আমি খালাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, সুট লাল টাই কোথায় পাব?
খালা বললেন, ড্রেস নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবে না। তোর খালুর স্যুট টাই আমি আলাদা করে রেখেছি।
মাপে হবে না।
একটু উনিশ বিশ হবে। কারো চোখে পরবে না। আমার সামনে পরতো। দেখি। টাই এর নট বাঁধতে পারিস?
না।
আমি বেঁধে দিচ্ছি। শিখে নে।
এখন পরতে হবে?
হ্যাঁ। তোর খালু বাসায় ফেরার আগেই স্যুট টাই নিয়ে বিদায় হয়ে যা। এখন থেকে সারাক্ষণ স্যুট টাই পরে থাকবি। নয়তো আসল দিনে ঝামেলায় পরবি গা কুটকুট করবে। টাই গলায় ফাঁসের মত লাগবে।
স্যুট টাই পারলাম। খালা বললেন, কোটটা সামান্য লুজফিটিং হয়েছে। এটাই ভাল। আজকাল লুজফিটিং-এর চল। যা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখ তোকে কি সুন্দর মানিয়েছে। তোর চেহারা যে এত সুন্দর আগে খেয়াল করি নি।
আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখি–নকল হিমু। আয়নার হিমুকে মনে হচ্ছে এই হিমু ব্রিফকেস নিয়ে ঘুরে। সে বিরাট ধান্দাবাজ, সন্ধ্যাবেলা ক্লাবে যায়, বোতল খায়।
খালা বললেন, নিজেকে দেখেতো মুগ্ধ হয়ে গেছিস। পুরুষ মানুষকে বেশিক্ষণ আয়নায় নিজেকে দেখতে হয় না, চরিত্র খারাপ হয়। এখন জুতা পর। জুতা ফিট করে কি-না দেখি।
অনেক চেষ্টা করেও জুতা পায়ে ঢুকানো গেল না। মোজাসহ, মোজা ছাড়া নানানভাবে চেষ্টা করা হল। খালা বললেন, টাকা দিচ্ছি একজোড়া জুতা কিনে নিবি। ব্ল্যাক সু। কিনবি। নিচে গাড়ি আছে। গাড়ি নিয়ে তোর খালুর এই স্যান্ডেলটা পড়ে চলে যা। জুতার দোকানে গাড়ি থেকে নামবি। কিছুক্ষণ স্যান্ডেল পরা থাকলে কিছু হবে না।
আমি গাড়ি এবং স্যান্ডেল ছাড়াই বের হলাম। হিমুর কিছুটা আমার মধ্যে থাকুক। সুটি টাইয়ের সঙ্গে খালি পা।
ঢাকা শহর বদলে গেছে। কিভাবে বদলেছে কতটুকু বদলেছে?
ক) ঢাকা শহরের চলমান মানুষ এখন কেউ কারো দিকে তাকায় না। আমি আধঘণ্টার উপর স্যুট পরে খালি পায়ে হাঁটছি। কেউ বিষয়টা ধরতে পারছে না। কেউ আমার পায়ের দিকে তাকাচ্ছেই না।
খ) ঢাকা শহরে মুচি সম্প্রদায় বলে এক সম্প্রদায় ছিল। তারা প্রথমে তাকাতো পায়ের দিকে। পায়ের জুতা স্যান্ডেলের অবস্থা দেখত। তারপর তাকাতো মুখের দিকে। জুতা ওয়ান টাইম আইটেম হয়েছে বলে মুচি সম্প্রদায় বিলুপ্ত। জুতার দিকে তাকিয়ে থাকার কেউ নেই।
গ) ঢাকা শহরের মানুষের বিস্মিত হবার ক্ষমতা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে! দু’জন আমাকে আপাদমস্তক দেখেছে। একজন দেখে হাই তুলল। দ্বিতীয় জন পানের পিক ফেলে। উদাস হয়ে গেল।
তবে শিশুদের মধ্যে বিক্ষিত হবার ক্ষমতা কিছুটা এখনো আছে। স্কুল ফেরত এক বালিকা অনেক ঝামেলা করে তার মা’র দৃষ্টি আমার খালি পায়ের দিকে ফেরাল। বিড়বিড় করে কিছু বলল। মা ধমক দিয়ে তাকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। বালিকা যাবে না। কাজেই আমি এগিয়ে গেলাম। আন্তরিক ভঙ্গিতে বললাম, খুকি তোমার কি খবর?
