আমি অপেক্ষা করছি এমন একটা গাড়ির যে দূর থেকে আমাকে দেখে গতি কমিয়ে দেবে। এই গাড়ি আমার গা ঘেঁসে যাবে কিন্তু আমাকে ভিজাবে না। এমন ঘটনা ঘটার পর আমি মেসে ফিরব তার আগে না।
মজার এক খেলা শুরু হয়েছে। দূর থেকে গাড়ির হেড লাইট দেখা মাত্র আমি রোমাঞ্চিত বোধ করছি এই গাড়ি মনে হয় আমাকে ভিজাবে না।
ঝাঁ ঝম। পাজোরা গাড়ি আমাকে ভিজিয়ে দিয়ে চলে গেল।
এবার আসছে এক চক্ষু গাড়ি। নিশ্চয়ই ট্রাক। ট্রাকের দুটা হেড লাইটের একটা বেশির ভাগ সময় নষ্ট থাকে।
ঝঁ ঝম! ট্রাজকও ভিজিয়ে দিল। দেখা যাক এবার কি আসে। আমার কাজ অপেক্ষা করা আমি অপেক্ষা করছি।
ঝড় বৃষ্টির রাতের জন্যে ঢাকা শহরে বিশেষ এক শ্রেণীর প্রাণী অপেক্ষা করে। এই তথ্য আর কেউ জানুক না জানুক টহল পুলিশরা জানে। এই প্রাণীগুলি দেখতে মানুষের মত। তবে সামান্য লম্বা। এরা রাতের অন্ধকারেও চোখে কালো চশমা পরে থাকে বলে এদের চোখ দেখা যায় না। শীত গ্ৰীষ্ম সব সময় এরা হাতে গ্লাভস পরে থাকে বলে হাতও দেখা যায় না। একা কাউকে পেলেই এরা কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। পাখির মত কিচকিচ করে কথা বলে। হ্যান্ডসেকের জন্যে হাত বাড়ায়।
একবার এদের একজনের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। কেন জানি মনে হচ্ছে আজও দেখা হবে। আমি এদের নাম দিয়েছি পক্ষীমানব।
টহল পুলিশরা বলে ‘বেজাত’। এদের কোনো জাত নেই।
একটা প্ৰাইভেট কার শ্লো করে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। পেছনের সীটে বসা আরোহী জানোলা খুলে উদ্বিগ্ন গলায় বলল, ভাই! আপনার কোনো সমস্যা।
কোনো সমস্যা নেই।
মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বাসা কোথায় বলুন। নামিয়ে দিচ্ছি। ভদ্ৰলোকের চোখে কালো চশমা। উনি কি পক্ষীমানবদের কেউ?
বৃষ্টিতে ভেজার ফল
বৃষ্টিতে ভেজার ফল ফলেছে, জ্বরের ঘোরে শরীর ও চেতনা আছন্ন। কড়া ঘুমের অষুধ খাবার পরেও ঘুম না এলে যেমন লাগছে আমার ঠিক সে রকম লাগছে। শরীরের একটা অংশ ঘুমিয়ে পড়েছে। অন্য অংশ জেগে আছে। সুপ্তি ও জাগরণের মাঝামাঝি ত্ৰিশংকু অবস্থা। স্বপ্ন দেখছি, স্বপ্ন ভেঙ্গে যাচ্ছে। প্রতিটি স্বপ্নেই আবহ সংগীত হিসেবে বৃষ্টির শব্দ। স্বপ্নে ফিলর হিসাবে পক্ষীমানবকে দেখছি। তিনি উদ্বিগ্ন গলায় বলছেন, আপনার কি সমস্যা?
