তারপর, আমি চলে আসবার পর খুকি আমায় খুঁজেছিল কি? আমার কেবলই মনে হচ্চে, যেন খুকি খুব বায়না ধরেচে, মাথা কুটে হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদচে, আর তোরা কেউ এই দুলালি আবদেরে প্রাণীটির জিদ থামাতে পারচিসনে। আমায় দেখলেই কিন্তু কান্নার মুখে পূর্ণ এক ঝলক হাসি ফুটে উঠত এই মেয়ের মুখে, ঠিক ছিন্ন মেঘের ফাঁকে রোদ্দুরের মতো! কেন অমন হত জানিস? আমি মানুষ বশ করার ওষুধ জানি লো, ওষুধ জানি। বশ করতে জানলে অবাধ্য জানোয়ারকে বশ করাই সবচেয়ে সহজ!
আরও কত কথা মনে হচ্ছে, কিন্তু লিখে শেষ করতে পারচিনে। তাছাড়া, একটা কথা লিখবার সময় আর একটা কথার খেই হারিয়ে ফেলচি। মনের স্থৈর্যের দরকার এখানে। কিন্তু হায়, মন যে আমার ছটফটিয়ে মরচে! ঘুমুই গিয়ে এখন, ভোর হয়ে এল। কেউ কোথাও জাগেনি, কিন্তু একটা পাপিয়া ‘চোখ গেল, উহু চোখ গেল’, করে চেঁচিয়ে মরচে। কে তার এই কান্না শুনচে তার সে খবরও রাখে না।
খুব বড়ো চিঠি দিস যদি, তাহলে আমার মাথা খাস! বুঝলি?
তোর ‘কলমিলতা’-
মাহ্বুবা
পুনশ্চ –
নুরুল হুদা ভাইজির কোনো খবর পেয়েছিস কী? তিনি চিঠিতে কী সব কথা লেখেন? – মাহ্বুবা।
————–
সালার
১৩ইফাল্গুন
সই মাহ্বুবা!
এলোকেশী দূতীর মারফত তোর চিঠিটা পেয়ে যেন আমার মস্ত একটা বুকের বোঝা নেমে গেল। বাস্রে বাস্! এত বড়ো দস্যি মেয়ে তুই! কী করে এতদিন চুপ করে ছিলি? জানটা যেন আমার রাত-দিন আই-ঢাই করত। এখন আমার মনে হচ্চে যেন আসমানের চাঁদ হাতে পেলাম। যেদিন চিঠিটা পাই, সেদিনকার রগড়টা শোন আগে। তারপর সব কথা বলচি! – পরশু বিকেলে তোর ওই বিন্দে দূতী মহাশয়া যখন আমাদের বাড়ির দোরে শুভ পদার্পণ করচেন, তখন দেখি, এক পাল দুষ্টু ছেলে তার পিছু নিয়েচে আর সুর-বেসুরের আওয়াজে চিৎকার করচে, ‘আকাশে সরষে ফোটে, গোদা ঠ্যাং লাফিয়ে ওঠে!’ আর বাস্তবিকই তাই – ছেলেদেরই বা দোষ কী! বুড়ির পায়ে যে সাংঘাতিক রকমের দুটি গোদ, তা দেখে আমারই আর হাসি থামে না। আমার সবচেয়ে আশ্চর্য লাগল যে, আল্বোর্জ-পাহাড়-ধ্বংসী রুস্তমের গোর্জের মতো এই মস্ত ঠ্যাং দুটো বয়ে এই মান্ধাতার আমলের পুরানো বুড়ি এত দূর এল কী করে! ভাগ্যিস বোন, ভাইজি তখন দলিজে বসে এসরাজটা নিয়ে ক্যাঁ কোঁ করছিলেন, নইলে এসব পাখোয়াজ ছেলেরা বুড়িকে নিশ্চয়ই সেদিন ‘কীচকবধ’ করে দিত। মাগি রাস্তা চলে যত না হয়রান হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি পেরেশান হয়েছিল ওই ছ্যাঁচড় ছেলে-মেয়ের দঙ্গলকে সপ্তস্বরে পূর্ণ বিক্রমে গালাগালি করাতে আর ধূলা-বালি ছুঁড়ে তাদের জব্দ করবার বৃথা চেষ্টায়। ঘরে এসে যখন সে বেচারি ঢুকল, তখন তার মুখ দিয়ে ফেনা উঠচে, ভিজে ঢাকের মতো গলা বসে গেছে! ভাবিজি তাড়াতাড়ি তাকে শরবত করে দেন, মাথায় ঠান্ডা