মেয়েটা সামাজিকতার ধার দিয়ে গেল না। অবাক হয়ে বলল, আপনার পায়ে জুতা নেই কেন?
আমি বললাম, আমি জুতা আবিষ্কারের আগের মানুষ বলে পায়ে জুতা নেই।
মেয়ের মা তার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে বললেন, তানিজ চলতো।
তানিজা বলল, খালি পায়ে হাঁটলে অসুখ হয় আমার টিচার বলেছেন।
আমি বললাম, তানিজা তাকিয়ে দেখ ঢাকা শহরের বেশির ভাগ ভিক্ষুক খালি পায়ে হাঁটে। এদের অসুখ হয় না।
মেয়ের মা আমার দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললেন, প্লীজ আমাদের বিরক্ত করবেন না।
আমি বললাম, বিরক্ত করছি না। গল্প করছি। আপনি আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছেন কেন? আপনার কি ধারণা আপনার মেয়েকে আমি ছিনিয়ে নিয়ে যাব। তারপর টেলিফোন করে বলব তানিজকে ফেরত পেতে হলে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা নিয়ে সন্ধ্যার পর আজিমপুর গোরস্তানের কাছে চলে আসবেন। র্যাব বা পুলিশে খবর দিলে মেয়েকে জীবিত পাবেন না।
কেন আপনি অকারণে কথা বলে যাচ্ছেন? কেন আমাদের বিরক্ত করছেন? আপনার সমস্যা কি?
আমার একটাই সমস্যা পায়ে জুতা নেই। স্যুট টাই পরে খালি পায়ে হাঁটছি। এ ছাড়া কোনো সমস্যা নেই। তানিজার টিচার আবার বলেছেন খালি পায়ে হাঁটলে অসুখ হয়। এটা নিয়েও সামান্য টেনশানে আছি।
মেয়ের মা মেয়েকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাচ্ছেন। আমিও তাদের পেছনে পেছনে যাচ্ছি। একটা খেলা শুরু হয়েছে। খেলাটার শেষ দেখা দরকার। রান করি বা না করি ক্রিজে টিকে থাকতে হবে। আশরাফুলের মত শূন্য রানে আউট হলে চলবে না।
মহিলা কয়েকবারই চেষ্টা করলেন, রিকশা ঠিক করতে। কোন রিকশা রাজি হল না। মহিলা হাত উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। একের পর এক ইয়েলো ক্যাব তাকে পাস কাটিয়ে চলে যাচ্ছে, থামাচ্ছে না। মহিলা হাঁটা শুরু করেছেন। আমিও তাদের সঙ্গে হাঁটছি।
তানিজা মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হাসছে। আমি তার হাসি ফেরত দিচ্ছি। হাসাহাসির সময় মেয়ের মা ‘বাঘিনি Look’ দিচ্ছেন। সাধারণ বাঘিনি না, আহত বাঘিনি। যে কোনো সময় আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে প্ৰস্তৃত। আমি তাদের পেছনে পেছনে কলাবাগানের গলির ভিতর ঢুকে গেলাম। মহিলা নিজের বাড়ির সামনে চলে এসেছেন বলে স্বস্তি ফিরে পেয়েছেন। আতংকে চেহারা কালো হয়ে গিয়েছিল, চেহারায় কিছুটা জেল্লা ফিরে এসেছে। তিনি বাড়ির গেটে হাত রাখতে রাখতে বললেন, অনেক যন্ত্রণা করেছেন আর কত? এখন যান।
আমি বললাম, এক জোড়া স্পেয়ার জুতা কি আপনাদের হবে? জুতা পরে চলে যেতাম। তানিজা বলল, বাবার অনেকগুলো জুতা আছে আপনি নিয়ে যান।