এলিতা এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি আমাদের মেসে এসে উঠেছে। আমি আমার ঘরটা তাকে ছেড়ে দিয়েছি। মেস জীবনের সঙ্গে সে চমৎকারভাবে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। কাদের তার ঘরেই মেঝেতে বিছানা করে ঘুমায়। ঘুম ভাঙ্গার পর শুরু হয় দুজনে যৌথ ঘর পরিষ্কার। হার্ডওয়ারের দোকান থেকে এলিতা হ্যান্ড মাপ, ফিনাইল, ব্রাস এইসব কিনেছে। প্রতিদিনই সে বাথরুমও পরিষ্কার করে। মেসের অন্য বোর্ডাররা ভাল লজ্জায় পড়েছে। তারা বলছে, ম্যাডাম আপনি কেন এই কাজ করবেন? এলিতা বলেছে, আমি একাতো করব না। আপনারাও করবেন।
মেসের রান্নাঘর পরিষ্কার হয়েছে। ডাইনিং ঘর এখন ঝকঝকি করছে। মেস ম্যানেজার শামসুদ্দিন হতাশ গলায় বলে, হিমু ভাইজানের মেমসাব তো ভাল বিপদে ফেলছে। জুতা পায়ে দিয়া ডাইনিং ঘরে ঢুকা যাবে না এটা কেমন কথা? ড্রাইনিং ঘরতো মসজিদ না।
এলিতা নিজের খরচে প্রচুর স্যান্ডেল কিনেছে। স্যান্ডেল নাম্বার দেওয়া। যে গুলিতে নাম্বার ওয়ান লেখা সেগুলি বাথরুমে যাবার স্যান্ডেল। যেগুলিতে নাম্বার টু লেখা সেগুলি ডাইনিং ঢোকার সময় পরতে হবে।
মেস ম্যানেজার শামসুদ্দিন বলেছে, এই ম্যাডাম যেদিন বিদায় হবে সেদিন আমি দশজন ফকির খাওয়াব আর মিলাদ দিব।
শামসুদিনের বিরক্ত হবার ভালই কারণ আছে। সন্ধ্যার পর থেকে তার ঘর চলে যাচ্ছে এলিতার দখলে। সেখানে এলিতার নাইট স্কুল। স্কুলের ছাত্রছাত্রী ংখ্যা মাত্র দুই। কাদের, এবং মেসের বাবুর্চির এসিসেটন্ট জরিনা। জরিনাও কাদোরের মত এলিতাকে ডাকে মাইজি। জরিনার বয়স চল্লিশ। এই বয়সে তার পড়াশোনার আগ্রহ দেখে এলিতা মুগ্ধ।
নৈশ স্কুল চলাকালীন সময় শামসুদ্দিন তার অফিস ঘরের বাইরে টুল পেতে বসে থাকে। হতাশগলায় বিড় বিড় করে, “স্কুল এইখানে থামবে না। আরো পুলাপান যুক্ত হবে। আলমত পাইতেছি। আমি গেছি।”
আলমের পীরাতির খবরও ছড়িয়েছে। তার কাছে দোয়া নিতে লোকজন আসছে। আলম দেয়া প্রার্থীদের মাথায় হাত রেখে দীর্ঘ দোয়া করে। এই সময় তার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়তে থাকে।
পীররা বিশেষ নামে পরিচিত হন। আলমের নাম হয়েছে অশ্রু ভাইপীর। কথায় কথায় তার চোখ দিয়ে পানি পড়ে বলে এই নাম।
অবস্থা যে দিকে যাচ্ছে তাতে মনে হয় অল্পদিনের মধ্যেই দেখা যাবে তার ভক্তরা অশ্রুভাই পীরের জন্যে হুজরা খানা বানিয়ে দেবে। বাৎসরিক উরস হবে। বাস ভর্তি মুরিদরা আসবে।
একদিন পেনসিল ওসি সাহেব আমাকে খবর পাঠিয়ে থানায় নিয়ে গেলেন। গলা নামিয়ে বললেন, আলতা মেয়েটার উদ্দেশ্যটা কি বলুনতো শুনি। দয়া করে ঝেড়ে কাশবেন।
আমি বললাম, আলতা আপনার স্ত্রী। তার উদ্দেশ্য আমার চেয়ে আপনার ভাল জানার কথা।
ওসি সাহেব লজ্জিত গলায় বললেন, এলিতা বলতে গিয়ে ভুলে আলতা বলেছি। দু’জনের নামের মধ্যের মিলটা কি লক্ষ্য করেছেন?
