সোফিয়াকে সেদিন তোমায় চিঠি দেওয়ার জন্যে বলতে গিয়ে তো অপ্রতিভের শেষ হতে হয়েছে আমায়! আমার প্রস্তাবটা শুনে যে নাক সিঁটকিয়ে – একটা বিচিত্র রকমের অঙ্গভঙ্গি করে – মুখের সামনে মেম-সাহেবদের মতো চার-পাঁচ পাক ফর-ফর করে ঘুরে – দুই হাত নানান ভঙ্গিতে আমার নাকের সামনে নাচিয়ে একেবারে মুখ ভেঙচিয়ে চেঁচিয়ে উঠল – ‘আমার এত দায় কাঁদেনি –গরজ পড়েনি লোককে খোশামুদি করে চিঠি দিবার!’ আমি তো একেবারে ‘থ’! কথাটা কী জানো? – সে বড্ড বেশি অভিমানী কিনা, তাই এতটুকুতেই রেগে ট্যাসকণার মতো ‘ট্যাঁ ট্যাঁ’ করে ওঠে। তুমি সবাইকে চিঠি দিয়েছ আর তাকেই দাওনি, এবং নাকি নেহায়েৎ বেহায়াপনা করে তার ভাইকে তার বিয়ে না ছাই-পাঁশ সম্বন্ধে কী লিখেছ, এই হয়েছে তার আসল রাগের কারণ। তুমি এখানে থাকলে হয়তো সে রীতিমতো একটা কোঁদল পাকিয়ে বসত, কিন্তু তার কোনো সম্ভাবনা নেই দেখেই সে ভিতরে ভিতরে রাগে এমন গস্ গস্ করছে। এ সকলের সঙ্গে তার আরও কৈফিয়ত এই যে, তার হাতের লেখা নাকি এতই বিশ্রী এবং বিদ্যাবুদ্ধি এতই কম যে, তোমার মতো পণ্ডিতাগ্রগণ্য ধুরন্ধর ব্যক্তির নিকট তা নিয়ে উপহাসাস্পদ হতে সে নিতান্তই নারাজ! এসব তো আছেই, অধিকন্তু তার মেজাজটাও নাকি আজকাল বহাল খোশ-তবিয়তে নেই – অবশ্য আমার মতো ছেঁদো, ছোটো, বেহায়া লোকের কাছে কৈফিয়ত দিলে তার আত্ম-সম্মানে ঘা লাগবে বলে সে মনে করে! য়্যা আল্লাহ্! – কী আর করি ভাই! নাচার!! আমি ভালো করেই জানি যে, এর ওপর আর একটি কথা বললেই লঙ্কাকাণ্ড বেধে যাবে; আমার চুল ছিঁড়ে, নুচে, খামচিয়ে, কামড়িয়ে গায়ে থুথু দিয়ে আমাকে এমন জব্দ আর বিব্রত করে ফেলবে যে তাতে আমি কেন, পাথরের মূর্তিরও বিচলিত হওয়ার কথা!
বাপরে বাপ! যে জবরদস্ত জালিম জাহাঁবাজ মেয়ে! – আমার তো ভয় হচ্ছে, মনু ওকে সামলাতে পারলে হয়।
অনেক লেখা হল। মেয়েদের এই বেশি বকা, বেশি লেখা প্রভৃতি কতকগুলো বাহুল্য জিনিস স্বয়ং ব্রহ্মাও নিরাকরণ করতে পারবেন না। আমরা মেয়েমানুষ সব যেন কলের জল বা জলের কল! একবার খুলে দিলেই হল!
যাক, যা হওয়ার ছিল, হয়েছে। এখন খোদা তোমায় বিজয়ী বীরের বেশে ফিরিয়ে আনুন, এই আমাদের দিন-রাত্তির খোদার কাছে মুনাজাত। যে মহাপ্রাণ, অদম্য উৎসাহ আর অসম সাহসিকতা নিয়ে তরুণ যুবা তোমরা সবুজ বুকের তাজা খুন দিয়ে বীরের মতো স্বদেশের মঙ্গল সাধন করতে, দুর্নাম দূর করতে ছুটে গিয়েছ, তা হেরেমের পুরস্ত্রী হলেও আমাদের মতো অনেক শিক্ষিতা ভগিনীই বোঝেন, তাই আজ অনেক অপরিচিতার অশ্রু তোমাদের জন্যে ঝরছে। এটা মনে রেখো যে, পৌরুষ আর বীরত্ব সব দেশেরই মেয়েদের মস্ত প্রশংসার জিনিষ, সৌন্দর্যের চেয়ে পুরুষের ওই গুণটিই আমাদের বেশি আকর্ষণ করে! – অন্ধ স্নেহ-মমতা বড়ো কষ্ট দিলেও দেশমাতার ভৈরব আহ্বানে তাঁর পবিত্র বেদির সামনে এই যে তুমি হাসতে হাসতে তোমার কাঁচা, আশা-আকাঙ্ক্ষাময় প্রাণটি নিয়ে এগিয়ে গিয়েছ, এ গৌরব রাখবার ঠাঁই যে আমাদের ছোটো বুকে পাচ্চিনে ভাই! আজ আমাদের এক চক্ষু দিয়ে অশ্রুজল আর অন্য চক্ষু দিয়ে গৌরবের ভাস্বর জ্যোতি নির্গত হচ্চে!
