আলমের ছোট ভাই বদরুল ভাইয়ের খোঁজ এসে ‘টাসকি’ খেয়েছে। সে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ভাইজান আপনার কি হয়েছে?
আলম উদাস গলায় বলল, কিছু হয় নাই। ধর্ম কর্ম নিয়া আছি। মাঝে মাঝে চিন্তার জগতে যেতে হয়। চিন্তার জগৎ বড়ই বিচিত্র।
এমনতো। আপনি ছিলেন না।
আলম উপদেশ দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, সব মানুষের জীবনে একবার একটা ঘটনা ঘটে। তখন শুরু হয় সমস্যা। লাইন বদল হয়।
বদরুল বলল, লাইন বদল হয় মানে কি?
আমল দুলতে দুলতে বললে, (যে কোনো কথা বলার সময় সে ধর্মগ্রন্থ পড়ার সময় যে দুলুনিতে মানুষ দুলে, সেই ভাবে দুলে।) ট্রেইন এক লাইনে চলে। লাইন বদল করা ট্রেইনের পক্ষে সম্ভব না। মানুষ ট্রেইনের মত এক লাইনে চলে। তবে বিশেষ ঘটনার পর নতুন লাইন পাওয়া যায়।
আপনিতো পীর ফকিরের মত কথা বলা শুরু করেছেন।
চিন্তা ভাবনা করে কথা বলি বলে এ রকম মনে হয়।
বদরুল বলল, আপনার জীবনে বিশেষ কি ঘটনা ঘটেছিল যে আপনি এমন হয়েছেন?
আলম হাই তুলতে তুলতে বলল, একজোড়া জুতা ছিনতাই করেছিলাম। সেই থেকে শুরু। ব্ৰাউন কালারের চামড়ার জুতা। অন্য কালারের জুতা ছিনতাই করলে হয়ত এ রকম হত না। তুচ্ছ ঘটনার বড় পরিবর্তন হয়। এটা আমি চিন্তার মাধ্যমে পেয়েছি।
বদরুল বলল, প্রয়োজনে আরেকবার জুতা ছিনতাই করে ঝামেলা কাটান দেন। আপনারে দেখে ভয় লাগতেছে। ইয়া মাৰুদ! কি মানুষ ছিলেন কি হইছেন। চলেন আমার সঙ্গে দেশে যাই।
আলম বলল, একটা চিন্তার মধ্যে আছি, চিন্তা শেষ হোক তারপর যাব ইনশাল্লাহ।
কি চিন্তার মধ্যে আছেন?
দুনিয়ার সব মানুষ যদি ভাল হয়ে যেত তাহলে দুনিয়ার অবস্থাটা কি হত সেটা নিয়ে একটা চিন্তা।
বদরুল হতভম্ব গলায় বলল, লাইলাহা ইল্লালাহ আপনের তো মাথাও খারাপ হয়ে গেছে। মাথায় পাগলের তেল দিয়ে ছায়াতে বসায়ে রাখতে হবে।
আলম বলল, একদিনে অধিক কথা বলে ফেলেছি। আর কথা বলব না। এখন বিদায় হও।
বদরুল হতাশ হয়ে বিদায় নিল।
আলমের বিষয়টা নিয়ে আমি এখনো চিন্তিত হবার মত কিছু দেখছি না। সব মানুষই জীবনে একবার হলেও পাগলমীর দিকে যেতে থাকে। এক সময় নিজেই ব্রেক কিশে। আবার আগের অবস্থানে ফিরে।
আমার কাছে সমস্যা অনেক বেশি মনে হচ্ছে কাদেরের। সে চোখ উঠা রোগ নিয়ে ফিরেছে। দুই চোখ শুকনা মরিচের মত লাল। মাথা কামিয়ে ফেলেছে। তার কথাবার্তাও খানিকটা এলেমেলো।
আমি বললাম, খুন করার যে কথা ছিল সেটা করেছিস?
না।
সুযোগ পাস নাই?
সুযোগ ছিল।
সুযোগ মিস করলি কেন? সুযোগতো সব সময় পাওয়া যায় না। সাহসের সমস্যা?
আমার সাহসের অভাব নাই। ঘটনা আমি এক মাসের মধ্যে ঘটাব।
যে তোর হাতে খুন হবে সে কি এটা জানে?
