ভাবিজিও তোকে চিঠি দিলেন। দেখচি, এই দু-দিন ধরে তিনি আমায় দেখিয়ে দেখিয়ে লিখচেন। আমি তাঁকে তোর চিঠিটা দেখতে দিইনি কিনা এই হয়েচে তাঁর রাগ। কিছুতেই আমাকে তাঁর চিঠিটা দেখালেন না। না-ই দেখালেন, – আমার বয়েই গেল! আমার সঙ্গে ভাবিজির আড়ি! দেখি এইবার কে সেধে ভাব করতে আসে! আচ্ছা মাহ্বুবা, তুই আমায় ওঁর সব কথা লুকিয়ে জানিয়ে দিতে পারিস? তাহলে ওঁর সব গুমোর ফাঁক করে দিই আমি।
মাল্কার কথা লিখেছিস। ওকে আবার চিনতে পারব না। ক-বছরই বা আর সে আসেনি, এই বোধ হয় বছর পাঁচেক হল, না? আচ্ছা, মেয়েদের ওপর একী জুলুম? পাঁচ পাঁচটা বছর ধরে বাপের বাড়ি আসতে দেবে না, সামান্য একটু ঝগড়ার ছুতো নিয়ে। … যদি পারিস, তবে মাল্কাকে বলে এই মাগিকে দিয়ে আর একখানা চিঠি পাঠিয়ে দিস। তাহলে খুব ভালো হয়, কেননা ওই সঙ্গে ভাবিজির চিঠিটাও পাব।… আচ্ছা ভাই, এ মাগির নাম এলোকেশী রাখলে কে? এর যে আদতেই চুল নেই, তার আবার এলোকেশ হবে কী করে? যা দু-চারিটা আছে ঝাঁটিগাছের মতো এখনও মাথায় গজিয়ে, তাও আবার এলো জরা নয়, মাথার ওপর একটি ক্ষুদ্রাদপিক্ষুদ্র বড়ির মতো করে বাঁধা। আমার এত হাসি পাচ্চে! এ যেন যার ঘরে একটা ম্যাচ বাক্স নাই, তার নাম দেদার বাক্স্যা। দিনকানা ছেলের নাম নজর আলি!
তারপর, তোর ভয় নেই লো ভয় নেই! তোর কুলের কথা কাউকে বলে দিইনি। তবে, আমার খুব রাগ হয়েছিল প্রথমে, আর এত লজ্জাও হচ্চে তোর এইসব ছিষ্টিছাড়া কথা শুনে। – ছিঃ মা! তোমার গলায় দড়িও জোটে না? এক ঢাকুন জলে ডুবে মরতে পার না ধিঙ্গি বেহায়া ছুঁড়ি? আমি কাছে থাকলে তোর মুখ ঠেসে ধরতাম। থুবড়ো মেয়ের আবার মা হওয়ার সাধ! তাতে আবার যে সে মেয়ের নয়, ভাই-এর মেয়ের মা! আ-তোর গালে কালি! আয় তুই একবার পোড়ারমুখি হতভাগি, তার মজাটা ভালো করেই টের পাবি আমার কাছে!
পুরুষদের বিরুদ্ধে তোর যে মত, তাতে আমারও মতদ্বৈধ নেই॥ আমিও তোর বক্তিমেয় সায় দিচ্চি। উকিল-‘মুখ-তৈয়ার’-এর মতো তুই যেসব যুক্তিতর্ক এনেচিস তাতে আমার হাসিও পায় দুঃখও হয়, আবার রাগও হয়। কারণ, আমি নির্ভয়ে বলতে পারি, তোর এই মর্দানা হম্বিতম্বিতে কোনো পুরুষপুঙ্গবের কিছুমাত্র আসে যায় না, – এরকম কলিকালের মেয়েদের তারা থোড়াই কেয়ার করে। এর বিহিত ব্যবস্থা করতেও পারেন তাঁরা, তবে কিনা তাঁরা পৌরুষসম্পন্ন পুরুষ, তাই ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করতে চান না। যার গোঁফ আছে, তিনি তাতে চাড়া দিয়ে বলবেন, ‘কত কত গেল রতি, ইনি এলেন আবার চকরবতী!’ আর, আমিও বলি, দু-দিন পরে যে পুরুষসোপর্দ হবি তা বুঝি মনে নেই! পড়িস, খোদা করে, আচ্ছা এক কড়া হাকিমের হাতে, তাহলে দেখব লো তাঁর এজলাসে তুই কত নথনাড়া আর বক্তিমে দিতে পারিস। তখন উলটো এই অনধিকার চর্চার জন্যে তোর যা কিছু আছে, তার সব না বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়, দেখিস!…তোর মোকদ্দমা যে হঠাৎ একতরফা ডিগ্রী হয়ে গেল অর্থাৎ কিনা বিয়েটা মুলতুবি রয়ে গেল, তজ্জন্য আমি আন্তরিক দুঃখিত। ওঃ, তোর তরফের উকিল ভাবিজি সাহেবা কি তজ্জন্য কম লজ্জিত আর মর্মাহত? তাই তিনি এখন তাঁর জবর জবর কেতাব ঘেঁটে, মস্ত মস্ত আইন সংগ্রহ করে, অকাট্য যুক্তি-তর্ক প্রয়োগে পুনরায় আপিল রজু করেছেন (তোর বরের নামে!) আসামির নামে জোর তলব ওয়ারেন্ট বেরিয়েছে। তবে এখন দিন বাড়বে কিছুদিন, এই যা। তা হোক, মায় খরচা তুই ডিক্রি পাবি, এ আমার যথেষ্ট ভরসা