আমি বললাম, ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করা অর্থহীন। পদার্থবিদরা বলা শুরু করেছেন। আজ কাল এবং পরশু আসলে একই সময়। নাস্তা কি খাবেন বলুন। আপনার নাস্তার ব্যবস্থা করি। গরম পরোটা কলিজা ভুনা খাবেন? থানার আশে পাশে ভাল রেস্টুরেন্ট থাকে, হাজতিরা ভাল খেতে পছন্দ করে।
আলম বলল, আপনার সঙ্গে টাকা আছে?
আছে।
এক প্যাকেট সিগারেট আনায়ে দেন। সিগারেটই খাব ৷
ব্যবস্থা করছি। হাজতে এই প্রথম?
জি।
আনন্দে সময় কাটানোর ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। সামনে যে দেয়ালটা দেখছেন মনে করুন। এটা একটা ২৯ ইঞ্চি কালার টিভি। টিভিতে বাংলাদেশ নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট খেলা দেখাচ্ছে। আরাম করে খেলা দেখুন।
ভাই সাহেব এই সব কি বলেন। আপনার তো মাথায় সমস্যা আছে।
সমস্যা আমাদের সবার মাথায় আছে। যাই হোক দেয়ালে টিভি দেখার চেষ্টা চালিয়ে যান। মনোসংযোগ করুন। আপনি পারবেন। আমি এর মধ্যে নাস্তা আর সিগারেটের ব্যবস্থা করছি।
আলম মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, আজ কাল এবং পরশু আসলে একই সময় ব্যাপারটা বুঝলাম না। যদি বুঝিয়ে বলেন।
আমি বললাম, যারা এই কথা বলছেন তারা নিজেরাও বুঝতে পারছেন না। আমি কি বুঝাব। এই সব উচ্চ চিন্তা বাদ দিয়ে টিভি দেখুন।
হাজতি সব মিলিয়ে আমরা তিন জন। একজন বালক হাজতি, বয়স বার তোেরর বেশি হবে না। নাম কাদের।
আমরা তিনজই গভীর আগ্ৰহে কালিবুলি মাখা শূন্য দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছি। বালক হাজতির উৎসাহ সবচে বেশি। সে চোখের পলকও ফেলছে না, হা করে তাকিয়ে মাঝে মাঝে গা ঝাড়া দিয়ে উঠছে। সেন্ট্রিদের একজন অবাক হয়ে বলল, আপনারা কি দেখেন?
বালক হাজতি বলল, টিভিতে বাংলাদেশ নিউজিল্যান্ড খেলা দেখি।
টিভি কৈ?
ঐ তো টিভি। ‘ডিসটাব’ দিয়েন না তো। ইচ্ছা হইলে খেলা দেখেন।
হাজতিরা টিভিতে খেলা দেখছে এই খবর নিশ্চয় ওসি সাহেবের কাছে পৌঁছেছে তাকেও একবার দেখলাম পেনসিল হাতে উঁকি দিয়ে যেতে। এই ভদ্রলোক পেনসিল ছাড়া চলতেই পারেন না বলে মনে হচ্ছে। দুর্ধর্ষ আসামী ধরার সময় পিস্তলের মত পেনসিল তাক করেন কি-না কে জানে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার ডাক পড়ল। ওসি সাহেব খবর দিয়েছেন। আমি বলে পাঠালাম, খেলার মাঝখানে উঠে আসতে পারব না। লাঞ্চব্রেকে আসব। হাই টেনশনের খেলা।
ওসি সাহেব এবং আমি মুখোমুখি বসে আছি।
তিনি যথারীতি হাতের পেনসিল নাচাচ্ছেন। আড়াচোখে আমাকে মাঝে মধ্যে দেখছেন। বুঝতে পারছি আমাকে নিয়ে কোনো হিসাব নিকাশ হচ্ছে। কি বলে কথা শুরু করবেন বুঝতে পারছেন না বলে সময় নিচ্ছেন। আমিই আলোচনা শুরু করলাম। আন্তরিক ভঙ্গিতে বললাম, স্যার আপনি কি লক্ষ্য করেছেন পেনসিল সব সময় আটতল বিশিষ্ট হয়। গোল হয় না। কারণটা জানেন?
