ওসি সাহেব বললেন, আপনি নাশতা খাচ্ছেন দেখে ভাল লাগছে। নিউমোনিয়ায় আপনার দুটা লাংসই আক্রান্ত হয়েছিল। একটা পর্যায়ে ডাক্তাররা পর্যন্ত আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন।
আমি হাসলাম। এই হাসির সঙ্গে রোগমুক্তির কোনো সম্পর্ক নেই। হাসার কারণ ওসি সাহেবের নাম মনে পড়েছে। তার নাম আবুল কালাম তিনি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র।
ওসি সাহেব আমার দিকে সামান্য বুকে এসে বললেন, আপনাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছে। আপনার আমেরিকান বান্ধবী এলিতা। হাসপাতালের খরচপাতিও সে দিচ্ছে।
আমি বললাম, এলিতা কি দেখতে আলতা মেয়েটির মত?
ওসি সাহেব কয়েক মুহুর্ত চুপ করে থেকে বললেন, কিভাবে বুঝলেন?
আমি বললাম, কোনো অলৌকিক উপায়ে বুঝি নি। আলতার কথা বলার সময় আপনার গলার স্বর যেভাবে কোমল হয়ে যেত এলিতার কথা বলার সময় আপনার গলা একই ভাবে কোমল হয়েছে।
ওসি সাহেব হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন। গভীর গলায় বললেন, যাই। আপনি ভালমত সুস্থ হয়ে উঠুন। আপনার সঙ্গে কথা আছে। জরুরী কথা।
এখন বলুন।
না। এখনও বলার সময় আসে নি।
এলিতা এসেছে। তার চোখ মুখ আনন্দে ঝলমল করছে। আমার রোগমুক্তি দেখে সে আনন্দিত। এ রকম মনে করার কোনো কারণ নেই। অন্য কোনো কারণ আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তা জানা যাবে।
কারণ জানা গেল। এই ক’দিনে সে অসম্ভব ভাল কিছু ছবি তুলেছে। এর মধ্যে একটি ছবি হল, ছয় সাত বছরের একটা নগ্ন ছেলে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে পাউরুটি খাচ্ছে। পাউরুটি যেন ভিজে না যায়। সে জন্যে একটা হাত মেলে। সে ছাতার মত পাউরুটির উপর ধরে আছে।
এলিতা বলল, তোমার অসুস্থ অবস্থায় একটা ছবি আছে। ছবিটা প্রিন্ট করে তোমাকে দেখাব। ছবি দেখে সঙ্গে সঙ্গে তোমার চোখে পানি আসবে। তানিজা মেয়েটি তার মা’কে নিয়ে তোমাকে দেখতে এসেছিল।
সে তোমাকে হলি জমজম ওয়াটার খাওয়াবে। বোতলে করে সে হলি ওয়াটার নিয়ে এসেছে। চামচে করে তোমার মুখে মেয়েটা পানি ধরেছে সেই পানি তোমার গাল বেয়ে নিচে নামছে। একই সঙ্গে মেয়েটা কাঁদছে। তোমার গালের পানি এবং মেয়েটার গালের পানি চকচক করছে। ন্যাচারাল আলোয় তোলা ছবি। অসাধারণ।
আমি বললাম, তোমার ছবির সাবজেক্ট হতে পেরেছি। এতে আমি খুশি। তুমি আমার চিকিৎসার খরচ কেন দিয়েছ ব্যাখ্যা করলে ডাবল খুশি হব।
টাকা ফেরত দেবে?
কিভাবে দেব? আমি অন্যের টাকায় প্রতিপালিত ভিক্ষুক বিশেষ।
অন্যের দয়া গ্রহণ করতে তোমার সমস্যা হয় না? সৃষ্টিকর্তার দয়া গ্রহণ করতে যদি আমার সমস্যা না হয় তাহলে অন্যের দয়া গ্ৰহণ করতে সমস্যা কেন? সব মানুষের মধ্যেই ঈশ্বর প্রকাশিত। কাজেই আমি শুধুমাত্র ঈশ্বরের দয়াই নিচ্ছি।
এলিতা মুখ চোখ কুঁচকে বলল, ‘Oh God!’ এই বাক্যটি বলা মনে হয় তার মুদ্রা দোষ। কারণে অকারণে বলে।
এলিতা বলল, তোমার প্রিয় রঙ কি?
