এলিতা বলল (ইংরেজিতে), আমি নিজেকে এইসব বুজরুকির সঙ্গে জড়াতে চাচ্ছি না। ঘরে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
আমি বললাম, শুরু যখন করেছে। শেষটা দেখ। ক্যামেরা হারিয়েছে এটা বল।
এলিত কঠিন গলায় বলল, আমি কিছুই বলব না। নুইসেন্সের সঙ্গে যুক্ত হব না। আমাকে বোকা মনে করার কোন কারণ নেই।
ধোঁয়া বাবা বললেন, ছেমড়ি চিল্লায় কেন?
আমি বললাম, মনের দুঃখে চিৎকার করছে। দামী ক্যামেরা হারিয়ে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছে।
ক্যামেরা গেছে কোন জায়গায়?
ধোঁয়া বাবার এই বাংলা এলিতা বুঝতে পারুল। সে বিরক্ত গলায় বলল, সোনারগাঁ হোটেলের সামনে।
কি ক্যামেরা?
নাইকন। আমি আর কিছু বলব না। আমি বাইরে যাব। আমার চোখ ‘Hot’ হয়েছে। এলিতা চোখ ডলাতে ডালতে ঘর থেকে বের হল। ধোঁয়া বাবা বললেন, হিমুভাই বসেন। অনেক দিন পরে আপনারে দেখে মনে আনন্দ হয়েছে।
আমি বললাম, আনন্দের হাত ধরে আসে নিরানন্দ।
ধোঁয়া বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তাও ঠিক। কানাঘুসা চলতেছে। যে কোনদিন পুলিশের হাতে ধরা খাব।
ক্যামেরা কি পাওয়া যাবে?
সিদ্দিকের এলাকা। পাওয়াতো যাবেই। কতক্ষণে পাওয়া যায় সেটা কথা। আপনি শাদা ছেমড়ি নিয়ে অপেক্ষা করেন। আমি পাত্তা লাগাই। রাতে খাওয়া দাওয়া না করে যাবেন না। দাওয়াত কবুল করেছেন?
করলাম।
শুকরিয়া।
ধোঁয়া বাবার ঘরের ধোঁয়া কমে আসছিল। বাবার নির্দেশে একজন এসে ধোঁয়া বাড়িয়ে দিল। বাবা ক্ষীণ গলায় ডাকলেন, হিমু ভাই।
আমি বললাম, কি বলতে চান বলে ফেলুন।
মৃত্যুভয় ঢুকেছে বুঝেছেন। পেরায় রাতেই স্বপ্ন দেখি ফাঁসির দড়িতে ঝুলতেছি কিন্তু মরণ হচ্ছে না। বিরাট কষ্টের ব্যাপার। কি করি বলেন তো।
ধোঁয়া খেতে থাকুন। আর কি করবেন।
ধোঁয়া বাবার আস্তানায় এলিতাকে নিয়ে রাতের খাবার খেলাম। কাচ্চি বিরিয়ানি, মুরগির রোস্ট, দৈ মিষ্টি। এলিতা বলল, অদ্ভুত রান্না। এত ভাল খাবার কম খেয়েছি।
আমি বললাম, পীর ফকিরদের দরবারে খানা সব সময় ভাল হয়।
ডিনার শেষ হবার আগেই এলিতার ক্যামেরা চলে এল। ক্যামেরার সঙ্গে তার চামড়ার ব্যাগ। ব্যাগের ভেতর নিশ্চয়ই স্প্রেটাও আছে। চোখ অন্ধ করার স্প্রে।
এলিতা আবারো বলল, Oh God. এটা কিভাবে সম্ভব?
আমি বললাম, এই পৃথিবীতে সবই সম্ভব। আবার সবই অসম্ভব। আমার ধারণা বাবা জ্বীন পরীদের সাহায্যে কাজটা করেছেন।
এলিতা বলল, Holy man ধোঁয়া বাবা যে এত পাওয়ারফুল তা আগে বুঝতে পারি নি। আমি তাঁর Dociple হতে চাই। এটা কি সম্ভব?
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, এই একটু আগেইতো বলেছি পৃথিবীতে সবই সম্ভব। আবার সবই অসম্ভব। ক্যামেরায় যে সব ছবি তুলেছ সেগুলি ঠিক আছে কি-না। আগে দেখা। ধোঁয়া বাবার শিষ্য হবার চিন্তা বাদ দাও। উনার শিষ্য হলে সমস্যা আছে।
কি সমস্যা?
