আপনাকে চেনা চেনা লাগছে। আপনার পরিচয়?
আমি সেই লোক যার জন্যে আপনি জুতা সন্ত্রাসী হয়েছেন।
আলম অবাক হয়ে বলল, আপনি আলামত নিয়ে এসেছেন?
জি। আলামতের অভাবে পুলিশের বেশির ভাগ মামলা হয় নড়বড়ে। আমাদের উচিত পুলিশকে সাহায্য করা।
আলম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আজিব দুনিয়া।
পোশাকের যে আলাদা ইজ্জত আছে এটা কবি শেখ সাদী বুঝেছিলেন। রাজসভাতে রদি জামা কাপড় পরে গিয়েছিলেন বলে তাকে সবার পেছনে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। তিনি পরের দিন জরির ঝালড় দেয়া পোশাকে উপস্থিত হলেন। তাকে সমাদরে প্রথম সাড়িতে বসানো হল। মনের দুঃখে তিনি লিখলেন–
“রাজসভাতে এসেছিলাম
বসতে দিলে পিছে
সাগর জলে শুক্তো ভাসে
মুক্তা থাকে নিচে।”
আমার স্যুট টাই দেখে ওসি সাহেব বিভ্রান্ত হলেন। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, স্যার বসুন।
আমি বসতে বসতে বললাম, ভাল আছেন?
ওসি সাহেব হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়তে গিয়ে আমার খালি পায়ের দিকে তাকালেন। তাঁর ভ্রূ কুঁচকে গেল। তিনি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আমি বললাম, জুতা পায়ে নেই। কিন্তু আমার সঙ্গে আছে। এই ব্ৰাউন পেপার ব্যাগে। দেখতে চান?
আপনার সমস্যা কি?
আমি বললাম, সমস্যা আমার না, সমস্যা দেশের। জুতা সন্ত্রাসী নামে নতুন সন্ত্রাসী গ্রুপ বের হয়েছে। এরা ভয়ংকর হয়ে উঠলে দেখা যাবে শুধু জুতা নিচ্ছে না। জুতার সঙ্গে পায়ের পাতা কেটে নিচ্ছে। মনে করুন আপনার বুট জুতা জোড়া নিয়ে গেল, বুটের ভেতর আপনার পায়ের পাতা।
ওসি সাহেব বললেন, আপনার কথাবার্তা অত্যন্ত এলোমেলো কি জন্যে এসেছেন বলুন।
আমি হাসিমুখে বললাম, হাজতে আলম নামে একজন বসে আছে। শুনলাম দশ হাজার টাকা ঘুস দিতে হবে। আপনারা ঘুসটা কি ক্রেডিট কার্ডে নেবেন? আমার কাছে ভিসা, আমেরিকান এক্সপ্রেস দুই-ই আছে।
ওসি সাহেব পালকহীন চোখে তাকিয়ে রইলেন। আমি বললাম, আপনাদের ঘুস গ্রহণ কর্মকাণ্ড আরো আধুনিক করা উচিত। থানার দরজাতেই লেখা থাকবে, ভিসা কার্ড, আমেরিকান কার্ডে ঘুস লেনদেন করা যাবে। ভাল কথা ঘুসের উপর কি ভ্যাট আছে?
ওসি সাহেব তিক্ত গলায় বললেন, এতক্ষণ আপনাকে চিনতে পারি নি। এখন চিনেছি। আপনি হিমু। সুটি টাই এর ঢংটা কি জন্যে? আপনি কি জানেন পুলিশকে ঘুস সাধার অপরাধে আপনাকে হাজতে ঢুকাতে পারি?
