কী আমায় মাতাল করে তুলচে আর সঙ্গে সঙ্গে যে কোন্ অনন্ত যুগের অফুরন্ত কান্না কণ্ঠ পর্যন্ত ফেনিয়ে উঠচে বিষের মতো – তীব্র হলাহলের মতো! – আর লেখার শক্তি নেই আমার! – ইতি।
নরপিশাচ –
নূরুল হুদা
বাঁধনহারা – পরিচ্ছেদ ০৫
[ঙ]
বাঁকুড়া
২রা ফেব্রুয়ারি
(নিশুত রাত্তির)
কবি-সৈনিক নূরু!
‘একচোখো; ‘এক-রোখো’ প্রভৃতি তোর দেওয়া ঝুড়ি ঝুড়ি বিশেষণ আমি আমার আঁতুড়-ঘর থেকে এই বিশ বছরের ‘যৈবন বয়েস’ নাগাদ বরাবর কুইনাইন-মিক্সচারের মতন গলাঃধকরণ করতে প্রাণপণে আপত্তি জানিয়েছি, কারণ সেসময় এসব অপবাদে জোর ‘চটিতং’ হয়ে মনে করতাম তোর স্বভাবই হচ্ছে লোকের সঙ্গে কর্কশ বেয়াদবি করা আর মুখের ওপর নির্মম প্রত্যুত্তর করা। অনেক সময় তোর ওই নির্ভীক সত্য ও স্পষ্টবাদিতা এবং ন্যায় ও আত্মসম্মানের গভীর অনুভূতিকে অহংকার অহমিকা প্রভৃতি বলেও মনে করেছি। বন্ধুমহলেও তোর ওই কথা নিয়ে অনেক সময় কুৎসা হয়েচে। কিন্তু আজ শোওয়ার আগে হঠাৎ তোর কথা মনে পড়ে গেল পাশের এক বালিকা-কণ্ঠে এই গানটা শুনে –
মনে রয়ে গেল মনের কথা,
শুধু চোখের জল প্রাণের ব্যথা।
আরও মনে পড়ল, এই গানটাই তোর মুখে হাজারবার শুনেছি এবং আজও কচি গলার সুরে তা শুনলাম, কিন্তু সেসময় তোর কণ্ঠে যে গভীর বেদনার আভাস ফুটে উঠত, জনম-জনম অতৃপ্ত থাকার ব্যথা-কান্না যে শিহরণ-ভরা মূর্ছনার সৃজন করত, তা এ বালিকার সরল কণ্ঠের সহজ সুরে পাই না। এই কথাটি মনে হতেই তোর সজল কাজল-আঁখির-আকুল-কামনা-ভরা চিঠিটা আর একবার পড়তে বড্ড ইচ্ছে হল। আজ এই নিশীথ রাতে তোর মেঘলা দিনের লেখা চিঠিটা পড়তে পড়তে ভাবছিলাম, চিঠিটা প্রথম দিন পেয়ে কেন এমন অভিভূত হইনি। সেদিন বুঝি চারিদিককার কোলাহলে তোর প্রাণের গভীর কথা আমায় তলিয়ে বুঝতে দেয়নি, শুধু ওতে যে মুক্ত হাসির স্বচ্ছ ধারাটুকু আছে, সেই ধারার কলোচ্ছ্বাসই আমার মন ভুলিয়েছিল। আজ যেন কোন্ গুণীর পরশে সহসা আমার দিব্যদৃষ্টি খুলে গিয়েছে আর তোর মর্মের মর্মস্থলেরও নিষ্করুণ চিত্র দেখতে পেয়েছি। তাই আজ বুঝেচি ভাই, এ কী অকরুণ নিরেট হাসি তোর! কান্না সওয়া যায়, কিন্তু বেদনাতুরের মুখে এই যে কুলিশ-কঠোর হিম হাসি, এ যে জমাট শক্ত অশ্রু-তুহিন! এ যে পাথরও সইতে পারে না। যার প্রাণে আছে, বেদনার অনুভূতি আছে, যে এমনি নীরব রাতে একা বসে কোনো স্নেহহারার এমনি নীরস শুষ্ক হাসি শুনেছে, সেই বোঝে এ হাসি কত দুর্বিষহ! তাই আজ তোর চিঠিটা পড়তে পড়তে বুকের ভেতর অনেক দূর পর্যন্ত তোলপাড় করে উঠতে লাগল!
