তারপর ‘আনারকলি’র কথা বলি শোন! আমার এই ক্ষুদে ভাইঝিটিই হয়েছে আমার একমাত্র সাথি। তাছাড়া বাড়ির আর কারুর সঙ্গে বনে না আমার। গল্প করায় কিন্তু খুকি আমাকেও হার মানিয়েছে। এই কচি খুকিটি যেন একটা চঞ্চল ঝরনা। অনবরত ঝরঝর ঝরঝর বকেই চলেচে। আর, সে বকার না আছে মাথা, না আছে মুণ্ডু। এখন দায়ে পড়ে, ওর ওইসব হিজিবিজি কথাবার্তাই আমাকে অবলম্বন করতে হয়েচে আর ক্রমে ভালোও লাগচে। তুই চলে যাওয়ার পর সে ‘ফুপুদি দাবো, ফুপুদি দাবো’ বলে দিনকতক যেন মাথা খুঁড়ে মরেছিল, এখনও সময় সময় জিদ ধরে বসে। যখন ‘না, – ফুপুদি দাবো’ বলে এ খামখেয়ালি মেয়ে জিদ ধরে, তখন কার সাধ্যি যে থামায়। যত চুপ করতে বলব, তত সে চেঁচিয়ে-চিল্লিয়ে গড়াগড়ি দিয়ে ধুলো-কাদা মেখে একাকার করবে। বাড়িসুদ্ধ লোক মিলে তাকে থামাতে পারে না। কোনোদিন গল্প করতে করতে বা আবোল-তাবোল বকতে বকতে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে ঘাড়টি কাত করে বলে, ‘লাল ফুপু নেই – মলে দেছে!’ সঙ্গে সঙ্গে মুখটি তার এতটুকু, চুন হয়ে যায় আর একটি ছোট্ট নিশ্বাসও পড়ে, আমার জানটা তখন সাত পাক মোচড় দিয়ে ওঠে বোন! ভাবিজির চোখ দিয়ে তো টসটস করে জল গড়িয়ে পড়ে। আমি তাকে সেদিন যখন জানিয়ে দিলাম যে, তাঁর লাল ফুফু সাহেবা মামুবাড়ি সফর করতে গেছেন, তখন থেকে লাল ফুফুর আল্লাদি দরদি এই ভাইঝিটি হাততালি দিয়ে ঘুরে ঘুরে নাচে আর বলে, – ‘তাই তাই তাই, মামা-বালি দাই, মামিমাজি ভাত দিলে না দোরে হেদে পালাই!’ তোর চিঠিতে এই যে পেনসিলের দাগগুলো দেখচিস, এগুলো এই দুষ্টু মেয়েরই কাটা। আমি যখন চিঠি লিখতে বসি, তখন সে আমার ঘাড়ে চড়ে পিঠে কিল মেরে জোর আপত্তি করতে শুরু করে দিল, সে কিছুতেই আমায় চিঠি লিখতে দেবে না, এখন তাকে ছবি দেখাও। তারপর যেই বলা যে, এ চিঠি তাঁরই প্রিয় মাননীয়া লাল ফুফু সাহেবার, তখন সে ঝোঁক নিলে, ‘আমি তিথি লিথ্বো ফুপুদিকে!’ ভালো জ্বালা বুন, সে কী আর থামে! কী করি, নাচার হয়ে একটা ভোঁতা পেনসিল তার হাতে দিয়ে দুলালির মান রক্ষে করা গেল, না দিলে সে চিঠিটা ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দিত, যা মেয়ের রাগ! এই মেয়েটা কী পাকাবুড়ি বুন, তোর চিঠিটা হাতে করে সে মুখকে মালসার মতো গম্ভীর করে আধঘন্টাখানিক ধরে যা তা বকতে লাগল আর পেনসিলটা যেখানে সেখানে বুলিয়ে প্রমাণ করতে লাগল যে, সেও লেখা জানে! আমার তো আর হাসি থামে না। হাসলে আবার তিনি অপমান মনে করেন কিনা, কারণ তাঁর আত্মসম্মানবোধ এই বয়সেই ভয়ানক রকম চাগিয়ে উঠেচে, তাই তাঁর কাণ্ড দেখে হাসলে তিনি একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন। ঠোঁট ফুলিয়ে, কেঁদে কেটে খামচিয়ে কামড়িয়ে একেবারে তস-নস করে ফেলবেন! এই চিঠি লেখবার সময়ও ঠিক ওইরকম জোগাড় হয়েচিল, হয়তো আজকে আর এটা লেখাই হত না – ভাগ্যি সেই সময় আমাদের সেই বেঁড়ে বেড়ালিটা তার নাদুস-নুদুস