তানিজার মা ঠাস করে মেয়ের গালে চড় দিয়ে তাকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকে গেলেন। ধরাম করে দরজা বন্ধ করলেন। আমি গোট ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম।
মহিলা কি করবেন বুঝতে পারছি না। স্বামীকে খবর দিবেন, পুলিশকে খবর দিবেন। বিরাট ক্যাচাল শুরু হবে।
খারাপ কি? আমিতো এখনো ক্রিজে আছি। দরজা বন্ধ বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যেও আনন্দ আছে। বাড়ির ভেতরের মানুষদের টেনশানে ফেলার আনন্দ। মানুষের স্বভাবই হচ্ছে অন্যদের টেনশানে ফেলে সে আনন্দ পায়। সৃষ্টিকর্তাও আমাদের টেনশনে ফেলে আনন্দ পান বলেই মানবজাতি সারাক্ষণ টেনশনে থাকে।
মানুষের মহত্তম গুণের একটির নাম কৌতুহল। জ্ঞান বিজ্ঞান, শিল্প সাহিত্যের মূলে আছে মানুষের অপার কৌতুহল। ঢাকা শহরের মানুষরা এই মহৎগুণের অধিকারী। তবে এই মহৎগুণের কারণে জ্ঞান বিজ্ঞান শিল্প সাহিত্যে তাদের কিছু যে হয়েছে তা-না। ঢাকা শহরের মানুষের কৌতুহল ক্ষুদ্র গণ্ডিতে আবদ্ধ। গরমের সময় কেউ যখন শসা খায়। তখন তাকে ঘিরে পঞ্চশজন মানুষ দাঁড়িয়ে থেকে শসা খাওয়া দেখে। আখের রস বের করা যন্ত্র ঘিরেও চল্লিশ পয়তাল্লিশজন কৌতুহলী মানুষ সব সময় দেখা যায়। শ্রমিকরা যখন রাস্তা খুঁড়ে পাইপ বসায় তখন শ’খানেক মানুষকে রাস্তার দু’পাশে বসে থাকতে দেখা যায়।
কৌতুহলের কারণেই আমাকে ঘিরে পঁচিশ ত্ৰিশজন মানুষ দাঁড়িয়ে গেল। কৌতুহলী মানুষরা সংঘবদ্ধ থাকে এবং তাদের একজন লিডার থাকে। এখানকার লিডারের মাথায় বাউলদের মত লম্বা চুল। তিনি ঘন ঘন মাথা ঝাকাচ্ছেন। বাতাসে তার বাবড়ি চুল নাচছে। অত্যন্ত বলশালী মানুষ। পাঞ্জাবী পরা, পাঞ্জাবীর হাতা গোটানো। দেখে মনে হয় ঘোসাঘুসির জন্যে প্ৰস্তুত। তিনি আমার কাছে এসে বললেন, ভাইসাব অনেকক্ষণ আপনি এই বাড়ির গেট ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। ঘটনা কি বলুনতো। কোনো সমস্যা? আমার নাম এ আলম।
আমি বললাম, এই বাড়ির একটা বাচ্চা মেয়ের নাম তানিজা। সে তার বাবার এক জোড়া জুতা আমাকে দিবে বলেছিল। জুতার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি। জুতা দিচ্ছে না।
আলম আমার খালি পায়ের দিকে তাকালেন। মনে হচ্ছে তিনি মর্মাহত। ক্ষুব্ধ গলায় বললেন, জুতা দিবে না। এটা কেমন কথা। অবশ্যই জুতা দিতে হবে।
তিনি মাথার বাবড়ি চুলে একটা বড় ধরনের ঝাঁকি দিয়ে জনতার উদ্দেশ্যে তেজি গলায় বললেন, দেখুন কি অবিচার। একটা লোক খালি পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে জুতা দিচ্ছে না।
কৌতুহলী জনতাকে জুতা দিচ্ছে না। শুনে মর্মাহত বলে মনে হল। তারা বলল, জুতা দিতে হবে। জুতা না দিয়ে পার পাওয়া যাবে না।
