আর শুধু পুরুষদেরই বা বলি কেন, আমাদের মেয়েজাতটাও নেহাত ছোটো হয়ে গেছে, এদের মন আবার আরও হাজার কেসেমের বেখাপ্পা বেয়াড়া আচার-বিচারে ভরা, যার কোনো মাথাও নেই, মুণ্ডুও নেই! এই ধর না এই বাড়িরই কথা। ভয়ানক অন্যায় আর অত্যাচার যেটা, চির-অভ্যাস মতো সেটার বিরুদ্ধে একটু উচ্চবাচ্য করতে গেলেই অমনি গুষ্টিসুদ্ধ মেয়ে দঙ্গল আমার ওপর ‘মারমূর্তি’ হয়ে উঠবে আর গলা ফেড়ে চেঁচিয়ে ফেনিয়ে ফেনিয়ে বলবে, – “মাগো মা, মেয়ে নয় যেন সিংগিচড়া ধিঙ্গি! এ যে জাঁদরেল জাহাঁবাজ মরদের কাঁধে চড়ে যায় মা! আমরা তো দেখে আসচি, সাত চড়ে থুবড়ো মেয়ের রা বেরোয় না, আর আজকালকার এই কলিকালের কচি ছুঁড়িগুলো – যাদের মুখ টিপলে এখনও দুধ বেরোয়, তাদের কিনা সবতাতেই মোড়লি সাওকুড়ি আবার মুখের ওপর চোপা! মুখ ধরে পুঁয়ে মাছের মতো রগড়ে দিতে হয়, তবে না থোঁতা মুখ ভোঁতা হয়ে যায়! আমাদেরও বয়েস ছিল গো, আজ নয়তো বুড়ি হয়েছি, কই বলুক তো, কে বাপের বেটি আছে, – ছায়াটি পর্যন্ত দেখতে পেয়েছে! তাতে আর কাজ নেই! একটু জোরে কাশলেও যেন শরমে শরমে মরে যেতাম, আর এখনকার ‘খলিফা’ মেয়েদের কথায় কথায় ফোঁপরদালালি, – যেন, অজবুড়ি! যত বড়ো মুখ নয় তত বড়ো কথা!”…সময় কাটবে বলে ভাবিজির কাছ হতে দু-চারটে বই আর মাসিকপত্র সঙ্গে এনেচি, এই না দেখে এরা তো আর বাঁচে না! গালে হাত দিয়ে কতরকমেরই না অঙ্গভঙ্গি করে জানায় যে, রোজকেয়ামত এইবারে একদম নিকটে! একটু পড়তে বসলে চারিদিক থেকে ছেলেমেয়ে বুড়িরা সব উঁকি মেরে দেখবে আর ফিসফিস করে কত কী যে বলবে তার ইয়ত্তা নেই। আমি নাকি আমার বিদ্যে জাহির করতে তাদের দেখিয়ে বই পড়ি, তাই তারা রটনা করেচে যে, আমি দু-দিন বাদে মাথায় পাগড়ি বেঁধে কাছা মেরে জজ ম্যাজিস্টর হয়ে য়্যা চেয়ারে বসব গিয়ে! আমি তো এদের বলবার ধরন দেখে আর হেসে বাঁচিনে! মেয়েদের চিঠি লেখা শুনলে তো এরা যেন আকাশ থেকে পড়ে! মাত্র নাকি এই কলিকাল, এরা বেঁচে থাকলে কালে আরও কত কী তাজ্জব ব্যাপার চাক্ষুষ দেখবেন! তবে এঁরা যে আর বেশিদিন বাঁচবেন না, এই একটা মস্ত সান্ত্বনার কথা! আমাদের এই ধিঙ্গি মেমগুলোই নাকি এদের জাতের ওপর ঘেন্না ধরিয়ে দিলে; এইসব ভেবে ভেবে ওদের রাত্তির বেলায় ভালো করে নিদ হয় না, আর তারই জন্যে তাদের অনেকেরই চোখে ‘গোগাল’ পড়ে গেছে!…এই রকম সব অফুরন্ত মজার কথা – যেসব লিখতে গেলে আর একটা ‘গাজি মিয়াঁর বস্তানি’ না মধু মিয়াঁর দফতর হয়ে যাবে! তবু এতগুলো কথা তোকে জানিয়ে আমি আমার মনটা অনেক হালকা করে নিলাম। আমার শুধু ইচ্ছে করচে, তোর সঙ্গে বসে তিনদিন ধরে এদের আরো কত কী মজার গল্প নিয়ে আলোচনা করি, তবে আমার সাধ মেটে! তাই যা মনে আসচে, যতক্ষণ পারি লিখে যাই তো! কেননা, জানি না আবার কখন কতদিন পরে এঁদের চক্ষু এড়িয়ে তোকে চিঠি লিখতে পারব। এখনও মনের মাঝে আমার লাখো কথা জমে রইল। ডাকে চিঠি দিলাম না, তাহলে তো লঙ্কাকাণ্ড বেধে যেত! তাই এই পত্রবাহিকা এলোকেশী বাগদির মারফতেই খুব চুপি চুপি চিঠিটা পাঠালাম। আমাদের গাঁয়ের ও পাড়ার মালকা বিবিকে মনে আছে তোর? ইনি সেই ‘পাড়া-কুঁদুলি মালকা’ যিনি পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে মেয়েদের সাথে ছেলেবেলায় কোঁদল করে বেড়াতেন। আমার এক মামাতো ভাইয়ের সাথে এঁর বিয়ে হয়েচে, তুই তো সব জানিস। এঁর ভাইয়ের নাকি বড্ড ব্যামো, তাই এলোকেশী ঝিকে খবর নিতে পাঠাচ্ছেন। তাঁকে বলেই এই চিঠিটা এমন