বলেন কি! উনিও বোতল ধরেছেন?
সব কিছু নিয়ে ফাজলামি করবে না। ঘটনা বুঝার চেষ্টা কর। আমি একটা সিঙ্গেল মল্ট হুইস্কি এনে রেখেছি। শুভদিন দেখে বোতল খুলব। তোমার খালা চলে গেছেন এটা একটা শুভ দিন। বরফ গ্লাস সব নিয়ে বোতলের খোঁজ করতে দেখি বোতল নাই। তোমার অতি চালাক খালা আমাকে শিক্ষা দেয়ার জন্যে এই কাজ করেছে। এখন কি করি বল।
বরফ মেশানো পানি খেয়ে শুয়ে থাকবেন?
আবার ফাজলামি? তুমি গাড়ি নিয়ে যাও। তোমার অতি চালাক খালার কাছ থেকে বোতল রিলিজ করে নিয়ে আস।
আমি বললাম, খালা মদের বোতল নিয়ে তার বাবার বাড়িতে যাবেন না। আপনার বোতল তিনি কোথাও লুকিয়ে রেখেছেন।
কোথায় লুকিয়ে রাখবে?
নিজের শোবার ঘরে রাখবেন না। সেখানে ধর্মের বই পত্ৰ আছে। বোতল ভেঙ্গে ফেলেও দিবেন না। বাঙ্গালী মেয়েরা দামি জিনিস তা সে যতই ক্ষতিকর হোক, ফেলে না। ডেট এক্সপায়ার হওয়া অষুধও জমা করে রাখে।
খালু ধমক দিয়ে বললেন, মূল কথায় আসা। তোমার বুদ্ধিমতী খালা বোতল কোথায় লুকিয়েছে?
আমার ধারণা তার বাথরুমে। বেসিনের নিচের কাবার্ডে যেখানে ফিনাইল জাতীয় জিনিসপত্র থাকে, কিংবা বাথরুমে ডাক্টবিনে।
খালু অলিম্পিকের দৌড় দিয়ে ছুটে গেলেন এবং অলিম্পিকের সোনা পাওয়ার মত মুখ করে বোতল কোলে ফিরে এসে জড়ানো গলায় বললেন, “হিমু ছাদে আসো।” বোতল কোলে নিয়েই তাঁর নেশা হয়ে গেছে।
দু’জন ছাদে বসে আছি। খালু সাহেব আশংকাজনক গতিতে বোতল নামিয়ে দিচ্ছেন। আমার প্রতি মমতা এবং ভালবাসায় তিনি এখন সিক্ত।
হিমু।
জি খালু সাহেব।
আমি যে তোমাকে অত্যন্ত স্নেহ করি তা-কি তুমি জান?
জানতাম না। এখন জেনেছি।
তোমাকে দেখলে বিরক্ত হবার মত ভাব করতাম, এটা আসলে অভিনয়। আমি সেই ব্যক্তি যে মনের ভাব গোপন রাখতে পছন্দ করে। এই বিষয়ে কবিগুরুর একটা লাইন আছে। এখন মনে পড়ছে না। মনে করার চেষ্টা করছি।
চেষ্টা করার দরকার নেই। মনে পড়লে পড়বে।
আমার কি ধারণা হিমু, আমি তোমার খালাকেও পদ করি? তাকে গো টু কিংখান বলা ঠিক হয় নি। হিমু! তোমার কি ধারণা বেহেশতো দোজখ এই সব কি আছে? (পেটে জিনিস বেশি পড়লে খালু সাহেব ধর্ম নিয়ে আলোচনায় চলে যান।)
আমি বললাম, ধর্ম আলোচনাটা থাক।
তোমার কি ধারণা আমি মাতাল হয়ে গেছি? এখনো আমার লজিক পরিষ্কার দশ থেকে উল্টা দিকে গুনতে পারব। দশ নয় আট সাত ছয় পাঁচ চার তিন দুই এক ৷ হয়েছে?
হয়েছে।
একশ থেকে উল্টা দিকে গুনে এক পর্যন্ত আসতে পারব। শুরু করব?
না। আপনার নেশা কেটে যেতে পারে। ঘুমিয়েও পড়তে পারেন।
ঘুমিয়ে পড়বা কেন?