না।
বলব?
ওসি সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি উপেক্ষা করে বললাম, আটতলের কারণে পেনসিল সহজে টেবিল থেকে গড়িয়ে পড়ে না।
আপনার কাছ থেকে বিরাট জ্ঞান লাভ করলাম। আপাতত মুখ বন্ধ করুন। প্রশ্ন করলে জবাব দিবেন।
অবশ্যই জবাব দেব। একটাই অনুরোধ কঠিন প্রশ্ন করবেন না। সায়েন্স বাদ। আমি বিজ্ঞানে দুর্বল। পৃথিবীর ওজন কত জিজ্ঞেস করলে বলতে পারব না। এটম বোমা কে আবিষ্কার করেছেন তাও বলতে পারব না।
শুনলাম হাজতিদের নিয়ে টিভি দেখছিলেন।
ঠিকই শুনেছেন। বাংলাদেশ নিউজিল্যান্ডের খেলা। না দেখে পারছি না।
আর যাই করেন পুলিশের সঙ্গে ফাজলামী করবেন না।
পুলিশের সঙ্গে কোনো ফাজলামিতো করছি না। দেয়ালের সঙ্গে করছি।
আমি আপনার বিষয়ে খবর নিয়েছি আপনি অতি ধুরন্ধর একজন মানুষ। ধুরন্ধর কিভাবে টাইট করতে হয় আমি জানি।
জানলে টাইট করে দিন। তবে একটা কথা আপনাকে না বলে পারছি না। যে টাইট করে সে একই সময় নিজে লুজ হয়। আপনি আমাকে যতটা টাইট করবেন নিজে ঠিক ততটাই লুজ হবেন। এটা বিজ্ঞানের সূত্র।
বিজ্ঞানের সূত্র? আমাকে বিজ্ঞান সেখান?
আপনাকে কিভাবে বিজ্ঞান শেখাব? আমি আগেই স্বীকার করেছি। আমি সায়েন্সে দুর্বল। তবে নিউটনের সূত্রে আছে–To every action there is an equal and opposite reaction. আপনি আমাকে টাইট দিলে নিউটনের সূত্র অনুসারে আপনাকে লুজ হতে হবে। অর্থাৎ আপনার ব্রেইনের নাট বন্টু লুজ হতে থাকবে। দু’একটা খুলেও পড়ে যাবে। একদিন দেখা যাবে পেনসিল হাতে পথে পথে ঘুরছেন। যাকেই দেখছেন তার সঙ্গেই পেনসিলের ইশারায় কথা বলছেন। সবাইকে জিজ্ঞেস করছেন, মুরগির কি দাঁত আছে। কেউ আপনার প্রশ্ন বুঝতে পারছে না বলে জবাব দিতে পারছে না।
ওসি সাহেব থমথমে গলায় বললেন, বার বীর মুরগির দাঁতের প্রশ্ন আসছে কেন?
এই ধাঁধাটা আপনাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। জবাব দিতে পারেন নি বলে আবার মুরগির দাঁত চলে এসেছে।
চা খাবেন?
খাব। দুধ চা, চিনিসহ। দয়া করে পেনসিলে অর্ডার দেবেন না। আপনার পেনসিলের অর্ডার কেউ বুঝতে পারে না।
চা চলে এসেছে। এবার কোনো ভুল হয় নি। চা ঠিক আছে। আলাদা পিরিচে চার পাঁচটা বামুন সিঙ্গাড়া। এক সঙ্গে পাঁচ ছয়টা মুখে দেয়া যায়।
আমি চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, আপনাকে কি আমি ছোট্ট একটা গল্প বলতে পারি?
না। চা খান, সিঙ্গাড়া খান। গল্প বলতে হবে না।
হুজুগে বাঙ্গালী নিয়ে একটা রসিকতা করতে চাচ্ছিলাম। এই রসিকতা থেকে বুঝা যাবে আপনি আসল পুলিশ অফিসার না-কি ভেজাল। রসিকতা শুনে আপনি যদি শব্দ করে হাসেন তাহলে আপনি ভেজাল। আসল পুলিশ অফিসার কখনো জোকস শুনে হাসে না।