এই ছবি তুলতে পারবে না।
কেন পারব না? তোমাদের দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে এই জন্যে পারব না?
আমি বললাম, এলিতা শোন। দেশের ভাবমূর্তি নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। এই ছবি তুলতে পারবে না। কারণ ডাস্টবিনে এখন কেউ খাদ্য খুঁজে না।
এলিতা বলল, তুমি স্বীকার করতে চাইছ না। কিন্তু আমি জানি তোমাদের দেশে ডাষ্টবিনে খাবার খোঁজা হয়। আমি ভিডিও ফুটেজ দেখেছি।
বানানো ফুটেজ দেখেছি। আমাদের দারিদ্র্য দেখতে তোমাদের ভাল লাগে বলেই নকল ছবি তোলা হয়। আমি তোমাকে ঢাকা শহরের প্রতিটি ডাষ্টবিনে নিয়ে যাব। যদি এরকম দৃশ্য পাও অবশ্যই ছবি তুলবে।
এলিতা বলল, তুমি রেগে যাচ্ছ কেন?
আমি বললাম, আমি মোটেও রেগে যাচ্ছি না। তুমি চাইলে ডাস্টবিনে খাবার খুঁজছে এমন কিছু নকল ছবি তোলার ব্যবস্থা করা যাবে। কয়েকজন টোকাইকে বললেই এরা খাবার খোঁজার চমৎকার অভিনয় করবে। টোকাইরা ভাল অভিনয় জানে। বাংলাদেশে টোকাই নাট্য দল পর্যন্ত আছে।
টোকাই কি?
যারা ফেলে দেয়া জিনিসপত্র খুঁজে বেড়ায় এরাই টোকাই।
এলিতা বলল টোকাই লাগবে না। আমি টোকাই ছাড়াই ছবি তুলব। মিথ্যা ছবি আমি তুলি না।
ঢাকা শহরের ডাস্টবিনে ডাষ্টবিনে বিকাল পর্যন্ত ঘুরলাম। কোথাও খাবারের সন্ধানে কাউকে ঘুরতে দেখা গেল না। এক জায়গায় একটা বালিকাকে পাওয়া গেল। সে নাকে জামা চাপা দিয়ে কাঠি দিয়ে ময়লা ঘাটাঘাটি করছে। সে জানালো ডাষ্টবিনে মাঝে মাঝে দামী জিনিস পাওয়া যায়। সে নিজে একবার একটা মোবাইল ফোন পেয়েছিল। একশ টাকায় একজনের কাছে বিক্রি করেছে।
খাবারের ছবি একটা শেষ পর্যন্ত তোলা হল। ফুটপাতে পা নামিয়ে খালি গায়ে এক বৃদ্ধ ললিপপ আইসক্রিম খাচ্ছে। বৃদ্ধের মাথার চুলদাড়ি ধবধবে সাদা। তার হাতের আইসক্রিমের রঙ টকটকে লাল। সাদা এবং লালের কন্ট্রাস্টে সুন্দর দেখাচ্ছে।
এলিতা বলল, খুব সুন্দর ন্যাচারাল আলো পেয়েছি। ছবিটা ভাল হবে। আমি বললাম, এই আলোর আমাদের দেশে একটা নাম আছে। একে বলে কন্যা সুন্দর আলো। এই আলোর বিশেষত্ব হচ্ছে কালো মেয়েদের এই আলোয় ফর্সা লাগে।
তোমার দেশে ফর্সা লাগাটা খুব জরুরি?
হ্যাঁ। আমরাও তোমাদের মত।
আমাদের মত মানে?
তোমাদের দেশে তামাটে গায়ের রঙ হওয়া খুবই জরুরি। অনেক ডলার খরচ করে রোদে পুড়ে তোমরা গায়ের রঙ বদলাও। আমরা শুধু বিশেষ এক সময়ের আলো গায়ে মেখে ফর্সা হয়ে যাই। এ জন্যে আমাদের টাকা পয়সা খরচ করতে হয় না।
এলিতা বলল, তুমি কি প্রমাণ করার চেষ্টা করছি যে তোমরা শ্রেষ্ঠ?