আমি বললাম, জানি। আবার এও জানি চালে সামান্য ভুল করলে আপনি চলে যাবেন খাগড়াছড়িতে। স্ট্যান্ড রিলিজ। সেখানে নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে বুনো হাতি। থানাওয়ালারা সব রাতে থানা ফেলে হাতির ভয়ে গাছে উঠে বসে থাকে। ঘুসখের অফিসাররা মানসিকভাবে দুর্বল থাকে। হাতি দেখলেই তারা হাত পা ছেড়ে দেয়। ধুথুস করে পাকা ফলের মত গাছ থেকে মাটিতে পড়ে যায়। ওসি সাহেব। আপনি অতি দুর্বল মনের একজন মানুষ। আমাকে হাজতে ঢোকানোর সাহস আপনি সঞ্চয় করতে পারছেন না। আমার সঙ্গে আপনি আপনি করে কথা বলছেন। বিশিষ্ট কেউ আমার পেছনে আছে। এই ধারণা আপনার মধ্যে বদ্ধমূল হয়ে গেছে। চা খাব। ওসি সাহেব চা খাওয়ানতো।
ওসি সাহেবের হাতে কাঠ পেনসিল। তিনি পেনসিল দিয়ে টেবিলে ঠক ঠক করছেন। মনের অস্থিরতার পেনসিল প্ৰকাশ বলা যেতে পারে। তিনি আমার বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত নেবেন এখনো বুঝা যাচ্ছে না। দুর্বল মনের মানুষের প্রধান ত্রুটি সিদ্ধান্তহীনতা, তবে তিনি যেভাবে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াচ্ছেন তাতে মনে হয় চব্বিশ ঘণ্টা হাজতে থাকতে হতে পারে।
তিনি হাতের পেনসিল টেবিলে নামাতে নামাতে বললেন, দুধ চা খাবেন না দুধ চা?
দুধ চা।
উইথ সুগার?
জি। প্রচুর হাঁটাহঁটি করিতো টাইপ টু ডায়াবেটিস এখানো আমাকে ধরতে পারে নি।
ওসি সাহেব পেনসিল দিয়ে ইশারা করলেন। চায়ের কাপে চামুচ নাড়ার মত করলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, চা খেয়ে সুবোধ বালকের মত হাজতে ঢুকে পড়বেন। আপনাকে অস্ত্ৰ আইনে গ্রেফতার করা হল।
আমি বললাম, অস্ত্ৰ কোথায়?
ওসি সাহেব বললেন, আমাদের কাছে কিছু অস্ত্ৰ, গুলি, জর্দার কোটা মজুদ থাকে। যাদের চোখ খারাপ, চোখে শুধু ঘুঘু দেখে ফাঁদ দেখতে পায় না। তাদের জন্যে এই ব্যবস্থা। অন্ত্র আইনে গ্রেফতার করে উদ্ধার করা অস্ত্র আলামত হিসাবে জমা দেয়া হয়।
পত্রিকায় ছবিও তো ছেপে দেন।
না, আমরা সব সময় ছবি ছাপি না। কাগজওয়ালাদের ইনভলব করলে সমস্যা বেশি হয়।
ছবিটা ছাপা হলে ভাল লাগতো। আমার স্যুট টাই পরা কোনো ছবি নাই।
ওসি সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ভাব ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে কঠিন কোনো কথা বলতে চান। কথা মাথায় আসছে না।
চা চলে এসেছে। পেনসিলের ইশারা ভাল হয় নি। দুধ চা চেয়েছিলাম এসেছে রং চা। আমি চায়ে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির ভান করে বললাম, ওসি সাহেব একটা ধাঁধার জবাব দিতে পারবেন। জবাব দিতে পারলে পুরস্কার আছে। ধাঁধাটা হল, মুরগির দাঁত কয়টা?
ওসি সাহেব ঘোৎ টাইপ শব্দ করলেন। হঠাৎ করেই তাঁর মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। নিশ্চয়ই ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা আছে। কোন এক সময় পরিষ্কার হবে।
আমি হাজতে আলমের পাশে গিয়ে বসলাম। হতভম্ব আলমকে বললাম, আলামত জমা দিতে গিয়ে ধরা খেয়েছি। অস্ত্ৰ আইনে মামলা হবে। সাত আট বছর জেলের লাপসি খেতে হতে পারে। জেলের বাবুর্চি কেমন কে জানে।
আলম বিড়বিড় করে বলল, কি সর্বনাশ।