একটি ছোট্ট প্রদীপ জ্বালিয়ে এই আঁধার বিভাবরীতে আমার সামনের বাতায়ন দিয়ে যতদূর দেখা যায় দেখতে চেষ্টা করচি আর ভাবচি – হায় তোর জীবনের রহস্যটা এই অন্ধকার-নিপীড়িত নিশীথের চেয়েও নিবিড় কৃষ্ণ পর্দায় আবৃত! সে বধির-যবনিকা চিরে তোর অন্তরের অনন্ত দিগ্মণ্ডলের সন্ধান নিতে যাচ্ছি আমার এই ঘরের প্রদীপটির মতোই ক্ষীণ কালো শিখা নিয়ে। তাই বুঝি অন্তরঙ্গ সখা হয়েও তোর ওই অথই মনের থই পেলাম না, অসীম হিয়ার সীমারেখা ধরি-ধরি করেও ধরতে পারলাম না। ও মন কেবলই আমাকে আকাশের মতো প্রতারিত করেছে; যখনই মনে করেছি – ওই ওইখানেই গাঙের পারে আকুল আকাশ আর উদাস মাঠে চুমোচুমি হয়েচে, তখনই আমি প্রতারিত হয়েছি। সেই মিলন-সীমায় পদাঙ্ক আঁকতে যতই ছুটে গিয়েচি, ততই সে দিকের শেষ দূরে – আরও দূরে সরে গিয়েছে। কোথায় এ বাঁধন-হারা দিগ্বলয় কার অসীম আকাশের মোহানা, তা কে জানে! আমরা নিয়তই বাঁধন-বাঁধার ডোর সৃজন করে ওই অসীমতাকে ধরবার চেষ্টা করছি, আর দুষ্ট চপল শশক-শিশুর মতো সে ততই এক অজানা বনের গহন-পথের পানে ছুটে চলেছে! সে দুরন্ত-শিশু নেমে আসে কখনও মাঠের ধারে গাঁয়ের পাশে, কখনও গাঙ পারিয়ে আমলকি-ছায়া-শীতল ঝরনা-তীরে, আবার কখনও শাল-পিয়াল আর পলাশবনের আলো-ছায়ায়। একটি পাতাঝরার শব্দ শুনেই সে চমকে উঠে অনেক দূরে গিয়ে তার চটুল চোখের নীল চাউনি ইশারায় ভ্রান্ত পথিককে ডাকতে থাকে। তোর নিরুদ্দিষ্ট উদাসীন মন অমনই সে-কোন্ এক আবছায়া ভরা অচিন অসীমের পানে যে ছুটেচে, তা তুইই জানিস ; তোর এই কান্ডারিহীন হিয়ার তরি যে কোন্ অকূলের কূল লক্ষ করে এমন খাপছাড়া পথে পাড়ি দিয়েছে, তা কোনো মাঝিই জানে না। আমি ভাবচি, হয়তো এ নিরুদ্দেশ যাত্রীর দুঃসাহসী ডিঙাখানি ওই দুই অসীমের মোহানাতেই গিয়ে জয়ধ্বনি করবে, না হয়, কোথাও ঘূর্ণি-আবর্তে পড়ে হঠাৎ ডুবে যাবে, নয়তো কোন্ চোরা পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ডিঙার বাঁধন ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যাবে! ভবিষ্যৎটা আমি নির্দয়ভাবেই কল্পনা করলাম, কারণ আমি জানি নির্মম সত্য তোর কাছে কোনোদিন অপ্রিয় লাগেনি, এবারেও আমার এসব বেহুদা কথায় রাগবিনে বা দুঃখ পাবিনে আশা করি।
