যে মেয়েটি আমার কোলে তাকে আমি চিনি। তার নাম তানিজা। বেচারী নিশ্চয়ই তার বাবা কিংবা মা’র সঙ্গে এই এলাকায় কেনাকাটা করতে গিয়ে বাটারফ্লাই এর চক্রে পড়েছে।
তানিজকে ডাক্তারখানায় নেয়ার আগেই তার জ্ঞান ফিরল। সে বেশ স্বাভাবিক। মাঝে মাঝে সামান্য কেঁপে কেঁপে উঠছে। আমি বললাম, তানিজা আমাকে চিনেছ?
তানিজা হ্যাঁ সূচক মাথা নাডুল। ফিসফিস করে বলল, মা কোথায়?
আমি বললাম, মা নিশ্চয়ই তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। তোমার কোনো ভয় নেই। আমি যথাসময়ে তোমাকে তোমার মা’র হাতে তুলে দেব। আইসক্রিম খবে?
হুঁ।
কোন ফ্লেভার?
ভ্যানিলা। আপনার পা খালি কেন?
তানিজা! আমি সব সময় খালি পায়েই থাকি।
কেন?
মাটি হচ্ছে আমাদের মা। মায়ের স্পর্শ শরীরে সারাক্ষণ লাগানো আনন্দের ব্যাপার না?
তানিজা বলল, মাটি মা হলে আপনি তো মা’কে পাড়িয়ে তার উপর হাঁটছেন।
আমি তানিজার যুক্তিতে চমৎকৃত হলাম। শিশুরা মাঝে মাঝে সুন্দর যুক্তি দেয়।
প্রথমে তানিজকে তাদের বাড়িতে নিয়ে গেলাম। সেখানে কেউ নেই। দরজায় তালা লাগানো; বাসায় কাজের মেয়ে আছে। সে তালাবদ্ধ যাতে বের হতে না পারে। কাজের মেয়ের কাছে মেসের ঠিকানা দিয়ে এলাম।
পেনসিল ওসি’র সঙ্গে যোগাযোগ করে জানলাম হারানো শিশুর বিষয়ে এখনো কেউ থানায় যোগাযোগ করে নি।
তানিজা তার মায়ের মোবাইল নাম্বার জানে সেখানে টেলিফোন করা হল। কেউ ধরল না। তানিজা তার বাবা কোন অফিসে চাকরি করে তা বলতে পারল না।
তানিজ দুপুরে কি খাবে?
পিজা খাব। আর ঠাণ্ড কোক খাব। মা আমাকে ঠাণ্ড কোক খেতে দেয়
না।
ঠাণ্ডা কোক খেলে কি হয় জান?
না।
টনসিল ফুলে যায়। জ্বর হয়।
তাহলে তো বিরাট সমস্যা।
দুপুরে আমরা পিজা খেলাম। তানিজা ঠাণ্ড কোক খেতে খেতে বলল, মামা চল এখন মা’কে খুঁজে বের করি।
মেয়েটা কিছুক্ষণ হল আমাকে মামা ডাকা শুরু করেছে। গোপন কথা বলা শুরু করেছে। আজ তার জন্মদিন এটা জানলাম। জন্মদিনে তার মা রাতে তাকে পিজাহাটে নিয়ে যাবে বলেছিল। এখন যেহেতু দুপুরে পিজা খাওয়া হয়েছে, রাতে না খেয়েও চলবে।
মামা তুমি কি জান আমার বাবা আমাদের সঙ্গে থাকে না।
জানি না তো।
মা’র সঙ্গে ঝগড়া করে আলাদা থাকে। মা বাবাকে বলল, এই মুহুর্তে তুমি বের হয়ে যাবে। বাবা বলল, এত রাতে আমি কোথায় যাব? মা বলল, জাহান্নামে যাও। বাবা বলল, জাহান্নাম আমি কোথায় পাব?
তোমার বাবাকেতো মনে হচ্ছে রসিক মানুষ।
হুঁ। মা রসিক মানুষ পছন্দ করে না। মা বাবাকে ডাকে গোপাল ভাঁড়।
গোপাল ভাঁড় কে তুমি চেন?
আমি চিনি না। আমার মনে হয়। সে দুষ্ট লোক। তাই না?