পানি ঢেলে তেল দিয়ে পাখা করে দেন, তবে তখন বেচারির ধড়ে জান আসে! ওর সে সময়কার অবস্থা দেখে আমার এত মায়া হতে লাগল! কিন্তু কী করি, আমি তো আর বেরোতে পারিনে ভাই, কেউ আর আমায় অচেনা লোকের কাছে বের হতে দেয় না। ভাইজান বলেন বটে, কিন্তু তাঁর কথা কেউ মানে না। ও নিয়ে আমি কত কেঁদেছি, ঝগড়া করেছি ওঁদের কাছে। লোকে আমায় দেখলে বোধ হয় আমার ‘উচকপালি’ ‘চিরুনদাঁতি’র কথা প্রকাশ হয়ে পড়বে! না? যাক, – আমি প্রথমে তো তাকে দেখে জানতে পারিনি যে, সে তোদের শাহপুর থেকে আসচে। পরে ভাবিজির কাছে শুনলাম যে, সে তোদের ওখান থেকে জবরদস্ত একখানা চিঠি নিয়ে এসেচে। ভাবিজি প্রথমে তো কিছুতেই চিঠি দিতে চান না, অনেক কাড়াকাড়ি করে না পেরে শেষে যখন জানলাটায় খুব জোরে জোরে মাথা ঠুকতে লাগলাম আর ভাইজান এসে ওঁকে খুব এক চোট বকুনি দিয়ে গেলেন, তখন উনি রেগে চিঠিটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন আমার দিকে। আমার তখন খুশি দেখে কে! রাগলেনই বা, ওঃ উনি রাগলে আমার বয়েই গেল আর কী! তাই বলে আমার চিঠি ওইসব বেহায়া ধাড়িকে পড়তে দিই, – আবদার! এইসব কলহ-কেজিয়া করতেই সাঁঝ হয়ে এল। তাড়াতাড়ি বাতি জ্বালিয়ে দোর বন্ধ করে তোর চিঠিটা পড়তে লাগলাম। প্রথম খানিকটা পড়ে আর পড়তে পারলাম না। আমারও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না আসছিল। আচ্ছা ভাই ‘কলমিলতা’! তুই মনে ভাবচিস হয়তো যে, আমি এখানে খুবই সুখে আছি। তা নয় সই, তা নয়। তোকে ছেড়ে আমার দিনগুলো যে কীরকম করে কাটচে, তা যদি তুই জানতিস, তাহলে এত দুঃখেও তোর আমার জন্যে কষ্ট হত। আমি যে তোদের ওই শূন্যপুরী ঘরটার দিকে তাকালেই কেঁদে ফেলি বোন! আমাদের ঘরের সব কিছুতেই যে তোর ছোঁয়া এখনও লেগে রয়েছে। তাই মনে হয়, এখানের সকল জিনিসই তোকে হারিয়ে একটা মস্ত শূন্যতা বুকে নিয়ে হা-হা করে কাঁদচে। সেই সঙ্গে আমারও যে বুক ফেটে যাওয়ার জো হয়েছে! – পোড়া কপাল তোর! মামার বাড়িতেও এই হেনস্থা, অবহেলা! যখন যার কপাল পোড়ে, তখন এমনই হয়। তোর পোড়ারমুখি আবাগি মামানিদের কথা শুনে রাগে আমার গা গিসগিস করচে! ইচ্ছে হয়, এই জাতের হিংসুটে মেয়েগুলোর চুল ধরে খুব কষে শ-খানিক দুমাদ্দম কিল বসিয়ে দিই পিঠে, তবে মনের ঝাল মেটে! জানি, ও দেশের মেয়েরা ওইরকম কোঁদুলে হয়। দেখেছিস তো, ও পাড়ার শেখদের বউ দুটো? বাপরে বাপ, ওরা যেন চিলের সঙ্গে উড়ে ঝগড়া করে! মেয়ে তো নয়, যেন কাহারবা! তোদের কথা শুনে মা, ভাবিজি, ভাইজান কত আপশোশ করতে লাগলেন। তোদের উঠে যাওয়ার সময় মা এত করে বুঝালেন তোর মাকে, তা খালাজি কিছুতেই বুঝলেন না। কেন বোন, এও তো তাঁরই বাড়ি! মা-জান সেদিন তোদের কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন, আর কত আর্মান করতে লাগলেন যে, আমি তো তাদের নিজের করতে চাইলাম, আর জানতামও চিরদিন নিজের বলেই, তা তারা আমাদের এ দাবির তো খাতির রাখলে না। মাহ্বুবাকে তো নিজের বেটিই মনে করতাম, তা ওর মা ওকেও আমার বুক থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল! কী করি, জোর তো নেই!