তোর সজল কাজল-আঁখি প্রেয়সী যে কোন্ কোকাফ মুল্লুকের পরিজাদি, তাই ভেবে আমি আকুল হচ্চি। শ্রীমতী মাহ্বুবা খাতুনই সে সৌভাগ্যবতী কিনা, সে সম্বন্ধে এখনও আমি সন্দেহ-দোলায় দুলচি। তাহলে তুই আগে মত দিয়ে পরে বিয়ের কদিন আগে তাকে কেন এমন করে এড়িয়ে ত্যাগ করে গেলি? তোর এ এড়িয়ে-যাওয়ার দু রকম মানে হতে পারে; প্রথম, হয়তো তাকে ভালোবাসিসনি, – দ্বিতীয়, হয়তো তাকে মন দিয়ে ফেলেছিলি বলেই নিজের এই দুর্বলতা ধরা পড়ার ভয়ে এমন করে ভেসে গেলি। কোনটাতো সত্য? আমার বোধ হয়, দ্বিতীয় ঘটনাটাই ঘটা খুব সম্ভব আর স্বাভাবিক। তুই আমার এইসব মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ দেখে আমায় ঔপন্যাসিক ঠাউরাসনে যেন। সকলের পক্ষে যেটার অন্তরে উদয় হওয়া স্বাভাবিক, আমি কেবল সেইটাই যতটা প্রকাশ করা যায়, ভাষার বাঁধন দিয়ে আগলাবার চেষ্টা করচি। মাহ্বুবার অবস্থা আমি নিজে কিছু না দেখলেও বুবুজান যেরকম করে বলছিলেন, তাতে মর্মর দেউলেরও বুক ফেটে যাওয়ার কথা। অবশ্য তিনি সব কথা খুলে বলতে পারছিলেন না আমার কাছে ; কিন্তু ওই বাধো-বাধোভাবে কথাটা চাপতে গিয়েই সেটার গোপন তত্ত্ব যতটা প্রকাশ হয়ে পড়েছিল, তাতে আমি হলফ করে বলতে পারি যে, সে বেচারির নরম বুকে তোর ভালোবাসার ‘খেদং তির’ বড়ো গভীর করে বিঁধেচে! এ নিদারুণ শায়কের বিষ তার রক্তে রক্তে ছড়িয়ে পড়েচে! বুঝি সে অভাগির আর রক্ষে নেই। বুবুজানও এই ভেবে একরকম অস্থির হয়েই পড়েচেন। তাঁর ভয়ের আদত কারণ বোধ হয়, তিনি মনে করেন যে, মৌন বুকের এই বধির চাপা ভালোবাসার গভীরতা যেমন বেশি, মারাত্মকও তেমনই। এই গভীর বেদনাই তাকে হত্যা করে ছাড়বে। … এইসব নানান দিক দেখে আমার আর ইচ্ছে হয় না ভাই যে বিয়ে করি। আমার অন্তরঙ্গ সখার বুভুক্ষু আঁখির আগে আমি নিজের ভালোবাসার ক্ষুধা মেটাব, আর সে শুধু গোবিসাহারার তপ্ত বালুকায় দাঁড়িয়ে ছাতি-ফাটা পিয়াস নিয়ে তেষ্টায় বুক ফেটে মরবে, এমন স্বার্থপরের মতো ছোটো কথা ভাবতেও যে আমার জানটা ওলট-পালট করে ওঠে ভাই! তাই আমি আজ গোলাবি শরবতের পেয়ালা ওষ্ঠের কাছে ধরে ভাবছি, – তিয়াসা মিটাই, না এ পেয়ালা চূর্ণ করে তোর মতো অজানার পথে বেরিয়ে পড়ি। তুই এ পথা-হারা অন্ধকে পথ দেখিয়ে দিতে পারিস? ভেসে পড়ি তাহলে আল্লা বলে! কিন্তু বলে রাখি, জটিল জটাজূটধারী লোটা-কম্বল-সম্বল ‘কম্লি ওয়ালে’ সাজতে আমি পারব না। নাগা সন্ন্যাসীর মতো স্বার্থের বৈরাগ্য আমার মুক্তিপথ নয়। আমার মতো গো-মুখ্যুর কথা যদি শুনিস তাহলে আমি বলি কী, তোর গুরুদেবের উদাত্ত নির্ভীক বাণীতে তুইও যোগ দিয়ে প্রদীপ্ত কণ্ঠে বুক ফুলিয়ে বল; –