আমার এইসব যা-তা বাজে বকুনির মধ্যে বোধ হয় আমার বক্তব্যের মূল সূত্রটা ধরতে পেরেছিস। দিন-রাত্তির মনটা আমার খালি উড়ু উড়ু করচে, অথচ মনের এ ভাব-গতিকের রীতিমতো কারণও খুঁজে পাচ্চিনে। এমন একটা সময় আসে, যখন মনটা ভয়ানক অস্থির হয়ে ওঠে – অথচ কেন যে অমন হয়, কীসের জন্যে তার সে ব্যথিত ছটফটানি, তা প্রকাশ করা তো দূরের কথা, নিজেই ভালো করে বুঝে উঠা যায় না! সে বেদনার কোথায় যেন তল, কোথায় যেন তার সীমা! অবশ্য রেশ কাঁপচে তার মনে, কিন্তু সে কোন্ চিরব্যথার অচিন-বন পারিয়ে আসচে এ রেশ, আর কোন্ অনন্ত আদিম বিরহীর বীণের বেদনে ঝংকার পেয়ে? হায়, তা কেউ জানে না! অনুভব করবে কিন্তু প্রকাশ করতে পারবে না!…আমার এরকম মন খারাপ হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েচে বলবে তুমি, কিন্তু ভাই, আমি যে কোনো লোকের মাথায় হাত দিয়ে বলতে পারি যে, সেসব মামুলি ব্যথা-বেদনার জন্যে অন্তরে এমন দরদ আসতেই পারে না। এ যেন কেমন একটা মিশ্র বেদনা গোছের; জানের আনচান ভাব, মরমের নিজস্ব মর্মব্যথা যা মনেরও অনেকটা অগোচর। একটা কথা আমি বলতে পারি; – যিনি যতই মানব চরিত্রের ঘুণ হন, তিনি নিশ্চয়ই নিজের মনকে পুরোপুরিভাবে বুঝতে পারেন না। স্রষ্টার এইখানেই মস্ত সৃজন-রহস্য ছাপানো রয়েচে। আর এ আমাদের মনের চিরন্তন দুর্বলতা, – একে এড়িয়ে চলা যায় না!…আহ্! আহ্!! দাঁড়া বোন, – আবার আমার বুকে সে-কোন্ আমার চির-পরিচিত সাথির তাড়িয়ে দেওয়া চপল-চরণের ছেঁড়া-স্মৃতি মনের বনে খাপছাড়া মেঘের মতো ভেসে উঠচে! সে কোন্ অজানার কান্না আমার মরমে আর্ত প্রতিধ্বনি তুলচে! দাঁড়া ভাই, একটু পানি খেয়ে ঠান্ডা হয়ে তবে লিখব! কেন হয় ভাই এমন? কেন বুকভরা অতৃপ্তির বিপুল কান্না আমার মাঝে এমন করে গুমরে ওঠে? কেন? – আঃ, খোদা!
বাহা রে! চিঠিটা শেষ না করেই দেখচি দিব্যি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম! …
হাঁ, – এখন, ভাবিজিকে বলিস, যেন ও মাসের আর এ মাসের সমস্ত মাসিক পত্রিকাগুলো এরই হাতে পাঠিয়ে দেন। ভুললে চলবে না। আর, তাঁকে বলবি, যেন আমায় মনে করে চিঠি দেন। সকলকে চিঠি লিখবার সময় কই, আর সুবিধাই বা কোথা। নইলে সকলকে আলাদা আলাদা চিঠি দিতাম। তুই ওঁদের সব কথা বুঝিয়ে বলবি, যেন কেউ অভিমান না করেন। আমি কাউকে ভুলিনি। সবাই যেন আমায় চিঠি দেন কিন্তু – হেঁ! আমার মতন তাঁদের তো এরকম জিন্দান-কুঁয়ায় পড়ে থাকতে হয়নি! কাজেই কারুর আর কোনো ওজর শুনচিনে। ভাবিজি, ভাইজি, মা, সবাই আমায় আর মনে করেন কি? – তারপর, এসব তো হল, এখনও যে আদত মানুষটিই বাকি! আমার পিয়ারের খুকুমণি ‘আনারকলি’ কেমন আছে? এখানে কোনো ছেলেমেয়ে দেখলেই আমার খুকুরানির কথা মনে হয়। সঙ্গে সঙ্গে চোখও ছলছল করে ওঠে! আমার এই দুর্বলতায় আমার নিজের কত লজ্জা পায়। কারণ তোরা হয়তো মনে করবি এ একটা বাড়াবাড়ি। ওই এক টুকরো ছোট্ট মেয়েটাকে আমি যে কত ভালোবেসেছি, তা তোরা বুঝবি কী ছাই-পাঁশ? কথায় বলে, ‘বাঁজায় জানে ছেলের বেদন!’ অবিশ্যি আমিও যদিচ এখনও তোদেরই মতো ন্যাড়া বোঁচা, কিন্তু আমার মন তো আর বাঁজা নয়! এরই মধ্যে তোর গোলাবি গাল হয়তো শরমে লাল হয়ে গেছে! কিন্তু রোসো, আরও শোন! মনে কর, আমি যদি বলি যে, আমার নিজের একটা মেয়ে থাকলে আমি ভাবিজির সঙ্গে অদল-বদল করতাম,তাহলে তুই বিশ্বাস করিস? দাঁড়া,এখনই ধেই ধেই করে খেমটাওয়ালিদের মতো নেচে দিসনে যেন রাগের মাথায়; আরও একটু শুনে যা – সত্যি বলতে কি সোফি, আমারও একটি ওইরকম ছোট্ট আনারকলির মা হতে বড্ড সাধ হয়! কথাটি নিশ্চয়ই তোর মতন চুলবুলে ‘লাজের মামুদ’-এর কাছে কাঁচা ছুঁড়ির মুখে পাকা বুড়ির কথার মতো বেজায় বেখাপ্পা শুনাল, না? বুঝবি লো, তুইও বুঝবি দু-দিন বাদে আমার এই কথাটি! এখন শরমে তোর চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠচে, গোস্বায় তোর পাতলা রাঙা ঠোঁট ফুলে ফুলে কাঁপচে (আহা, ঠিক আমের কচি কিশলয়ের মতো!) কিন্তু এই গায়েবি খবর দিয়ে রাখলাম, এ গরিবের কথা বাসি হলে ফলবেই ফলবে! মেয়েদের যে মা হওয়ার কত বেশি শখ আর সাধ, তা মিথ্যা না বললে কেউ অস্বীকার করবে না! কী একটা ভালো বইয়ে পড়েছিলাম যে, আমাদেরই মা আমাদের মধ্যে বেঁচে রয়েচেন! তলিয়ে বুঝে দেখলে কথাটা সুন্দর সত্যি আর স্বাভাবিক বোধ হয়। – হাঁ, কিন্তু দেখিস ভাই লক্ষ্মীটি, তোর পায়ে পড়চি, ভাবিজিকে এসব কথা জানতে দিসনে যেন। শ্রীমতী রাবেয়া যার নাম, তিনি যে এসব কথা শুনলে আমায় সহজে ছেড়ে দেবেন, তা জিবরাইল এসে বললেও আমি বিশ্বাস করব না। একে তো দুষ্টু বুদ্ধিতে তিনি অজেয়, তার ওপর একাধারে তিনি আমার গুরু বা ওস্তাদ আর ভাবিজি সাহেবা! (সেই সঙ্গে রামের সুগ্রীব সহায়ের মতো তুমিও পিছনে ঠেলা দিতে কি কসুর করবে?) নানাদিক দিয়ে দেখে আমি চাই যে, আমার সবকিছু যেন চিচিং-ফাঁক না হয়ে যায়! কেননা এ হচ্চে স্রেফ তোতে-আমাতে দু-সই-এ গোপন কথা। এখানে বাজে লোকের প্রবেশ নিষেধ।
এতটা বেহায়াপনা করে সাত কালের বুড়ি মাগির মতো এত কথা এমন করে খুলে কী করে লিখতে পারলাম দেখে হয়তো তুই ‘আই – আই – গালে কালি মা!’ ইত্যাদি অবাক-বিস্ময়ের বাণী উচ্চারণ করচিস; কিন্তু লিখতে বসে দেখবি যে, মেয়েতে-মেয়েতে (তার ওপর আবার তারা তোর আমার মতো সই হলে আর দূর দেশে থাকলে তো কথাই নেই!) যত মন খুলে সব কথা অসংকোচে বলতে বা লিখতে পারে, অমনটি কেউ আর পারে না। পুরুষরা মনে করে, তাদের বন্ধুতে-বন্ধুতে বসে যত খোলা কথা হয়, অমন বোধ হয় আমাদের মধ্যে হয় না; কিন্তু তারা যদি একদিন লুকিয়ে মেয়েদের মজলিসে হাজিরা দিতে পারে, তাহলে তারা হয়তো সেইখানেই মেয়েদের পায়ে গড় করে আসবে। ওসব কথা এখন যেতে দে, কিন্তু আমি ভাই সত্যি সত্যি মনের চোখে দেখচি, তুই এতক্ষণ লাফিয়ে-চিল্লিয়ে তোর সেই বাঁধা বুলিটা আওড়াচ্চিস, ‘মাহ্বুবাকে বই পড়িয়ে পড়িয়ে ভাবিজি একদম লজঝড় করে তুলেচেন!’ আর সেই সঙ্গে আমার দুঃখও হচ্চে এই ভেবে যে, তুই এখন আর কাকে আঁচড়াবি কামড়াবি? পোড়াকপাল, বরও জুটল না এখনও যে, বেশ এক হাত হাতাহাতি খামচা-খামচি লড়াইটা দেখেও একটু আমোদ পাই! আল্লারে আল্লাহ্! আমাদের এই তথাকথিত শরিফের ঘরে শুধু ঝুড়ি-ঝুড়ি থুবড়ো ধাড়ি মেয়ে! বর যে কোথা থেকে আসবে তার কিন্তু ঠিক-ঠিকানা নেই!…