…এই রকম আরও কত আক্ষেপের কথা! এখানে ফিরে আসবার জন্যে মাও ফের চিঠি দেবেন খালাজিকে, আজ ওই নিয়ে ভাইজানের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তোর পায়ে পড়ি ভাই, তুই যেন কোনো ল্যাঠা লাগাসনে আর ওরই সাথে। বরং খালাজিকে বুঝিয়ে বলিস, যাতে তিনি থির হয়ে সব কথা ভালো করে বুঝে দেখেন। সত্যি করে বলচি ভাই, তোকে ছেড়ে থাকলে আমি একদম মরে যাব। এই কদিনেই আমার চেহারা কীরকম শুকিয়ে গেচে, তা যদি আসিস, তখন নিজে দেখবি। ভাইজান বলছিলেন, তিনি নিজেই যাবেন পালকি নিয়ে তোদের আনতে। তাই আমার কাল থেকে এত আনন্দ হচ্চে, সে আর কী বলব! এখন, এ-কদিন ধরে যে তোর জন্যে খুবই কান্নাকাটি করেছিলাম, তা মনে হয়ে আমার বড্ড লজ্জা পাচ্চে। সত্যি সত্যিই, ভাবিজি যে বলেন, আমার মতো ধাড়ি মেয়ের এত ছেলেমানুষি আর কাঁদাকাটা বেজায় বাড়াবাড়ি, তাতে কোনোও ভুল নেই। এখন তুই ফিরে আয় তো, তারপর দেখব। তোর ওই এক পিঠ চুলগুলো ধরে এবার আর রোজ রোজ বেঁধে দিচ্ছিনে, মনে থাকে যেন। থাকবি রাত্তির দিন ওই সেই বই-এ পড়া কপালকুণ্ডলার মতো এলো চুলে। তুই যাওয়ার পর থেকে গল্প করতে না পেয়ে জানটা যেন হাঁপিয়ে উঠচে আমার। মর পোড়াকপালিরা, কেউ যদি গল্প করতে চায়! সারাক্ষণই ছাই-পাঁশ কাজ নিয়ে ব্যস্ত। মাগো মা ! এই রকম গুম হয়ে বসে থাকলে তো আমার মতন লোকের আর বাঁচাই হয় না দুনিয়ার। মা তো আর ওসব ছেলেমানুষি ভালোবাসেন না! ভাবিজিও যত সব ছাই-ভস্ম রাজ্যের বই আর মাসিক পত্রিকার গাদায় ডুবে থাকেন। নিজে তো মরেছেন, আবার আমাকেও ওইরকম হতে বলেন। কথা শুনে আমার গা পিতপিতিয়ে ওঠে! পড়বি বাপু তো এক আধ সময় পড়, দিনের একটু আধটু কাজের ফাঁকে, তা না হয়ে রাত্তির জেগে বই পড়া! অমন বই-পড়ার মুখে নুড়োর আগুন জ্বালিয়ে দিই আমি। আমার তো ভাই দুটো গল্প পড়বার পরই যেন ছটফটানি আসে, মাথা ধরবার জোগাড় হয়। তার চেয়ে বসে বসে দু-ঘন্টা গল্প করব যে কাজে আসবে! এই কথাটি বললেই আমাদের মুরুব্বি ভাবিটি হেসেই উড়িয়ে দেন। তারপর, বুঝেছিস রে, আমাদের এই ভাবিজি আবার কবিতা গল্প লিখতে শুরু করে দিয়েচেন রাত্রি জেগে। আমি সেদিন হঠাৎ তাঁর একটা ওইরকম খাতা আবিষ্কার করেছি। ওসব ছাই-ভস্ম কিছুই বুঝতে পারা যায় না, শুধু হেঁয়ালি। তবে, আমাদের খুকিকে নিয়ে যেসব কবিতাগুলো লেখা, সেগুলো আমার খুব ভালো লেগেচে। এখন দেখছি, এই লোকটিকে রীতিমতো আদব করে চলতে হবে।