আছে। তুই ইত্যবসরে একটা ক্ষতি-খেসারতের লিস্টি করে রাখিস, আমি না হয় পেশকার হয়ে সেটা পেশ করে দেব হুজুরে। তাই বলে ঘুষ নেওয়া ছাড়চিনে। কিছু উপুড়হাত না করলে, বুঝেছিস তো একেবারে মুলতুবি! ভালোই হল, এ মোকদ্দমাটা হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়ে একটু বৈচিত্র্য, একটা রগড়ও দেখা গেল! – তুই হয়তো অবাক হচ্চিস, আমি এত কথা শিখলাম কী করে। কী করি, না শিখলে যে নয়; – না-রে কাল সন্ধ্যেবেলায় ভাইজিতে আর ভাবিজিতে এই কথাগুলো হচ্চিল, আমি আড়াল থেকে শুনে সেগুলো খুব মনে করে রেখেছিলাম। এখন তোর চিঠিতে সেই কথাগুলোই মজা দেখতে লাগিয়ে দিলাম। কী মজা! … সে যাক, তুই এখন তৈরি হয়ে থাকিস। বুঝেছিস আমার এই ‘বীণা-পঞ্চমে বোল’? – দাঁড়া তো আসুক সে মজার দিন, তবে না তোর এ ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার গুড়ে বালি পড়বে? দেখব তখন, খালাজিও তোকে কী করে ধরে রাখেন। তখন হবি আমাদের ঘরের বউ, বুঝেচিস? আমার ওই বদরাগি খালাজিটিকে একবার খুব দু কথা শুনিয়ে দেব তখন। হেঁ, আমি ছাড়বার পাত্তর নই, যতই কেন মুখরা বলুন তিনি। তার পর, তোর গুপ্ত খবর – যা শেষ ছত্রে পুনশ্চে লিখেছিস, তার অনেকটা বোধ হয় আমার লেখায় জানতে পেরেছিস। নূরু ভাইজান নাকি বসরা যাবেন শিগগির, লিখেছেন। বাঙালি পলটন নাকি এইবার যুদ্ধে নামবে। তিনি লিখেচেন, কোনো ভয় নেই, তবু আমাদের প্রাণ মানবে কেন বোন? মা তো কেঁদে সারা। ভাইজান মন-মরা হয়ে পড়েছেন। ভাবিজি তো শুধু লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদচেন এ কদিন ধরে। আমার মনও কেমন এক রকম করে এক আধ সময়। তবু আমি বলতে চাই কী, আমার কিন্তু ওতে এতটুকু ভয় হয় না। পুরুষের তো কাজই ওই। আজকালকার পুরুষরা যা হয়েছেন তাতে ওদের জাতের ওপর ঘেন্না ধরিয়ে দিলে। ওদের হুবহু মেয়ে হওয়ার সাধ, – সাজ-সজ্জা ধরন-ধারণ সবেতেই! কাজেই শরীরটা হচ্চে আমাদেরই মতো ননীর ঢেলা, যাকে শুধু বিলাস-ব্যসনেই লাগানো যেতে পারে, কোনো শক্ত কাজে নয়; আর বাক্যবাগীশ এত হয়ে পড়েচেন যে, মেয়ের জাত মুখ গুটোতে বাধ্য হয়েছে। ছিঃ, বোন, এই কি পুরুষের কাজ? যে পুরুষের পৌরুষ নেই, তারা সত্যি সত্যিই গোঁফ কামিয়ে দেয় দেখে আর দুঃখ হয় না। আমাদের বাড়ির দারোয়ানটাকে গোঁফ কামানোর কথা বললে সে রাগে একেবারে দশ হাত লাফিয়ে ওঠে, কেননা ওদের আর কিছু নাই থাক, গায়ে পুরুষের শক্তি আছে; উলটো আমাদের দেশে গোঁফ রাখতে বললেই অনেকে ওইরকম লাফিয়ে উঠবেন, কেননা তাঁদের গায়ে মেয়েদের ঝাল আছে! এঁরাই আবার বাড়ির চৌহদ্দির ভিতরে মেয়েদের অন্দরমহলে সেঁধিয়ে যাত্রার দলের ভীমের চেয়েও জোরে লাফ-ঝাঁপ জুড়ে দেন! একেই বলে, ‘নির্গুণো সাপের কুলোপানা ফণা’। আমার কেন মনে হচ্ছে, নূরু ভাইজি আবার বেঁচে ফিরে আসবেন, আর তুই হবি তাঁর – আমার এই পুরুষ ভাই-এর – অঙ্কলক্ষ্মী। তুই হবি এক মহাপ্রাণ বিরাট পুরুষের সহধর্মিণী! আমার মনে এ জোর যে কে দিচ্চে তা বলতে পারিনে, তবে কথা কী, আমার মন তোদের মতো শুধু অলক্ষুণে কথাই ভাবে না। … এইখানে কিন্তু তোর সঙ্গে একটা মস্ত ঝগড়া আছে। বলি, হ্যাঁ লো মুখপুড়ি বাঁদরি! তোর আর বুদ্ধি হবে কখন? সে কী কবরে গিয়ে? দু-দিন বাদে যে নূরু ভাইজির সাথে তোর বিয়ে হবে, কোন্ লজ্জায় তুই তাঁর নাম নিস, আবার ভাইজি বলে লিখিস? ওরে আমার ভাই-এর দরদি বোনরে! দূর আবাগি হতচ্ছাড়ি, তুই একদম বেহায়া বেল্লিক হয়ে পড়েচিস!