হতে পারে।
বড়দের ঝগড়া করতে হয় না।
অবশ্যই হয় না।
বাবাকে বকে দিও।
নিশ্চয়ই বিকে দিব।
মা’কে কিন্তু বকা দিও না। মা খুব রাগী। বকা দিলে মা রাগ করবে।
খুব রাগী হলে তাকে বকা দেব না। রাগী মেয়েদের আমি খুবই ভয় পাই।
আমি আমার মা’কে অল্প ভয় পাই। বাবা বেশি ভয় পায়।
অল্প ভয় পাওয়াই ভাল।
আমরা আবার ঢাকা কলেজের সামনে ফিরে গেলাম। অস্থির মা মেয়ের সন্ধানে সেখানেই ঘোরাঘুরি করার কথা। তাকে পাওয়া গেল না। ঢাকা কলেজের সামনের রাস্তা পুরোপুরি স্বাভাবিক। গাড়ি চলছে, রিকশা চলছে। ফুটপাত দখল করে হকাররা বসে আছে। কর্মহীন মহিলারা জামা কাপড় দেখে বেড়াচ্ছে। কিছুই তাদের পছন্দ হচ্ছে না। কলেজের ভেতর ক্লাসও মনে হয় শুরু হয়েছে। আমি নিশ্চিত চাপাতিওয়ালা বিছানার নিচে চাপাতি রেখে কোঅর্ডিনেট জিওমেট্রির ক্লাস করছে।
তানিজা বলল, মা’কে পাওয়া না গেলে অসুবিধা নাই। মামা আমি তোমার সঙ্গে থাকব।
আমি বললাম, আমারও কোনো অসুবিধা নাই। রাতে জন্মদিনের কেক কাটার ব্যবস্থা করতে হবে।
মামা আমি চিড়িয়াখানায় যাব। আমাকে কেউ চিড়িয়াখানায় নিয়ে যায় নি। মা বলেছিল জন্মদিনে চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাবে।
চল চিড়িয়াখানায় যাই।। জীবজন্তু দেখে আসি।
রাতে আমি খাব বাৰ্গার।
বাৰ্গারের সঙ্গে ঠাণ্ড কোক খাবে না?
হুঁ খাব।
চিড়িয়াখানার জীবজন্তু দেখে আমি তানিজকে নিয়ে চলে গেলাম সোনারগাঁ হোটেলে। মেয়েটাকে কিছুক্ষণের জন্যে এলিতার হাতে দিয়ে দেয়া যাক। তানিজা এখন বিরতিহীন কথা বলে আমার মাথা ধরিয়ে দিয়েছে।
এলিতা আমাকে দেখে ভুরু কুঁচকে ফেলে বলল, কি ব্যাপার?
আমি বললাম, তুমি আমাকে একশ ডলার দিয়েছ। আমার পেমেন্ট ঠিক হয় নি। বাকি টাকাটা নিতে এসেছি।
একদিন কাজ করেছ একশ ডলার দিয়েছি।
এয়ারপোর্টে তোমাকে আনতে গিয়েছিলাম। ঐ দিনের হিসবাতো ধর নি।
সরি। আমি এক্ষুনি এনে দিচ্ছি। তোমার সঙ্গে এই মেয়েটা কে?
ওকে পথে কুড়িয়ে পেয়েছি। ওর নাম তানিজা।
পথে কুড়িয়ে পেয়েছ মানে কি? তোমাদের দেশে কি এমন শিশু পথে কুড়িয়ে পাওয়া যায়?
আমি বললাম, হ্যাঁ আমাদের দেশে কুড়িয়ে পাওয়া যায়। যথাসময়ে বাবা মা এসে তাদের নিয়ে যায়। তোমার দেশে যে সব শিশু হারিয়ে যায়। তাদের কখনো খুঁজে পাওয়া যায় না। গত বছরের স্ট্যাটিসটিকসে এসেছে তিনশ পনেরো জন শিশু হারিয়েছে যাদের খোঁজ কেউ জানে না। ভুল বলেছি?
এলিতা জবাব দিল না। চুপ করে রইল।
তুমি কি তানিজকে কিছুক্ষণ রাখতে পারবে? রাত দশটা পর্যন্ত। রাত দশটার মধ্যে তার বাবা এসে মেয়েকে নিয়ে যাবে।
তারা জানবে কিভাবে যে এই মেয়ে আমার কাছে আছে?