রাতে দুঃস্বপ্ন দেখবে। ফাঁসিতে ঝুলছ কিন্তু মৃত্যু হচ্ছে না। মৃত্যুর জন্যে একজন ছটফট করছে কিন্তু সে মরতে পারছে না, বিরাট কষ্টের ব্যাপার না?
এলিতা হতাশ গলায় বলল, You are so confusing.
আমি একাতো না। আমরা সবাই confused. প্রাচীন মায়া সভ্যতায় বলা হয়, ঈশ্বর মরছে confused বলেই আমরা সবাই confused.
সোনারগাঁ হোটেলে তাকে নামিয়ে চলে আসছি সে আমাকে চমকে দিয়ে বলল, , হিমু! তুমি আজ থেকে যাও।
আমি বললাম, কোথায় থাকব?
আমার ঘরে থাকবে। আমরা সারারাত গল্প করব।
আমি বললাম, হায় সখা এত স্বৰ্গপুরী নয় পুষ্পে কীট সম হেতা তৃষ্ণা জেগে রয়।
এলিতা বলল, এর মানে কি?
আমি বললাম, কবিতার লাইন। ব্যাখ্যা করা কঠিন।
এলিতা বলল, এর মানে কি এই যে তুমি থাকবে না।
আমি বললাম, ঠিকই ধরেছ। আমি যাই। তুমি আরাম করে ঘুমাও।
আমি হাঁটা ধরেছি। এলিতা তাকিয়ে আছে।
ঢাকা শহরের রাতে আকাশ দেখা যায় না বলে পথচারীদের মাঝে মাঝে খুব সমস্যা হয়। আকাশে হয়ত ঘন মেঘ করেছে, বেচারা বুঝতে পারল না। হুড়মুড়িয়ে নামল বৃষ্টি। শোবার ঘরের নিরাপদ আশ্রয়ে যে আছে সে তখন মনের আনন্দ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের বর্ষ যাপন পড়তে পারে। পথে যে নেমেছে তার মহাবিপদ। বৃষ্টি শুরু হলেই রিকশা সিএনজি কিছুই পাওয়া যাবে না। কিছুক্ষণের মধ্যে রাস্তায় পানি উঠে যাবে। সেই পানিতে এক সময় ফুটপাত ঢেকে যাবে। ম্যানহোল সবই ফুটপাতে। এই শহরে ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি করে এমন একদল মানুষই আছে। তারা সেরদরে ম্যানহোলের ঢাকনা বেচে কিংবা কটকটিওয়ালার কাছে ঢাকনার বিনিময়ে কটকটি কিনে খায়। রাতের ঢাকায় বৃষ্টি হচ্ছে আর কেউ ম্যানহোলের ভেতর ঢুকে যায় না। এমন ইতিহাস নেই।
ফুটপাতে পানি উঠে গেছে। কাজেই ফুটপাত ছেড়ে আমি পথে নেমেছি। আমার গা ঘেঁসে একটা প্রাইভেট কার গেল। আমি কাদার পানিতে মাখামাখি। প্রাইভেট কারের জানালা খুলে একজন মাথা বের করে বলল, ‘দাদা! সরি।’ গাড়ির ভেতর থেকে প্রবল হাসির শব্দ ভেসে এল। বিচিত্র কারণে অন্যের দুৰ্দশায় আমরা আনন্দ পাই।
সারাগায়ে কাদাপানি মেখে আমি দাঁড়িয়ে আছি। বিরামহীন বৃষ্টি পড়ছে। গায়ের কাদা বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যাবার কথা, তা যাচ্ছে না। আমার ইচ্ছা করছে সোগারগা হোটেলে ফিরে এলিতাকে বলা, “আজ রজনীতে হয়েছে সময় এসেছি বাসবদত্তা।”
আরেকটা গাড়ি এসে আমাকে দ্বিতীয়বার ভিজিয়ে দিল। মজা মন্দ না। আমার ধারণা একের পর এক গাড়ি আসবে অসহায় পথচারীকে ভিজিয়ে আনন্দ পাবে। নিশিরাতে মানুষকে আনন্দ দিতে পারছি এটা খারাপ না।