নীল।
এই রঙ প্রিয় হবার পেছনে কি কোনো কারণ আছে; না এমনিতেই প্রিয়।
কারণ আছে, আমাদের দৃশ্যমান জগতের বড় অংশ আকাশ। আকাশ নীল।
এলিতা বলল, তুমি শুনলে অবাক হবে। আমি তোমার প্রিয় নীল রঙের একটা শাড়ি কিনেছি।
হঠাৎ শাড়ি কেন?
আমি ঠিক করে রেখেছিলাম যেদিন তোমার রোগমুক্তি হবে। আমি নীল শাড়ি পরে উপস্থিত হব।
শাড়িতো পর নি।
শাড়ি পরতে যে এত কিছু লাগে জানতাম না। স্কার্টের মত আন্ডার গার্মেন্টস। টপস্-এর মত একটা ড্রেস, যাই হোক হোটেলের সাহায্যে দর্জি ডেকে ব্যবস্থা করেছি। শাড়ির অন্য অংশগুলি দর্জি এখনো দেয় নি।
আমি বললাম, কোনো অসুবিধা নেই। আমি কল্পনা করে নিচ্ছি। তুমি শাড়ি পরে আমার সামনে বসে আছ। আমি খুব ভাল কল্পনা করতে পারি।
Oh God.
ও গড বলে আঁৎকে উঠলে কেন?
এলিতা গভীর গলায় বলল, যে শাড়ি পরা অবস্থায় আমি বসে আছি কল্পনা করতে পারে সে নগ্ন অবস্থায় আমি বসে আছি। এই কল্পনাও করতে পারে। এ জন্যেই Oh God. বলেছি। হিমু এখন আমি উঠব। তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। সরি।
হঠাৎ ক্ষমা প্রার্থনা কেন?
অন্য আরেক দিন বলব। আজ না। তোমাকে রিলিজ করছে কবে?
জানি না।
সমস্যা নেই। আমি জেনে নিচ্ছি; তোমাকে রিলিজ করার দিনে আমি নীল শাড়ি পরে আসব।
আচ্ছা।
হাসপাতাল থেকে মেসে ফিরেছি। নীল শাড়ি পরে এলিতার আসার কথা ছিল সে আসে নি।
আলম সাহেব ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে আছেন। আমি এসেছি জেনেও তিনি দরজা খুললেন না। আমার রোগমুক্তির জন্যে তিনি এক হাজার রাকাত নামাজ মানত করেছেন। দিনে ৭০ রাকাত থেকে ১০০ রাকাতের বেশি পড়তে পারেন না বলে মানত মাঝামাঝি পর্যায়ে আছে। মানত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি দরজা খুলবেন না।
কাদেরের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না।
আমি হাসপাতালে ভর্তির দিন থেকে না-কি সে নিখোঁজ।
দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকা অনেকটা বিদেশ বাসের মত। বিদেশ ভ্ৰমণ শেষ হলে দেশে ফেরার জন্যে প্রাণ ঘ্যান ঘ্যান শুরু করে।
মেসে পা দিয়েও আমার প্রাণের ঘ্যানঘ্যাননি দূর হল না। ঢাকার পথে ঘাটে ঘুরতে ইচ্ছা করল। শরীরের এই অবস্থায় হিন্টন’ প্রক্রিয়া সম্ভব না। আমি সারা দিনের জন্যে রিকশা ভাড়া করলাম সন্ধ্যা পর্যন্ত রিকশা নিয়ে ঘুরবে বিনিময়ে আমার সঙ্গে টাকা পয়সা যা আছে সব তাকে দিয়ে দেব। অনেকটা জুয়া খেলার মত।
রিকশাওয়ালা মধ্যবয়স্ক, নাম ইছহাক। সে কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে রাজি হল। মিনমিনে গলায় বলল, চা নাশতা দুপুরের খানা এইগুলা কার?