আধা ঘন্টার মাথায় দেড়শ’র মত লোক জমে গেল। গলির রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল। জনতার মধ্যে একদলকে মনে হচ্ছে জঙ্গি ভাবাপন্ন। তারা একটু পরপর হুংকার দিচ্ছে জুতা দে। জুতা দে। জুতা না দিলে বাড়ি জ্বালায়া দিমু।
এর মধ্যে অনেক ঝামেলা করে সাদা রঙের প্রায় নতুন একটা প্রাইভেট কার ঢুকেছে। ড্রাইভার কয়েকবার হর্ণ দিতেই জঙ্গি জনতা গ্রুপ খেপে গেল। প্রাইভেট করে আগুন ধরিয়ে দেয়া হল। ড্রাইভার দরজা খুলে পালাতে যাচ্ছিল। দৌড়ে তাকে ধরা হল। মেরে আধমরা করে জ্বলন্ত গাড়ির পাশে শুইয়ে রাখা হল।
আলম সাহেব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যে ক্ষুদ্র ভাষণ দিলেন–
‘বিসমিল্লাহের রহমানের রাহিম। আল্লাহপাক বলেছেন, মা সাবেরিনা। অর্থাৎ ধৈর্য ধারণ করুন। আপনার অস্থির হবেন না। ধৈর্য ধারণ করুন। আমি নিজে ঐ বাড়িতে যাচ্ছি। তাদেরকে অতি ভদ্রভাবে জুতা দিতে বলব। যদি জুতা না দেয় তাহলে আমরা হার্ড লাইনে যাব। আমরা দাবি আদায় করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।’
এর মধ্যে একটা লাল রঙের গাড়িকে গলির মোড়ে দেখা গেল। যদিও জনতা ধর ধর করে ছুটে গেল। ড্রাইভার অতি বুদ্ধিমান। গাড়ি ঘুরিয়ে নিমিষে। পালিয়ে গেল।
তিন জোড়া জুতা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ব্ৰাউন জুতা জোড়া ভাল ফিটিং হল। আমি জুতা পড়ে গলি থেকে বের হয়ে পড়লাম। আমার ধারণা ঘটনা আরো অনেক দূর গড়াবে। একটা ইয়েলো ক্যাব কাজ করা হয়েছে। আগুন ধরানোর চেষ্টা চলছে। জাগ্রত জনতা আশেপাশের বেশ কয়েকটা বাড়ির দরজা ধাক্কাচ্ছে এবং শ্লোগান দিচ্ছে, জুতা দে! জুতা দে!
গলি থেকে বের হবার মুখে দেখি পুলিশের এবং র্যাবের গাড়ি গলিতে ঢুকছে। এই দুই গাড়ির পেছনে ভোঁ ভোঁ শব্দ করে এ্যাম্বুলেন্সও যাচ্ছে।
পরদিন সকালে দুই হাতে হাতকড়া বঁধা অবস্থায় আলম সাহেবের ছবি ছাপা হল।
দুর্ধর্ষ জুতা সন্ত্রাসী আলম আটক।
(নিজস্ব প্রতিবেদক)
কলাবাগানের গলিতে সন্ত্রাসী আলমকে আটক করা হয়েছে। সে তার দলবল নিয়ে জুতা সংগ্ৰহ অভিযানে নেমেছিল। প্রথমে সে গৃহকর্তা বা গৃহকর্ত্রীর কাছে ভদ্র ভাষায় জুতা চাইতো। জুতা না দিলে বা জুতা দিতে দেরী হলে তার দল শুরু করত তাণ্ডব। তার দলের হাতে দুটি প্রাইভেট কার ভস্মীভূত হয়েছে। প্রাইভেট কারের আরোহীরা নিজেদের পায়ের জুতা খুলে দিতে রাজি না হওয়ায় এই কাণ্ড।
সন্ত্রাসী আলমকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সে মুখ খুলছে না। বার বার বলছে নসিব সবই নসিব। ঘটনায় ‘নসিব’ নামধারী কেউ যুক্ত কি-না তাও অনুসন্ধান করা হচ্ছে।
অনেকেই ধারণা করছেন জুতা সংগ্ৰহ অভিযানের পেছনে জুতা বিক্রেতাদের হাত আছে। তারা জুতার কৃত্রিম সংকট তৈরির চেষ্টায় আছে।