হাঁ, মামার বাড়ির সকলে যেই জানতে পেরেচে যে, আমরা খাস-দখল নিয়ে তাঁদের বাড়ি উড়ে এসে জুড়ে বসার মতো জড় গেদে বসেছি, অমনি তাঁদের আদর আপ্যায়নের তোড় দস্তুরমতো ঠান্ডা হয়ে গেছে! এটাও স্বাভাবিক। নতুন পাওয়ার আনন্দটা, নতুন পাওয়ার জিনিসের আদর তত বেশি নিবিড় হয়, সেটা যত কম সময়ের জন্য স্থায়ী হয়। কারণ, নতুন ও হঠাৎ-পাওয়া আনন্দেরও একটা পরিমাণ আছে, আর সেই পরিমাণের তীব্রতাটা জিনিসের স্থিতির কালানুযায়ী কম-বেশি হয়ে থাকে। যেটার স্থিতিকাল মাত্র একদিন, সে ওই আনন্দের সমগ্র তীব্রতা ও উষ্ণতা একদিনেই পায়। যেটা দশদিন স্থায়ী, সে ওই সমগ্র আনন্দটা দশদিনে একটু একটু করে পায়। আমি এখন এই কথাটার সত্যতা হাড়ে হাড়ে বুঝচি। কারণ, অন্য সময় যখন এখানে এসেচি, তখন এই বাড়ির সকলে উন্মুক্ত হয়ে থাকত কীসে আমাদের খুশি রাখবে, দিন-রাত ধরে এত বেশি আদর-সোহাগ ঠেসে দিত যে, তার কোথাও এতটুকু ফাঁক থাকবার জো ছিল না। তাই তখন মামার বাড়ির নাম শুনলে আনন্দে নেচে উঠতাম। এখানে এসে দু-দিন পরে এখানটা ছেড়ে যেতেও কত কষ্ট হত! মামানি, নানি, মামু, খালাদের কোল থেকে নামতে পেতাম না। গায়ে একটু আঁচড় লাগলে অন্তত বিশ গন্ডা মুখে জোর সহানুভূতির ‘আহারে! ছেলে খুন হয়ে গেল!’ ইত্যাদি কথা উচ্চারণ হত! তাই বলে মনে করিসনে যেন যে, আজও আমি তেমনি করে কোলে চড়ে বেড়াবার জন্যে উসখুস করচি, এখন আমি আর সে কচি খুকি নই। এখানকার মেয়েমহলের মতে – একটা মস্ত থুবড়ো ধাড়ি মেয়ে! এই রকম কত যে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সইতে হয় দিনের মাথায়, তার আর সংখ্যা নেই। আর, যেখানকার পৌনে ষোলো আনা লোকের মুখে-চোখে একটা স্পষ্ট চাপা বিরক্তির ছাপ নানান কথায় কাজের ভেতর দিয়ে প্রকাশ পায়, সেখানে নিজেকে কতটুকু ছোটো করে রাখতে হয়, জানটা কীরকম হাঁপিয়ে ওঠে সেখানে, ভাব দেখি! এই উপেক্ষার রাজভোগের চেয়ে যে ঘরের মাড়ভাত ভালো বোন! মামুজিরা আমায় খুবই স্নেহ করেন, কিন্তু তাঁরা তো দিন-রাত্তির ঘরের কোণে বসে থাকেন না যে সব কথা শুনবেন। আমার তিনটি মামানি তিন কেসেমের! তার ওপর আবার এক এক জনের চাল এক এক রকমের। কেউ যান ছার্তকে, কেউ যান কদমে, কেউ যান দুলকি চালে। কথায় কথায় টিপ্পনী, কিন্তু মামুজিদের ঘরে দেখলেই আমাদের প্রতি তাঁদের নাড়ির টান ভয়ানক রকমের বেড়ে ওঠে, আমাদের পোড়া কপালের সমবেদনায় পেঁয়াজ কাটতে কাটতে বা উনুনে কাঁচা কাঠ দিয়ে অঝোর নয়নে কাঁদেন! মামুজিরা বাইরে গেলেই আবার মনের ঝাল ঝেড়ে পূর্বের ব্যবহারের সুদসুদ্ধ আদায় করে নেন। আমি তো ভাই ভয়েই শশব্যস্ত। তাঁদের এক একটা চাউনিতে যেন আমার এক এক চুম্বন রক্ত শুকিয়ে যায় । দু-এক সময় মনে হয়, আর বরদাস্ত করতে পারিনে, সকল কথা