ভাই, অন্তত বিছানার চাদরটা জড়িয়েও তো আমাকে ওই পরি-বানুরা এক-আধ দিন তাঁদের আজব দেশে নিয়ে যেতে পারতেন। কত দিন শরৎ, হেমন্ত, গ্রীষ্ম, বসন্তের চাঁদিনি-চর্চিত যামিনীতে ছাদে শুয়ে শুয়ে সর্দি-কাশি ধরিয়েচি, কিন্তু এ পোড়াকপালে ওই গগনমার্গের দিকে চক্ষু তেড়ে তাকানো ছাড়া আর ওড়া হল না। বাদুড় চামচিকে উড়ে যেতে অনেক দেখেচি, কিন্তু কোনো পরির আসমানি চাদর বা হেনায়-রাঙা পদপল্লব বা ডাঁশা আঙুরের মতন ঢলঢলে মুখ দেখা তো দূরের কথা, তাদের পাখা-পাখনারও একটি থর বা কোনো পাত্তা পাওয়া গেল না। … সেসব যাক, এখন তোর নামে মস্ত একটা অভিযোগ দেব, যে অভিযোগ কখনও দেব বলে আমার আজকের রাতের আগে আর মনে হয়নি। আজ যেন দিনের মতন সাফ বুঝতে পাচ্চি, কখনও তোর মনের কথা পাইনি বা তোকে বুঝতেও পারিনি। শুধু তোর ওই ওপরকার হাসির ছটাতেই ভুলে ছিলাম। আজ যখন তুই অনেক দূরে মরণের বুকে দাঁড়িয়ে তাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করছিস, যখন মনে পড়ছে যে হয়তো তোর সাথে আমাদের আর দেখা নাও হতে পারে, তখনই বুকের ভেতর এক অশান্ত অসোয়াস্তি তোলপাড় করে উঠচে – হায়, কেন এতদিন তোকে কাছে পেয়েও আরও কাছে পাইনি ; কেন তোকে বুঝতে পারিনি! – কার করুণা-মাখা অধর, কার বিদায়-ক্ষণের চেয়ে থাকা তোকে মেঘলা-দিনে এমন উতলা করে তোলে? সজলমেঘ কার কাজল-নয়ন মনে করিয়ে দেয়? আমি তাই এ নিশীথ রাতে একলা বসে ভাবচি আর ভাবচি। সে কে? কোন্ কিশোরীর ভালোবাসার হিরা তোর মনের কাচকে দু-ফাঁক করে কেটে দিয়েছে? কোন্ খাতুনের মুখ-সরোজ তোর হিয়ার সরসীতে এমন চিরন্তনী হয়ে ফুটেচে? তা তুই আর হয়তো তোর মানসী দেবী ছাড়া কেউ জানে না। তোর জীবনের পথে আচমকা আসা অনেকগুলি কচি-কিশোর মুখ মনের মাঝে ভেসে উঠচে, কিন্তু কোনোটাকেই মনে লাগচে না যে এ তোর মর্মর মর্মে স্থায়ী নিবিড় দাগ কাটতে পারে। এ সবারই মাধুরী শুধু সৌদামিনীর মতো একটুখানিক চমকে হেসে আঁধার পথের যাত্রীর চোখ ঝলসিয়ে দিয়ে যাচ্চে। একটা কথা কিন্তু এইখানে মনে হচ্চে আমার। – যদি কোনো এক কিশোরী কুমারীর মাঝে থাকত আমার ভবিষ্যৎ গৃহলক্ষ্মী শ্রীযুক্ত সোফিয়া খাতুনের গভীর অভিমান-ভরা মিষ্টি দুষ্টুমি আর অবাধ্য চপলতা, এবং সেই সাথে শ্রীমতী মাহ্বুবা খাতুনের নিবিড় ভালোবাসা-মাখা করুণা ও বিদ্রোহ-মাধুর্যের আমেজ, – আর সেই সুন্দরী যদি নিঃসংকোচে সহজ সরলভাবে তোকে তার পথে জোর করে টেনে নিয়ে যেতে পারত, তবে একমাত্র সেই তোর বাঁধন-হারা জীবনটাকে এমন করে মরুর মাঝে শুকিয়ে মরতে না দিয়ে সফলতার পুষ্পমঞ্জরিতে মুঞ্জরিত করে তুলত। – তুই বাইরে যত