একটা স্বপ্নে এলিতাকে দেখলাম। তার হাতে ক্যামেরা। আমার হাতে সানগান। আমি আলো ফেলছি, এলিতা ছবি তুলছে। আমরা এগুচ্ছি পিচ্ছিল সুরঙের ভেতর দিয়ে। সুরঙ্গের গায়ে প্রাচীন মানুষদের আঁকা ছবি। এলিতা ক্যামেরায় সেই সব দৃশ্য ধরছে। সে দুটা বাইসনের পেছনে একদল শিকারির ছবি তুলল। স্বপ্নে অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যাপার খুবই স্বাভাবিক মনে হয়। যেমন বাইসনের ছবি তোলার সময় এলিতা বাইসনদের বলল, তোমরা একটু আমার দিকে ফের। আমি তোমাদের চোখ পাচ্ছি না। সঙ্গে সঙ্গে দুটা বাইসন ক্যামেরার দিকে ফিরল। স্বপ্নে ব্যাপারটাকে মোটেই অস্বাভাবিক মনে হল না।
আমার মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। যে পানি ঢালছে তার মুখ দেখতে পাচ্ছি। না। শুধু কানের পাশ দিয়ে নেমে যাওয়া শীতল পানির স্রোত অনুভব করছি। এতে আমার সুবিধা হচ্ছে পানি যে ঢালছে তাকে কল্পনা করে নিতে পারছি। তার সঙ্গে মনে মনে কথাবার্তা বলছি।
কল্পনা করছি মাজেদা খালা পানি ঢালছেন। তার গা থেকে কড়া জর্দার গন্ধ আসছে। মাজেদা খালা বললেন, জুর কিভাবে বাধালি? বৃষ্টিতে ভিজেছিস?
হুঁ।
তোর সঙ্গে এলিতা মেয়েটা ছিল?
না।
ওকে সঙ্গে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজলি না কেন?
লাভ কি?
বৃষ্টি ভিজাভিজি থেকে প্রেম হয়। হিন্দী সিরিয়েলে দেখেছি।
এলিতার প্রসঙ্গ আসতেই মাজেদা খালার জায়গায় এলিতা চলে এল। এখন সে পানি ঢালছে। একই সঙ্গে চুলে আংগুল বুলাচ্ছে।
হ্যালো হিমু।
হ্যালো।
আমার কথা শুনে হোটেলে থেকে গেলে আজ এমন জুরে কাতরাতে না।
হুঁ।
সারারাত দুজনে গল্প করতাম। আমার ঝুড়িতে অনেক গল্প।
হুঁ।
একটা লাভ হয়েছে ভুল করে শিখেছি।
সবাই ভুল থেকে শেখে না। কেউ কেউ আছে। একের পর এক ভুল করেই যায়।
এলিতা মিলিয়ে গেল। তখন চলে এলেন আমার মা। তবে তিনি এলেন। বাচ্চা একটা মেয়ে হয়ে। মেয়েটি আমার চেনা, তানিজা। মেয়েটির এক হাতে তার বাবার জুতা জোড়া তারপরেও সে আমার মাথায় পানি ঢালছে এবং চুল বিলি করে দিচ্ছে। জ্বরে অর্ধচেতন অবস্থায় সবই সম্ভব। আমার শিশু ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে আমাকে ঘুম পাড়াতে চাইছেন। তবে গানের কথা এলোমেলো। প্রতিটি লাইনের শেষে সুরেলা লম্বা টান আছে—
কে ঘুমালো রে
পাড়া জুড়ালো রে
বর্গি কোথায় রে……….
গান থামিয়ে মা বললেন, তোকে আমি একটা হলুদ। ছাতা কিনে দেব। এরপর থেকে হলুদ ছাতা মাথায় দিয়ে রোদে ঘুরবি, বৃষ্টিতে যাবি। তোর কিছু হবে না।
প্রবল জুরে কতদিন আচ্ছন্ন ছিলাম তা জানি না। কখন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে তাও জানি না। এখন মোটামুটিভাবে হলেও বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসতে পারছি। চামুচে করে নিজে নিজে সুদৃপ খেতে পারছি। স্যুপ বিস্বাদ, এও ব্যাধির অংশ। শরীর ব্যাধি মুক্ত হলে স্যুপ তার স্বাদ ফিরে পাবে।
সকাল। আমার সামনে হাসপাতালের ব্রেকফাস্ট। ডিম সিদ্ধ, কলা, পাউরুটি জেলি।
হাসপাতালের বিছানা ঘেঁসে পেনসিল ওসি সাহেব বসে আছেন। আমি তার নাম মনে করতে পারছি না। কিছুক্ষণের মধ্যেই মনে পড়বে। ব্রেইন খাতা পত্ৰ উল্টে নাম খোঁজা শুরু করেছে।