কিছু প্রমাণ করার চেষ্টা করছি না।
এলিতা বলল, এই বৃদ্ধ খালি গায়ে বসে আছে। তাকে জিজ্ঞেস কর আমি যদি তাকে একটা সার্ট বা সুয়েটার কিনে দেই সে কি নেবে?
তুমি সার্ট বা সুয়েটার উপহার হিসেবে দেবে, না-কি ভিক্ষা হিসেবে দেবে?
উপহার হিসেবে দিলে তাকে জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। আমরা কাউকে জিজ্ঞেস করে উপহার দেই না।
এলিতা বলল, তুমি বাজে তর্ক করতে পছন্দ করা। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে আমি আর বের হব না।
আমি কি চলে যাব?
হ্যাঁ।
আমি বললাম, আলম আর কাদের থাকুক। ওরাতো আর কথা বলে তোমাকে বিরক্ত করছে না। দু’জনই মুগ্ধ হয়ে তামার কর্মকাণ্ড দেখছে।
ওরা থাকুক।
আমার আজকের দিনের পেমেন্টটা আলমের হাতে দিয়ে দিও।
আমি রিকশা থেকে নেমে হেঁটে রওনা দিলাম। ইচ্ছা করছে মাথা ঘুরিয়ে এলিতার মুখের ভাব দেখি। কাজটা করা গেল না। কারণ আমার মহান পিতা এই বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করে গেছেন–তার বাণী সমগ্রের একটির শিরোনাম বিদায়। তিনি লিখেছেন—
বিদায়
পুত্র হিমু। তুমি যখন কারো কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাত্রা শুরু করবে তখন পেছনে ফিরে তাকবে না। পেছন ফিরে তাকানো অর্থ মায়া নামক ভ্ৰান্তিকে প্রশ্ৰয় দেয়া। তুমি তা করতে পার না। মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ কখনো কারো কাছ থেকে বিদায় নেয় না। তখন মায়া নামক ভ্রান্তি তাকে ত্যাগ করে। ভয় নামক অনুভূতি গ্রাস করে। সে পৃথিবী ছেড়ে যেতে চায় না। মহাপুরুষরাই শুধু মৃত্যুর সময় উপস্থিত সবার কাছ থেকে বিদায় নেন।
সন্ধ্যাবেল আলম এবং কাদের বিমর্ষ মুখে ফিরে এল। তারা আমার জন্যে খামে ভর্তি করে একশ ডলারের একটা নোট এনেছে। তার সঙ্গে এলিতার লেখা চিঠি। চিঠি ইংরেজিতে লেখা , Dear Himu দিয়ে শুরু করা হলেও Dear শব্দটি কেটে দেয়া হয়েছে। চিঠির বঙ্গানুবাদ—
হিমু,
তোমার প্রাপ্য ডলার পাঠানো হয়েছে। তোমাকে কিছু কথা বলা প্রয়োজন বোধ করছি। তুমি বুদ্ধিহীন একজন মানুষ। বুদ্ধিহীনারাই তর্কবাজ হয়। বুদ্ধির অভাব তর্ক দিয়ে ঢাকতে চায়।
তুমি নানান বিষয়ে আমাকে শিক্ষিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছ। বিষয়টা অত্যন্ত বিরক্তিকর। আমি তোমার দেশে শিক্ষা সফরে আসি নি। নিজের কাজ নিয়ে এসেছি।
তোমাকে কঠিন কঠিন কথা লিখলাম। তার জন্যে আমি যে খারাপ বোধ করছি–তা-না। তোমার সার্ভিসের আমার আর প্রয়োজন নেই।
তবে মি. আলম এবং কাদেরকে আমার প্রয়োজন। ওরা নিয়মিত আসবে। আলোচনা সাপেক্ষে তাদের পেমেন্ট ঠিক করা হবে।
এলিতা
আমার বেকার জীবনের শুরু, আলম এবং কাদেরের কর্মময় সময়ের শুরু। এরা দু’জন ভোরবেলা ভ্যান নিয়ে চলে যায়, সন্ধ্যাবেলা ফিরে। এদের কাছ থেকে নানান ধরনের ছবি তোলার গল্প শুনি। কয়েকটি উল্লেখ করা যায়। ফটোগ্রাফের নামগুলি আমার দেয়া। এলিতা নিশ্চয়ই ইংরেজিতে সুন্দর নাম দেবে।