সংখ্যা নিয়ে গুনাগুনি শুরু করলে ঘুম আসে। মানুষ ভেড়া গুনতে শুনতে ঘুমায়।
খালু সাহেব গ্লাসে বড় একটা চুমুক দিয়ে গণনা শুরু করলেন, একশ, নিরানব্বই, আটানব্বই, সাতানব্বই… …
বিরাশি পর্যন্ত এসে তিনি গভীর ঘুমে আছন্ন হলেন। আমি ‘নেশা’ বিষয়ে আমার বাবার উপদেশ মনে করার চেষ্টা করলাম।
নেশা
পুত্র হিমু। নেশাগ্ৰস্ত মানুষের আশেপাশে থাকা আনন্দময় অভিজ্ঞতা। নেশাগ্ৰস্ত মানুষে মনের দরজা খুলে এবং বন্ধ হয়। কখন খুলছে কখন বন্ধ হচ্ছে তা সে বুঝতে পারে না। তুমি নেশাগ্ৰস্ত মানুষের পাশে থেকে এই বিষয়টি ধরতে চেষ্টা করবে। মহাপুরুষরা কোনো নেশার বস্তু গ্ৰহণ করা ছাড়াই তার মনের দরজা খুলতে পারেন এবং বন্ধ করতে পারেন। আমি নিশ্চিত একদিন তুমিও তা পারবে।
এলিতা আমার ঘরে বসে আছে
এলিতা আমার ঘরে বসে আছে। তার চোখ ফোলা, মনে হয় একটু আগে কেঁদেছে। আমেরিকান মেয়েরা আমাদের দেশের মেয়েদের মত অকারণে কাঁদে কি-না তাও জানি না। মাঝে মাঝে ঠোঁট কামড়াচ্ছে। প্ৰচণ্ড রাগ এবং প্রচণ্ড দুঃখে মানুষ ঠোঁট কামড়ায়। মেয়েরা নিচের ঠোঁট, পুরুষরা উপরের। এলিতা দু’টা ঠোঁটই কামড়াচ্ছে।
তার সমস্যা কি?
আমি বললাম, চা খাবে?
এলিতা প্রবলভাবে মাথা ঝাঁকাল। সে চা খাবে না। তার ভাবভঙ্গি থেকে মনে হচ্ছে সে আবারো কান্নার উপক্রম করছে। আমি বললাম, কি সমস্যা?
এলিতা হাহাকার ধ্বনি তুলে বলল, আমার ক্যামেরা পকেটমার হয়েছে।
আমি বললাম, তোমার বাংলা ভুল হয়েছে। পকেট থেকে কিছু চুরি হলে পকেটমার। তোমার এই বিশাল ক্যামেরা কোনো পকেটে আটবে না। হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে?
হুঁ।
তাহলে ছিনতাই হয়েছে। ছিনতাই চোখের সামনে হয়। পকেটমার হয় আড়ালে।
আমি তোমার কাছে বাংলা শিখতে আসি নি।
কি জন্যে এসেছ?
ঘটনাটা জানাতে, আমার সব ছবি এই ক্যামেরায়। কি চমৎকার সব ছবি তুলেছি।
আবার তুলবে।
পাগলের মত কথা বলছি কেন? কোন ছবিই দ্বিতীয়বার তুলা যায় না।
যাবে না কেন?
প্রথম তোলা ছবির লাইট দ্বিতীয়বার ঠিক থাকে না। পৃথিবী ঘুরছে আলো প্রতিমুহূর্তে বদলাচ্ছে।
পৃথিবী স্থির হয়ে থাকলে একই ছবি দ্বিতীয়বার তুলা যেত?
প্লীজ স্টপ ইট। তোমার সঙ্গে বক বক করতে ইচ্ছা করছে না। কাঁদতে ইচ্ছা করছে।
কাঁদো। তোমাকে কাঁদতেতো কেউ নিষেধ করছে না। কেঁদে মন ঠিক কর। কেঁদে কেঁদে বিজ্ঞানী নিউটন হয়ে যাও।
তার মানে কি?
বিজ্ঞানী নিউটন বিশাল এক অংকের বই এর পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলেন। নাম ‘প্রিন্সিপিয়া ম্যাথামেটিকা’ তার আদরের কুকুর জ্বলন্ত মোমবাতি ফেলে পাণ্ডুলিপি পুড়িয়ে ফেলে। নিউটন বইটা আবার নতুন করে লেখেন। তুমিও নতুন করে ছবি তুলবে।