বাচ্চা চারটে নিয়ে সপরিবারে আমার কামরায় দুর্গতিনাশিনীর মতো এসে হাজির হল, তাই রক্ষে। নইলে হয়েছিল আর কী! বেড়াল-ছানাগুলো দেখে খুকি একেবারে আত্মহারা হয়ে সব ছেড়ে তার পেছন পেছন দে ছুট। শ্রীমতী বিড়াল-গিন্নি সে সময়ের মতো সে স্থান থেকে অন্তর্ধান হওয়াই সমীচীন বোধ করলেন। খুকি বেড়াল বাচ্চাগুলোর কানে ধরে ধরে বুঝাতে চেষ্টা করে যে সে ওই বাচ্চা চতুষ্টয়ের মাসি-মা বা খালাজি। অবশ্য, বাচ্চাগুলো বা তাদের মা প্রকাশ্যে এর বিরুদ্ধে কিছু মত প্রকাশ করতে সাহস করেনি! উলটে, খুকি যখন তাদের কান ধরে ঝুলিয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘পুছু, আমি – আমি তোল কালাজি! না? বেচারি বেড়াল বাচ্চা তখন করুণ সুরে বলে ওঠে, ‘মিউ!’ অর্থাৎ না স্বীকার করে করি কী? এই গরিব বাচ্চাগুলির ওপর খুকির আমাদের যে মাসির মতোই নাড়ির টান টনটনে সে বিষয়ে আমার আর এই গরিব বেচারিদেরও ঘোর সন্দেহ আছে। মার্জার-পত্নী মহাশয়া তো সেটা স্বীকার করতে একদম নারাজ, – তবু সন্তান-বাৎসল্য অপেক্ষা যে লাঠির বাড়ির গুরুত্ব অনেক বেশি, তা বিড়ালির বিলক্ষণ জানা আছে, তাই তার বুবু সাহেবা অর্থাৎ কিনা আমাদের খুকুমণি সেখানে এলেই সে ভয়ে হোক নির্ভয়ে হোক – সে স্থান সত্বরই ত্যাগ করে! খুকুও তখন বাচ্চাগুলোকে টেনে হিঁচড়ে চাপড়িয়ে লেজ দুমড়ে, কান টেনে যেরকম নব নব আদর-আপ্যায়ন দেখায়, তা দেখে ‘মা মরে মাসি ঝুরে’ কথাটা একদম ভুয়ো বলে মনে হয়।… আমি বুন কিন্তু এসব দেখতে পারিনে। এইসব অনাছিষ্টি, বেড়ালছানা নিয়ে রাত্তির-দিন ঘাঁটাঘাঁটি, হতভাগা ছেলেপিলের যেন একটা উৎকট ব্যামো। এই বেড়ালছানাগুলোর গায়ে এত পোকা যে ছুঁতেই ঘেন্না করে, তাকে নিয়ে এই দুলালি মেয়ে সারাক্ষণই ঘাঁটবে নয়তো কোলে করে এনে বিছানায় তুলবে। সেদিন দেখি, – ছি, গাটা ঝাঁকরে উঠচে! – ওর গা বেয়ে বেয়ে ঝাঁকড়া চুলের ভিতর ঢুকচে কত বেড়াল-পোকা! ওর মা তো রাগের চোটে ওকে ধুমসিয়ে একাকার করে ফেললে! আমি শেষে সে কত কষ্টে গা ধুইয়ে চুল আঁচড়িয়ে পোকাগুলো বের করে দিলাম। আর এই হারামজাদা বেড়ালছানাগুলোও তেমনি, খুকিকে দেখলেই ওদের ঝুনঝির নাড়িতে টনক দিয়ে ওঠে, আর তাই লেজুড় খাড়া করে সকুরণ মিউ মিউ সুরে ওদের এই মানুষ খালাটির কাছে গিয়ে হাজির হবে। রাগে আর ঘেন্নায় আমার গা হেলফেলিয়ে ওঠে এইসব জুলুম দেখে! অন্য কেউ এসে এই বাচ্চাগুলোকে ছুঁতে গেলেই তখন গায়ের ‘রোঁয়া খাড়া করে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে, সামনের একটি পা চাটুর মতো করে তুলে এমন একটা ফোঁৎ ফোঁৎ শব্দ করতে থাকে যে, আমি তো হেসে লুটিয়ে পড়ি। বাচ্চাগুলোর চেহারা দেখেই তো একে হাসি পায়, তার ওপর এক মুঠো প্রাণীর এই এতবড়ো কেরদারি দেখে আরও হাসতে ইচ্ছা করে। দাঁড়া, আর দু-দিন দেখি, তারপর ঝাঁটা মেরে বিদেয় করব এসব আপদগুলোকে! … তোর শেখানো মতো খুকি এখন তার নাম বলতে শিখেচে, ‘আনান্কলি’!