আমি বললাম সব তোমার। আমার খাওয়ার পয়সাও তুমি দেবে। রাজি আছ?
ইছহাক বলল, স্যার উঠেন।
রিকশা নিয়ে ঘণ্টাখানেক শহরে ঘুরে মাজেদা খালার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম।
মাজেদা খালা বাসায় ছিলেন না। খালু সাহেব ছিলেন, তিনি আমাকে দেখেই বললেন, তোমার খালা বাসায় নেই। দয়া করে আমাকে বিরক্ত করবে না।
আমি বললাম, আপনারা আছেন কেমন?
ভাল আছি। এখন বিদায় হও।
বিদায় হলাম। মাজেদা খালা এবং খালু আমার অসুখের খবর পান নি।
পরের স্টেশন বাদলদের বাড়ি। সেখানে বিরাট হৈ চৈ। মেজো খালু চার ব্যাগ বাজার নিয়ে ফিরেছেন। গাড়ি থেকে নেমেছে তিন ব্যাগ। আরেকটার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। খালু সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বললেন, এখন ঝামেলায় আছি, বিদায় হও তো।
আমি বললাম, দুপুরে আপনার এখানে খাব ভেবেছিলাম। সঙ্গে একজন গেস্ট আছে। আমার রিকশাওয়ালা বারান্দায় খাবার দিলেই হবে।
গোট লস্ট, গোট লস্ট।
ইছহাক আমাকে দুপুরের খাবার খাওয়ালো রাস্তার পাশের রেষ্টুরেন্টে। ইট বিছিয়ে খাবার দেয়া হয় বলে এইসব রেক্টরেন্টের আরেক নাম ইটালিয়ান রেস্টুরেন্ট।
আগুন গরম মোটা মোটা রুটি।
হিদুল শুটকির জিভ পুরে যাওয়ার মত ঝাল ভর্তা।
মুরগির গিলা কলিজা।
ইছহাক বলল, স্যার পেট পুরা হইছে?
আমি বললাম, আরাম করে খেয়েছি ইছহাক।
ইছহাক বলল, এখন ডাবল জর্দা দিয়ে একটা পান মুখে দিয়া একটা ছিরগেট ধরান। দেখবেন দুনিয়ার মধ্যে বেহেশত নামব। দশ পনরো মিনিট শুইয়া কি বিশ্রাম নিবেন?
বিশ্রাম নিতে পারলে ভাল হয়। রেস্টুরেন্টের সঙ্গেই নীল রঙের পলিথিনে তাবুর মত ঘর। মেঝেতে শীতল পাটি এবং বালিশ। বালিশ পরিষ্কার। আধঘণ্টার জন্যে বিশ্রামের ভাড়া দশ টাকা। ইছহাক দশ টাকা দিয়ে আমার বিশ্রামের ব্যবস্থা করল।
ডবল জর্দার পান এবং সিগারেট হাতে আমি বিশ্রামে গেলাম। আধঘণ্টার জায়গায় এক ঘণ্টা কাটিয়ে ফিরলাম। ইছহাক রিকশার সীটে বসে চা খাচ্ছে। আমাকে দেখে বলল, আরাম হইছে স্যার।
আমি বললাম আরাম হয়েছে। মাঝে মাঝে এখানে বিশ্রামে আসব। ইছহাক এখন মূল কথা শোন। আমার কাছে টাকা পয়সা কিছুই নাই। চুক্তিমত তুমি আমাকে আমার মেসে নামিয়ে চলে যাবে।
ইছহাকের কোনো ভাবান্তর হল না। হাসিমুখে বলল স্যার কোনো অসুবিধা নাই। একটা ঘটনা শুনেন স্যার পাঁচ ছয় বছর আগের কথা। আপনের মত চুক্তিতে এক স্যার আমার রিকশায় উঠল। সন্ধ্যাবেলা রিকশা থাইকা নাইমা বলল, এই নাও আমার কাছে এগারো হাজার টাকা আছে। নিয়ে যাও। মালিকের রিকশা আর চালাবা না। নতুন রিকশা কিনবা।
আমি নয়া রিকশা খরিদ করেছি। শাদী করেছি। ঘটনাটা কি এখন আপনার ইয়াদ হইছে?
আপনারে চিনতে আমার দেরী হয়েছে। আমার দোষ নাই। আপনার চেহারা নষ্ট। দেইখা মনে হয় ছায়ার কচু গাছ। গায়ে চাদর থাকনে হলুদ পাঞ্জাবি চোখে পড়ে নাই। স্যার ভাল আছেন?
ভাল আছি।
শহরে ঘুরতে ইচ্ছা করলেই মোবাইলে মিস কল দিবেন। চইলা আসব। নিয়া মোবাইল খরিদ করেছি।
ইছহাক আমার মোবাইল নাই।
আচ্ছা যান। ডিউটিতে বাহির হইয়া প্রথম আপনের খোঁজ নিব।
কোন প্রয়োজন নাই ইছহাক। মাঝে মাঝে দেখা হওয়াই ভাল।
ইছহাক বলল, আপনের শরীর বেশি খারাপ করেছে। শরীরের যত্ন নিবেন। গরীরের এই অনুরোধ।
এলিতার চিঠি
রাশিয়ান পরী আমাকে দীর্ঘ এক চিঠি লিখেছেন। চিঠি ডাকে বা কুরিয়ার সার্ভিসে আসে নি। আমার অনুপস্থিতিতে সে নিজেই এসে দিয়ে গেছে। চিঠি ইংরেজিতে লেখা। মাঝে মাঝে কিছু বাংলা শব্দ ঢুকেছে। তার বাংলায় যে কোন উন্নতি হয়েছে তা বলা যাবে না। প্রিয় হিমু লিখতে গিয়ে লিখেছে ‘পিত্ত হিমু।’ আমি মোটামুটি ঠিক করে দিলাম।
এলিতার চিঠি
প্রিয় হিমু, তোমার দীর্ঘরোগভোগের পেছনে আমার ভূমিকা আছে। আগে ব্যাখ্যা করি। ধোঁয়া বাবাকে দিয়ে শুরু করা যাক। আমি যখন ক্যামেরা ফেরত পেলাম। তখনই বুঝলাম লোকটি ভয়ংকর এক ক্রিমিনাল। ঢাকা ক্রাইম ওয়ার্ল্ডের গড ফাদার। তা-না হলে হারানো ক্যামেরা এত দ্রুত আমার হাতে আসবে না। কিন্তু আমি ভান করলাম ধোঁয়া বাবার অলৌকিক ক্ষমতায় আমি মুগ্ধ। আমি তার শিষ্য হবার ইচ্ছাও প্রকাশ করলাম। ধোঁয়া বাবার পরিচয় আমার কাছে প্ৰকাশ হয়ে গেছে। এই তথ্য নিশ্চয়ই আমি জানাব না। আমার অভিনয় ভাল হয়েছিল। মনে হয় তুমি ধরতে পার নি।
তোমার সঙ্গে এমন একজন ক্রিমিনালের সখ্যতার বিষয়টা কিছুই বুঝলাম না। একজন সাধুর সঙ্গে পরিচয় হবে একজন সাধুর। ক্রিমিন্যাল চিনবে ক্রিমিন্যালকে।
তোমার কাছ থেকে পুরো ব্যাপারটি আমি জানতে চাচ্ছিলাম বলেই তোমাকে রাতে হোটেলে থেকে যেতে বলি। আমার যৌন সঙ্গী হবার জন্যে না।
আমার প্রস্তাব শুনে তুমি অবাক হলে, আহত হলে এবং লজ্জিত হলে। আমার ধারণা তুমি ঘৃণাবোধও করেছ। তোমার সেই দৃষ্টি এখনো আমার চোখে ভাসে।
ঝড় বৃষ্টির রাতে তুমি বের হয়ে গেলে এবং নিজেকে কষ্ট দেবার জন্যে সারারাত বৃষ্টিতে ভিজলে। কি করে জানলাম? নিজেকে কষ্ট দেবার এই ধরনের প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আমি কয়েকবার গিয়েছি। একবারের কথা বলি, মা’র উপর রাগ করে তুষারপাতের মধ্যেই ঘর ছেড়ে বের হয়েছি। অর্ধমৃত অবস্থায় পুলিশ আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
হিমু শোন! আমি একজন ব্রোকেন পরিবারের মেয়ে। আমার বাবা স্কুলের ফুটবল কোচ ছিলেন। এলকোহলিক হবার কারণে তার চাকরি চলে যায়। চরম অর্থনৈতিক সংকটে আমি এবং মা দিশাহারা হয়ে যাই। মা সমস্যার সুন্দর সমাধান করেন। তিনি বাবার এক বন্ধুর সঙ্গে গৃহত্যাগ করেন। আমাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ফোস্টার পিতামাতার কাছে।