খোদার ‘রহম’ ঢাল হয়ে তোমায় সকল বিপদ-আপদ হতে রক্ষা করুক, এই আমার প্রাণের শেষ শ্রেষ্ঠ আশিস।
এখন আসি ভাই। খুকি ঘুম থেকে উঠে কাঁদচে! – শিগগির উত্তর দিয়। ইতি –
তোমার শুভাকাঙ্ক্ষিণী ‘ভাবি’
রাবেয়া
শাহ্পুর
বাঁধনহারা – পরিচ্ছেদ ০৪
[ঘ]
১০ই ফাল্গুন
(নিঝুম রাত্তির)
ভাই সোফি!
অভিমানিনী, তুমি হয়তো এতদিনে আমার ওপর রাগ করে ভুরু কুঁচকে, ঠোঁট ফুলিয়ে, গুম হয়ে বসে আছ! কারণ আমি আসবার দিনে তোমার মাথা ছুঁয়ে দিব্যি করেছিলাম যে গিয়েই চিঠি দেব। আমার এত বড়ো একটা চুক্তির কথা আমি ভুলিনি ভাই, কিন্তু নানান কারণে, বারো জঞ্জালে পড়ে আমায় এরকমভাবে খেলো হয়ে পড়তে হল তোমার কাছে। সোজাভাবেই সব কথা বলি – এখানে পৌঁছেই বোন, আমার যত কিছু যেন ওলট পালট হয়ে গেছে, কী এক-বুক অসোয়াস্তি যেন বেরোবার পথ না পেয়ে শুধু আমার বুক-জোড়া পাঁজরের প্রাচীরে ঘা দিয়ে বেড়াচ্চে। কদিন থেকে মাথাটা বোঁ-বোঁ করে ঘুরচে আর মনে হচ্চে, সেই সঙ্গে যেন দুনিয়ার যতকিছু আমার দিকে তাকিয়ে কেমন এক রকম কান্না কাঁদচে, আর সেই অকরুণ কান্নার যতির মাঝে মাঝে একটা নির্মম জিনের কাঠ-চোটা বিকট হাসি উঠচে হো – হো – হো! সামনে তার নিঝুম গোরস্থানের মতো ‘সুম-সাম’ হয়ে পড়ে রয়েচে আমাদের পোড়ো-বাড়িটা। তারই জীর্ণ দেয়ালে অন্ধকারের চেয়েও কালো একটা দাঁড়কাক বীভৎস গলাভাঙা স্বরে কাতরাচ্চে, ‘খাঁ – আঃ! – আঃ!’ দুপুর রোদ্দুরকে ব্যথিয়ে ব্যথিয়ে তারই পাশের বাজ-পড়া অশথ গাছটায় একটা ঘুঘু করুণ-কণ্ঠে কূজন কান্না কাঁদচে, ‘এসো খুকু – উ – উ- উঃ!’ বাদলের জুলুমে আমাদের অনেক দিনের অনেক স্মৃতি-বিজড়িত মাটির ঘরটা গলে গলে পড়চে, – দেখতে দেখতে সেটা একটা নিবিড় জঙ্গলে পরিণত হয়ে গেল – চারিধারে তার তেশিরে কাঁটা, মাঝে চিড়চিড়ে, আকন্দ, বোয়ান এবং আরো কত কী কাঁটাগুল্মের ঝোপ-ঝাড়ু তাদের আশ্রয় করে ঘর বেঁধেচে বিছে, কেউটে সাপ, শিয়াল, খটাস, – ওঃ, আমার মাথা ঘুরচে, আর ভাবতে পারচিনে!… যখন মাথাটা বড্ড দপ দপ করতে থাকে আর তারই সঙ্গে এই বীরভূমের একচেটে করে-নেওয়া ‘মেলেরে’ জ্বর (ম্যালেরিয়ার আমি এই বাংলা নাম দিচ্চি!) হু-হু করে আসে, তখন ঠিক এই রকমের সব হাজার এলোমেলো বিশ্রী চিন্তা ছায়াচিত্রের মতো একটার পর একটা মনের ওপর দিয়ে চলে যায়! আজ তাই ভাই সোফিয়া রে! বড়ো দুঃখেই বাবাজিকে মনে করে শুধু কাঁদচি – আর কাঁদচি! খোদা যদি অমন করে, তাঁকে আমাদের মস্ত দুর্দিনের দিনে ওপারে ডেকে না নিতেন, তা হলে কি আজ আমাদের এমন করে বাপ-দাদার ভিটে ছেড়ে পরের গলগ্রহ হয়ে ‘অন্হেলা’র ভাত গিলতে হত বোন? আজ এই নিশীথ-রাতে স্তব্ধ মৌন-প্রকৃতির বুকে একা জেগে আমি তাই খোদাকে জিজ্ঞাসা করচি – নিঃসহায় বিহগ-শাবকের ছোট্ট নীড়খানি দুরন্ত বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে তাঁর কী লাভ? ‘পাক’ তিনি, তবে একী পৈশাচিক আনন্দ রয়েচে তাঁহাতে? হায় বোন, কে বলে দেবে সে কথা?