খুলে বলি মামুজিদের, তারপর আমাদের সেই ভাঙা কুঁড়েতেই ফিরে যাই। কিন্তু এতটুকু টুঁ শব্দ করলেই অমনি রং-বেরঙের গলায় মিঠেকড়া প্রতিবাদ ঝংকার দিয়ে ওঠে। ঘরের আণ্ডাবাচ্চা মায় বাড়ির ঝি পুঁটি বাগদি পর্যন্ত তখন আমার ওপর টীকা-টিপ্পনীর বাণ বর্ষণ করতে আরম্ভ করেন। এঁদের সর্ববাদীসম্মত মত এই যে, থুবড়ো আইবুড়ো মেয়ের সাত চড়ে রা বেরোবে না, কায়াটি তো নয়ই, ছায়াটি পর্যন্ত কেউ দেখতে পাবে না, গলার আওয়াজ টেলিফোন যন্ত্রের মতো হবে, কেবল যাকে বলবে সেই শুনতে পাবে, – বাস্! খুব একটা বুড়োটে ধরনের মিচকেমারা গম্ভীর হয়ে পড়তে হবে, থুবড়ো মেয়ে দাঁত বের করে হাসলে নাকি কাপাস মহার্ঘ হয়! কোনো অলংকার তো নয়ই, কোনো ভালো জিনিসও ব্যবহার করতে বা ছুঁতেও পাবে না, তাহলে যে বিয়ের সময় একদম ‘ছিরি’ (শ্রী) উঠবে না। ঘরের নিভৃততম কোণে ন্যাড়া বোঁচা জড়-পুঁটুলি ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে চুপসে বসে থাক! – এই রকম সে কত কথা ভাই, ওসব বারো ‘ভজকট’ আমার ছাই মনেও থাকে না আর শুনতে শুনতে কানও ভোঁতা হয়ে গেছে। ‘কান করেচি ঢোল, কত বলবি বোল!’ তাছাড়া একথা অন্যকে বলেই বা কী হবে? কেই বা শুনবে আর কারই বা মাথা ব্যথা হয়েচে আমাদের পোড়াকপালিদের কথা শুনতে! খোদা আমাদের মেয়ে জাতটাকে দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতেই পাঠিয়েছেন, আমাদের হাত-পা যেন পিঠমোড়া করে বাঁধা, নিজে কিছু বলবার বা কইবার হুকুম নেই। খোদা-না-খাস্তা একটু ঠোঁট নড়লেই মহাভারত অশুদ্ধ আর কী! কাজেই, আছে আমাদের শুধু অদৃষ্টবাদ, সব দোষ চাপাই নন্দ-ঘোষস্বরূপ অদৃষ্টেরই ওপর! সেই মান্ধাতার আমলের পুরোনো মামুলি কথা, কিন্তু অদৃষ্ট বেচারা নিজেই আজতক অ-দৃষ্ট! … আমাদের কর্ণধার মর্দরা কর্ণ ধরে যা করান তাই করি, যা বলান তাই বলি! আমাদের নিজের ইচ্ছায় করবার বা ভাববার মতো কিছুই যেন পয়দা হয়নি দুনিয়ায় এখনও – কারণ আমরা যে খালি রক্ত-মাংসের পিণ্ড! ভাত রেঁধে, ছেলে মানুষ করে আর পুরুষ দেবতাদের শ্রীচরণ সেবা করেই আমাদের কর্তব্যের দৌড় খতম! বাবা আদমের কাল থেকে ইস্তকনাগাদ নাকি আমরা ওই দাসীবৃত্তিই করে আসচি, কারণ হজরত আদমের বাম পায়ের হাড্ডি হতে প্রথম মেয়ের উৎপত্তি। বাপরে বাপ! আজ সেই কথা টলবে? এসব কথা মুখে আনলেও নাকি জিভ খসে পড়ে। কোন্ কেতাবে নাকি লেখা আছে, পুরুষদের পায়ের নীচে বেহেশ্ত, আর সেসব কেতাব ও আইন-কানুনের রচয়িতা পুরুষ!…দুনিয়ার কোনো ধর্মই আমাদের মতো নারীজাতিকে এতটা শ্রদ্ধা দেখায়নি, এত উচ্চ আসনও দেয়নি, কিন্তু এদেশের দেখাদেখি আমাদের রীতি-নীতিও ভয়ানক সংকীর্ণতা আর গোঁড়ামি ভণ্ডামিতে ভরে উঠেচে। হাতে কলমে না করে শুধু শাস্ত্রের দোহাই পাড়লেই কি সব হয়ে গেল?