হুঁ।
আলতা বেঁচে থাকলে দু’জনকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে ছবি নিতাম।
আলতাভাবী মারা গেছেন। কবে?
বিয়ের রাতে মারা গেছেরে ভাই। বিষ খেয়ে মারা গেছে। তার অন্য একজনকে পছন্দ ছিল। তার বাবা-মা আমার সঙ্গে জোর করে বিয়ে দিয়েছিল। আমি কিছুই জানতাম না। হাসপাতালে আলতার মাথা কোলে নিয়ে বসেছিলাম। কি কষ্টের মৃত্যু চোখের সামনে দেখলাম।
ওসি সাহেবের চোখে পানি এসে গিয়েছিল। তিনি দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, এলিতা মেয়েটা কিন্তু পুলিশের নজরদারিতে আছে। তার বিষয়ে সাবধান।
সাবধান কেন?
অনেক বছর আগে অতি রূপবতী এক আমেরিকান তরুণী বাংলাদেশে এসেছিল। প্রচুর ড্রাগ সহ ধরা পড়েছিল। মেয়েটার যাবতজীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। আমেরিকার এক সিনেটারের চেষ্টায় মেয়েটা পাঁচ বছর জেল খাটার পর মুক্তি পায়।
আপনার কি ধারণা এলিতাও এরকম কেউ?
কথার কথা বললাম ভাই। পুলিশে চাকরি করার কারণে মন হয়েছে ছোট। মানুষের ভালটা চোখে পড়ে না। শুধু মন্দটা চোখে পড়ে। সরি।
আমাকে ডেকেছেন কি এলিতার বিষয়ে সাবধান করার জন্যে?
না না। একজন হাজতি আপনার জন্য ব্যস্ত। একবার শুধু দেখা করতে
ধোঁয়া বাবাকে ধরেছেন?
হুঁ।
মনে হচ্ছে আরেক বার পুলিশ মেডেল পাবেন।
পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ধোঁয়া বাবা কঠিন জিনিস। সে গোপনে কি কথা না-কি আপনাকে বলবে। গোপন কথাটা শুনে এসে যদি আমাকে বলেন খুশি হব। না বললেও ক্ষতি নাই। পেটে গুতা দিয়ে কথা বের করব।
ধোঁয়া বাবা এক ধরা পড়ে নাই। দলবল সহই ধরা পড়েছে। তার সাগরেদরা তাকে ঘিরে রেখেছে। আমি হাজাতের শিক ধরে দাঁড়াতেই ধোঁয়া বাবা আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ফিস ফিস করে গোপন কথাটা বললেন। আমি গোপনে কথা শুনে চলে এসেছি। আমি হিমু, হিমুদের অনেক গোপনে কথা শুনতে হয়। গোপন কথা গোপন রাখাই হিমুদের নিয়ম।
আমি আমার পুরানো হন্টন জীবন শুরু করেছি। কোনো কোনো রাতে মেসে ফেরা হয় না। হঠাৎ হঠাৎ এলিতা আমার সঙ্গে বের হয়। তখন দূর থেকে পুলিশের একটা গাড়ি আমাদের অনুসরণ করে। গাড়িতে বসে থাকেন পেনসিল ওসি সাহেব। তিনি কি পুলিশ নজরদারির কারণে অনুসরণ করেন, না-কি তাঁর মৃত স্ত্রীর ছায়ার পেছনে পেছনে যান? এর উত্তর জানা নেই।
পথে হাঁটার সময় এলিতা অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে। সব কথাই তার বাবাকে নিয়ে। একবার বলল, আমার মনের অনেক কষ্টের মধ্যে একটি কষ্ট হল বাবা কখনো আমাকে আদর করে কোলে নেয় নি। বাবার ধারণা ছিল আমি তার মেয়ে না। অথচ আমি দেখতে বাবার মত। বাবার বুকে ডানদিকে জন্ম দাগ আছে। ইংরেজি ছোট অক্ষরের ‘e’–র মত। আমারো আছে। তুমি দেখতে চাইলে দেখাব। দেখতে চাও?