বড়োই বেহায়া বেল্লিকপনা কর না কেন, অন্তরে তোর মতন লাজুক আর কেউ নেই ; তোর ভিতরের লজ্জাশীলতার কাছে আমাদের নব-বধূদেরও হার মানতে হবে। আমি বরাবর দেখে এসেচি, যেখানে বেশ সোজাভাবে মিশতে না পারার দরুণ তোর গোপন দুর্বলতার শক্ত বাঁধন একটু শিথিল হয়ে এসেচে, সেইখানেই তুই মন্ত্রবশীভূত গোখরো সাপের মতন ফণা গুটিয়ে বসে পড়েছিস। বিশেষত, কোনো অচেনা সুন্দরী তরুণীর মুখোমুখি হলেই তুই দু-একদিন যেরকম ব্যতিব্যস্ত খাপছাড়া ভাব দেখাতিস কথায় কাজে, তার সত্যিকার গূঢ় হেতুটা কী বল দেখি? সেটা সুষমা-পিপাসু মনের সৌন্দর্য-তৃষা, না ওই রূপের ফাঁদে ধরা পড়বার ভীতি-কম্পন? তোর আরও একটা দুর্বলতা ও শক্ত শক্তির কথা মনে পড়চে আমার – তুই যেমন শিগগির কোনো কিছুতে অভিভূত হয়ে পড়তিস, সেই রকম শীঘ্রই আবার সেটার কবল থেকে নিজেকে জোর করে ছিনিয়ে নিতে পারতিস। অবশ্য শেষের গুণটা পৌরুষ না হয়ে নির্মম নির্দয়তারই বেশি পরিচয় দেয়। তোকে যে ধরতে যাবে, তাকে আগে নিজেকে ধরা দিতে হবে। অনবরত স্নেহের সুরধুনী বইয়ে প্রীতির মরূদ্যান রচনা করে, তোর মরুযাত্রী পিয়াসি আত্মাকে যদি কোনো নারী প্রলুব্ধ আকৃষ্ট করতে পারত, তাহলে বোধ হয় এই তরুণ বয়সেই তোর বেদনার বোঝা এত অসহ্য হয়ে উঠত না! তোর মতন বিপুল অভিমানী যে কারুর স্নেহ যাচঞা করে না, তা আমি জানি। আমি আরো জানি, তোদের মতো অভিমানীদের আত্মসম্মান-জ্ঞান আর দুর্বলতা ধরা পড়বার ভয় ভয়ানক তীক্ষ্ম সজাগ। কিন্তু এ আমি বলবই যে, এটা তোদের অনেকটা যেন একগুঁয়েমি ; তোদের মনের অতৃপ্ত কামনা একটা তরুণ বুকের স্নেহ-ভালোবাসা পাওয়ার আশায়, দুটি টানা চোখের মদিরাভরা শিথিল চাউনির আবেশের ক্ষুধায়, একটি কম্পিত পাতলা ঠোঁটের উষ্ণ পরশের তৃষায় হা হা করে ছাতি ফেটে মরচে – বোশেখ-মধ্যাহ্নের আতপ তপ্ত ভুখারি ভিক্ষুকের মতো! কিন্তু এত আকণ্ঠ পিপাসা নিয়েই সে তৃষাতুর কামনা শুধু তীব্র অভিমানের রোষে আত্মহত্যা করচে! নরঘাতকের মতো তোরা বাসনার গর্দানে খড়্গের ওপর খড়্গ হেনে তাকে কাটতে তো পারছিসইনে, শুধু কচলিয়ে কচলিয়ে মর্মন্তুদ যন্ত্রণা দিচ্চিস! তবু পাষাণ – তোদের বিক্ষুব্ধ ক্ষোভ মিটল না, মিটল না! এর ফল বড্ড ভয়ানক, অতি নিষ্করুণ! তাই বলি ভাই নূরু, তোর পায়ে পড়ে বলি, ফিরিয়ে আন তোর এ গোঁয়ার মনকে এই গোবির তপ্ত উষার ধুধু শুষ্কতা হতে! এতে অন্ধ হবি, শক্তি হারাবি, অথচ কিছুই হবে না জীবনের। তোর মধ্যে যে বিরাট শক্তি সিংহ সুপ্ত রয়েচে, কেন তাকে এমন করে এক অজানার ওপর অন্ধ অভিমানের ক্ষিপ্ততায় হত্যা করবি? সংসারে থেকে সংসারের বাঁধনকে উপেক্ষা করে এ স্পর্ধার অট্টহাসি হেসে প্রকৃতির ওপর প্রতিশোধ নেওয়া অসম্ভব রে অসম্ভব! ফিরে আয় ভাই, ফিরে আয় এ ধ্বংসের বন্ধুর পথ হতে! …তোর প্রাণের অগ্নিবীণার এই যে আগুন-ভরা দীপক-রাগ আলাপ, এ যে তোকে পুড়িয়ে খাক করে ছাড়বে ভাই! মেঘমল্লারের স্নেহ-স্নিগ্ধস্পর্শ ছাড়া এ আগুন শান্ত করবে কে? যদি ধরা না দেওয়া, বাঁধন এড়ানোতেই তোর আনন্দ, তবে তো এ জীবন-ভরা চঞ্চলতা দিয়ে পথের ভ্রান্ত পথিকগুলোকে মুগ্ধ করিস কেন? লুব্ধা মৃগীকে মায়া-তানে বনের বাহির করে তাকে মৃগ-তৃষ্ণিকায় ফেলে যাওয়াটাই কি খুব বড়ো পৌরুষের কথা? এ কী পাণ্ডুর-পাংশু আনন্দ! জানি, তুই বলবি, ‘আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ!’ কিন্তু এতদিন ভুলেচি, আজ আর ও-ফাঁকির কথায় ভুলচিনে। আজ তোর এই বাদলের কান্না-ভরা চিঠিটা পড়চি, সেই সঙ্গে তোর অনেকদিনের অনেক কথা আমার মনের দিঘিতে বুদবুদ কাটচে, আর তারই সাথে মনে হচ্চে তোর মনের মানুষের এতদিনে যেন অনেকটা নাগাল পেয়েছি। পল্লিমাঠের ‘ভুলনে ভূত’-এর মতো আর এ চতুর মনকে পথ ভুলোতে পারছিসনে, বলে রাখলাম। এইবার যেন বুঝতে পারচি, তোর পাষাণ বুকের ভেতর জ্বলচে লক্ষ আগ্নেয়গিরির অনন্ত বহ্নিশিখা ধুধুধু! তাকে আটকে রাখতে প্রয়াস পাচ্চে তোর ওই শক্তি অমানুষিক ধৈর্যের আবরণ। তোর হৃদয়-ভরা বেদনার রক্ত-ঢেউ পাঁজরের বাঁধ ভেঙে কণ্ঠের সীমা ছাপিয়ে উঠতে দিনের পর দিন উত্তাল বিদ্রোহ-তরঙ্গের সৃষ্টি করচে। তারই রুদ্র-কান্না হাসি হয়ে তোর রুক্ষ অধর-ওষ্ঠে আছাড় খাচ্চে, হাঃ হাঃ হাঃ! শুধু হাসি – কাঠচোটা হাসি! আর প্রতারণা করতে পারবিনে রে আমায়, আর তুই মিথ্যা দিয়ে আমায় বারে বারে ঠকাতে পারবিনে ; আজ আমার আপন বেদনা দিয়ে তোর হাসি-কান্নার সত্য উৎস আবিষ্কার করেছি। তোর ব্যথার এ অফুরন্ত উৎস চেনা-পথিকদের ছেয়ে ডুবিয়ে ফেলেছে ; তোর ওই বেদনা-রাগ-রঞ্জিত পরশমনির ছোঁয়া আমারও লৌহ-মর্মকে ব্যথা-কাঞ্চনের অরুণিমায় রাঙিয়ে তুলেছে! ওরে, তাই এ নিস্তব্ধ রাতে বিহ্বল-আমি একা-আমার আজ অন্তরের সত্য – মানবাত্মার সকল ভাবগুলি তোকে জানিয়ে বাঁচলাম। জানি এ চিঠিটা আমার হাত পেরিয়ে গেলেই হয়তো আমার সংকোচ আর অনুশোচনা জাগবে যে, তোকে এমন করে তোর দুর্বলতা সম্বন্ধে সজাগ করে দেওয়া বা চোরা-ব্যথায় অস্ত্র করা একেবারেই উচিত হয়নি। এ জেনেও আমার পত্র লেখার বলবতী ইচ্ছাকে রুখতে পারলাম না। কে জানে, আবার আমাদের নব মিলনের আনন্দ-ভৈরবী আর প্রভাতির কলমুখর রাগিণী কোনো প্রভাতে রনে উঠবে কিনা! আঃ, তার চিন্তাটাও কত ব্যথা-কাতর কান্নায় কান্নাময়। হায় ভাই, সেদিন কি আর আসবে?