না।
তাকে জানানো উচিত না? তুই সাহসী মানুষ। সাহসী মানুষ গোপনে কিছু করে না।
কাদের মুখ বিকৃত করে বলল, আপনেতো আমারে ভাল ঝামেলায় ফেলছেন।
এত বড় ঘটনা ঘটাবি। আর ঝামেলা নিবি না?
কাদের হতাশ চোখে তাকাচ্ছে। টকটকে লাল চোখের কারণে তার হতাশাটা অন্য রকম লাগছে।
তোর চোখের যে অবস্থা ডাক্তারের কাছে যা।
কাদের বলল, ডাক্তার লাগবে না। পীর সাহেব ফুঁ দিয়ে দিয়েছেন। চোখ কটকট করতেছিল, পীর সাহেবের এক ফুয়ে কটকট ভাব শেষ। এখন আরামে আছি।
পীর কোথায় পেয়েছিস?
কাদের উদাস গলায় বলল, ঘরের পীর। আলম স্যার। উনার মধ্যে পীরাতি নাজেল হয়েছে।
বলিস কি?
কাদের দুঃখিত গলায় বলল, ঘরের পীরের ভাত নাই। এইটাই নিয়ম। উনারে এখন সবাই চিনে। আপনার পাশের ঘরে থাকে, আপনি চিনেন না।
এলিতা দেশে চলে যাবে। তাকে বিদায় দিতে এয়ারপোর্টে যাব। কাদেরকে বললাম, যাবি আমার সঙ্গে?
নাহ।
না কেন? এই মেয়েটা তোকে এত পছন্দ করে।
কাদের বলল, শাদা চামড়ার মানুষের অন্তর থাকে কালা। কালা অন্তরের মানুষের সঙ্গে কাদের মিশে না।
আলমকে বললাম, আপনি চলুন। এলিতাকে এয়াপোর্টে হ্যালো বলে আছি।
আলম বলল, আপনি একলাই যান। আমি একটা বিশেষ চিন্তায় আছি।
আমি বললাম, সব মানুষ ভাল হয়ে গেলে পৃথিবীর কি হত এই চিন্তা?
হুঁ।
আমি বললাম, চিন্তাটা জরুরি। আপনি চিন্তা করতে থাকুন, আমি একই যাই।
আপনি একা যাবেন এটা আবার মনে সায় দিতেছে না। চলেন যাই। চিন্তা কিছুক্ষণ বন্ধ থাকুক।
আলম যাচ্ছে শুনে কাদেরও নিতান্ত অনিচ্ছায় রাজি হল।
আমরা এয়ারপোর্ট উপস্থিত হয়েছি। বিদায় পর্ব শেষ হয়েছে। এলিতা ইমিগ্রেশনে ঢুকতে যাবে। তখন সামান্য ঝামেলা হল। আলম হেঁচকি তুলে কাঁদতে শুরু করল।
এলিতা বলল, কি হয়েছে?
আপনি চলে যাবেন মনটা মানতেছে না।
এলিতা বলল, কাঁদবেন না প্লীজ। একজন বয়স্ক মানুষ কাঁদছে দেখতে খুব খারাপ লাগছে।
আলম কান্নার সঙ্গে শুরু করল হেঁচকি। এলিতা বলল, আরো কি আশ্চর্য! এই পর্যায়ে আলম মাথা ঘুরে মেঝেতে পড়ে গেল। কাদের এতক্ষণ চুপচাপ ছিল এখন সেও আসরে নামল। এলিতাকে হঠাৎ দুহাতে জড়িয়ে ধরে বলল, মাইজি! আপনেরে যাইতে দিব না।
আমাদের চারপাশে লোক জমে গেল। সিকিউরিটির দু’জন এসে এলিতাকে বলল, কি সমস্যা?
এলিতা বলল, কোন সমস্যা না। এরা আমাকে যেতে দিবে না।
সিকিউরিটির লোক বলল, যেতে দিবে না মানে? মেরে হাড্ডি গুড়া করে দিব। আপনি ইমিগ্রেশনে ঢুকে পড়ুন। আমরা দেখছি
এলিতা বলল, আপনাকে কিছুই করতে হবে না। আমি ফ্লাইট ক্যানসেল করব। এরা যেদিন আমাকে হাসিমুখে বিদায় দিবে সেদিনই যাব। তার আগে যাব না! I promise.