তুই হয়তো আমার এসব ‘পাকামো’ ‘বুড়োমি’ শুনে ঝংকার দিয়ে উঠবি, “মাগো মা! এত কথাও আসে এই পনেরো ষোলো বছরের ছুঁড়ির! যেন সাতকালের বুড়ি আর কি!” কিন্তু ভাই, যাদের ছেলেবেলা হতেই দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দিয়ে মানুষ হতে হয়, যাদের জন্ম হতেই টাল খেয়ে খেয়ে, চোট খেয়ে খেয়ে বড়ো হতে হয়, তারা এই বয়সেই এতটা বেশি গম্ভীর আর ভাবপ্রবণ হয়ে ওঠে যে, অনেকের চোখে সেটা একটা অস্বাভাবিক রকমের বাড়াবাড়ি বলেই দেখায়। অতএব যে জিনিসটা জীবনের ভেতর দিয়ে, নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে অনুভব করিসনি, সেটাকে সমালোচনা করতে যাস নে যেন। যাক ওসব কথা। …
মা তাঁর বাপের বাড়ি বলে এখানে এসে এখন নতুন নতুন বেশ খুশিতেই আছেন। আমি জানি, তাঁর এ হাসি-খুশি বেশিদিন টিকবে না। তবুও কিছু বলতে ইচ্ছে হয় না। আমার মনে সুখ নেই বলে অন্যকেও কেন তার ভাগী করব? তাছাড়া চির-দুঃখিনী মা আমার যদি তাঁর শোকসন্তপ্ত প্রাণে এই একটুখানি পাওয়া সান্ত্বনার স্নিগ্ধ প্রলেপ শুধু একটুক্ষণের জন্যেও পান, তবে তাঁর, মেয়ে হয়ে কোন্ প্রাণে তাঁকে সে আনন্দ হতে বঞ্চিত করব? এ-ভুল তো দু-দিন পরে ভাঙবেই আপনি হতে! – আর এক কথা, মায়ের খুশি হবার অধিকার আছে এখানে, কেননা এটা তাঁর বাপের বাড়ি। আর তারই উলটো কারণে হয়েচে আমার মনে কষ্ট। অবশ্য আমিও নতুন জায়গায় (তাতে মামার বাড়ি) আসার ক্ষণিক আনন্দ প্রথম দু-একদিন অন্তরে অনুভব করেছিলাম, কিন্তু ক্রমেই এখন সে আনন্দের তীব্রতা কর্পূরের উবে যাওয়ার মতো বড়ো সত্বরই উবে যাচ্ছে। হোক না মামার বাড়ি, তাই বলে যে সেখানে বাবার বাড়ির মতো দাবি-দাওয়া চলবে, এ তো হতে পারে না। মানি, মামার বাড়ি ছেলেমেয়েদের খুবই প্রিয় আর লোভনীয় স্থান, কিন্তু যদি স্রেফ দু-চার দিনের মেহ্মান হয়ে শুভ পদার্পণ হয় সেখানে। যাঁরা মামার বাড়িতে স্থায়ী বন্দোবস্ত করে বা একটু বেশিদিনের জন্যে থেকেচেন, তাঁরাই একথার সারবত্তা বুঝতে পারবেন। অতিথিস্বরূপ দু-একদিন থেকে যাওয়াই সঙ্গত কুটুম বাড়িতে। আমি এখানে অতিথি মানে বুঝি যাঁদের স্থিতি বড়ো জোর এক তিথির বেশি হয় না। যিনি অতিথির এই বাক্যগত অর্থের প্রতি সম্মান না রেখে শার্দুলের লুব্ধা মাতৃষ্বসার মতো আর নড়তেই চান না, তিনি তো স-তিথি। আর, তাঁর ভাগ্যে সম্মানও ওই বাঘের মাসি বিড়ালের মতো চাটু আর হাতার বাড়ি, চেলাকাঠের ধুমসুনী! এঁরাই আবার অর্ধচন্দ্র পেয়ে চৌকাঠের বাইরে এসে, আদর-আপ্যায়নের ত্রুটি দেখিয়ে বেইজ্জতির অজুহাতে চক্ষু দুটো উষ্ণ কটাহের মতো গরম করে গৃহস্বামীর ছোটোলোকত্বের কথা তারস্বরে যুক্তিপ্রমাণসহ দেখাতে থাকেন আর সঙ্গে সঙ্গে ইজ্জতের কান্নাও কাঁদেন। আহা! লজ্জা করে না এসব বেহায়াদের? এ যেন ‘চুরি কে চুরি উলটো সিনাজুরি!’ থাক এসব পরের ‘গিল্লে’ -চর্চা, এখন বুঝলি, মেয়েদের এই ‘ধান-ভানতে শিবের গীত’ – এক কথা বলতে গিয়ে আরও সাত কথার অবতারণা করা আর গেল না। কথায় বলে ‘খস্লৎ যায় মলে।’ – আমি বলছিলাম যে, আমার মতো চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে কেউ যদি মামাদের ঘাড়ে ভর করে এসে বসে, তবে সেখানে সে বেচারির আবদার তো চলেই না, স্নেহ-আদরের ও দাবি-দাওয়ার একটা সপ্রতিভ অসংকোচ আর্জিও পেশ করা যায় না। একটা বিষম সংকোচ, অপ্রতিভ হওয়ার ভয়, সেখানে কালো মেঘের মতো এসে দাঁড়াবেই দাঁড়াবে। যার ভেতরে এতটুকু আত্মসম্মান-জ্ঞান আছে, সে কখনই এরকমভাবে ছোটো আর অপমানিত হতে যাবে না। ওই কী বলে না, ‘আপনার ঢিপেয় কুকুর রাজা।’ কুকুরের স্বভাব হচ্ছে এই যে, যত বড়োই শত্রু হোক আর পেছন দিকে হাঁটবার সময় নেজুড় যতই কেন নিভৃততম স্থানে সংলগ্ন করুক, যদি একবার যো-সো করে নিজের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, তবে আর যায় কোথা! আরে বাপরে বাপ! অমনি তখন তার বুক সাহসের চোটে দশ হাত ফুলে ওঠে। তাই তখন সে তার নেজুড় যতদূর সম্ভব খাড়া করে আমাদের মর্দ বাঙালি পুরুষ-পুঙ্গবদেরই মতো তারস্বরে শত্রুকে যুদ্ধে আহ্বান করতে থাকে, কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও অবশ্যস্বীকার্য যে, এমন বীরত্ব দেখাবার সময়ও অন্তত অর্ধেক শরীর তার দোরের ভিতর দিকেই থাকে আর ঘনঘন দেখতে থাকে যে, তাড়া করলে ‘খেঁচে হাওয়া’ দেওয়ার মতো লাইন ক্লিয়ার আছে কিনা। এই সারমেয় গোষ্ঠীর মতো আমাদের দেশের পুরুষদেরও এখন দুটি মাত্র অস্ত্র আছে, সে হচ্ছে ষাঁড় বিনিন্দিত কণ্ঠের গগনভেদী চিৎকার আর মূল্য-বিনিন্দিত বড়ো বড়ো দন্তের পূর্ণ বিকাশ আর খিঁচুনি! তাই আমরা আজও মাত্র দুই জায়গায় বাঙালির বীরত্বের চরম বিকাশ দেখতে পাই; এক হচ্চে, যখন এঁরা যাত্রার দলে ভীম সাজেন, আর দুই হচ্চে, যখন এঁরা অন্দরমহলে এসে স্ত্রীকে ধুমসুনি দেন। হাঁ-হাঁ, আর এক জায়গায়, – যখন এঁরা মাইকেলি ছন্দ আওড়ান!… আর এঁরা এসব যে করতে পারেন, তার একমাত্র কারণ, তাঁদের সে সময় মস্ত একটা সান্ত্বনা থাকে যে, যতই করি না কেন, এ হচ্চে ‘হামারা আপনা ঘর!’
এইখানে আর একটা কথা বলে রাখি ভাই! আমার চিঠিতে এই যে কর্কশ নির্মম রসিকতা নীরসতা আর হৃদয়হীন শ্লেষের ছাপ রয়েচে, এর জন্যে আমায় গালাগালি করিসনে যেন। আমার মন এখন বড়ো তিক্ত – বড়ো নীরস –শুষ্ক। সেই সঙ্গে অব্যক্ত একটা ব্যথায় জান শুধু ছটফট করচে। আর কাজেই আমার অন্তরের সেই নীরস তিক্ত ভাবটার ও হৃদয়হীন ব্যথার ছটফটানির ছোপ আমার লেখাতে ফুটে উঠবেই উঠবে। – যতই চেষ্টা করি না কেন, সেটাকে কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারব না। এরকম সকলের পক্ষেই স্বাভাবিক। এই দ্যাখ না, আমার মনে যখন যে ভাব আসচে বিনা দ্বিধায় অনবরত লিখে চলেচি, – কোথাও সংযম নেই, বাঁধন নেই, শৃঙ্খলা – ‘সিজিল’ কিচ্ছু নেই, – মন এতই অস্থির, মন এখন আমার এতই গোলমাল! –