লুকিয়ে পাঠাতে পারলাম! মালকা প্রায়ই আমার কাছে এসে অনেকক্ষণ ধরে গল্প করে, আমিও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। বেচারি এখন বড্ড শায়েস্তা হয়ে গেচে। তার মস্ত বড়ো সংসারের মস্ত ভার ওই বেচারির একা ঘাড়ে। …চিঠিটা যত বড়োই হোক না কেন, আমি আজ আমার জমানো সব কথা জানিয়ে তবে ছাড়ব। দশ ফর্দ চিঠি দেখে হাসিসনে, বা ফেলে দিসনে যেন। এই চিঠি লিখতে বসে আর লিখে কী যে আরাম পাচ্চি, সে আর কী বলব! আমার মনের চক্ষে এখন তোর মূর্তিটি ঠিক ঠিক ভেসে উঠচে।
সত্যি বলতে কী ভাই, – রাত্তির-দিন এই দাঁত-খিঁচুনি আর চিবিয়ে চিবিয়ে গঞ্জনা দেখে শুনে এই সোজা লোকগুলোর ওপর বিরক্তি আসে বটে, তবে ঘেন্না ধরেনি। এদের দেখে মানুষের দয়া হওয়াই উচিত! এর জন্য দায়ী কে? – পুরুষরাই তো আমাদের মধ্যে এইসব সংকীর্ণতা ও গোঁড়ামি ঢুকিয়ে দিয়েচেন। এমন কেউ কি নেই আমাদের ভেতর যিনি এইসব পুরুষদের বুঝিয়ে দেবেন যে, আমরা অসূর্যম্পশ্যা বা হেরেম-জেলের বন্দিনী হলেও নিতান্ত চোর-দায়ে ধরা পড়িনি। অন্তত পর্দার ভিতরেও একটু নড়ে চড়ে বেড়াবার দখল হতে খারিজ হয়ে যাইনি। আমাদেরও শরীর-রক্ত-মাংসে গড়া; আমাদের অনুভবশক্তি, প্রাণ, আত্মা সব আছে। আর তা বিলকুল ভোঁতা হয়ে যায়নি। আজকাল অনেক যুবকই নাকি উচ্চশিক্ষা পাচ্চেন, কিন্তু আমি একে উচ্চ শিক্ষা না বলে লেখাপড়া শিখচেন বলাই বেশি সঙ্গত মনে করি। কেননা, এঁরা যত শিক্ষিত হচ্ছেন, ততই যেন আমাদের দিকে অবজ্ঞার হেকারতের দৃষ্টিতে দেখচেন, আমাদের মেয়ে জাতের ওপর দিন দিন তাঁদের রোখ চড়েই যাচ্চে। তাঁরা মহিষের মতো গোঙানি আরম্ভ করে দিলেও কোনো কসুর হয় না, কিন্তু দৈবাৎ যদি আমাদের আওয়াজটা একটু বেমোলায়েম হয়ে অন্তঃপুরের প্রাচীন ডিঙিয়ে পড়ে, তাহলে তাঁরা প্রচণ্ড হুংকারে আমাদের চৌদ্দ পুরুষের উদ্ধার করেন। ওঁদের যে সাত খুন মাফ! হায়! কে বলে দেবে এঁদের যে, আমাদেরও স্বাধীনভাবে দুটো কথা বলবার ইচ্ছে হয় আর অধিকারও আছে, আমরাও ভালমন্দ বিচার করতে পারি। অবশ্য, অন্যান্য দেশের মেয়ে বা মেমসাহেবদের মতো মর্দানা লেবাস পরে ঘোড়ার সওয়ার হয়ে বেড়াতে চাই নে বা হাজার হাজার লোকের মাঝে দাঁড়িয়ে গলাবাজিও করতে রাজি নই, আমরা চাই আমাদের এই তোমাদের গড়া খাঁচার মধ্যেই একটু সোয়াস্তির সঙ্গে বেড়াতে চেড়াতে ; যা নিতান্ত অন্যায়, যা তোমরা শুধু খামখেয়ালির বশবর্তী হয়ে করে থাক সেইগুলো থেকে রেহাই পেতে! এতে তোমাদের দাড়ি হাসবে না বা মান-ইজ্জতও খোওয়া যাবে না, আর সেই সঙ্গে আমরাও একটু মুক্ত নিশ্বাস ছেড়ে বাঁচব, রাত্তির দিন নানান আগুনে সিদ্ধ আমাদের হাড়ে একটু বাতাস লাগবে! তোমরা যে খাঁচায় পুরেও সন্তুষ্ট নও, তার ওপর আবার পায়ে হাতে গলায় শৃঙ্খল বেঁধে রেখেচ, টুঁটি টিপে ধরেচ, – থামাও, এ সব জুলুম থামাও! তোমরা একটু উদার হও, একটু মহত্ত্ব দেখাও, – এতদিনকার এইসব একচোখা অত্যাচারের, সংকীর্ণতার খেসারতে এই এক বিন্দু স্বাধীনতা দাও, – দেখবে আমরাই আবার তোমাদের নতুন শক্তি দেব, নতুন করে গড়ে তুলব। দেশ-কাল-পাত্রভেদে, যেটুকু দরকার, আমরা কেবল তাই-ই চাইছি, তার অধিক আমরা চাইবই বা কেন আর চাইলেই তোমরা দেবে কেন?…যাক বোন, আমাদের এসব কথা নিয়ে, অধিকার নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে শেষে কি ‘আয়রে বাঘ – না গলায় লাগ’-এর মতো কোনো সমাজপতির এজলাসে পেশ হব গিয়ে, অতএব এইখানেই এসব অবান্তর কথায় ধামাচাপা দিলাম।