আপনার কি মনে হয়?
আমার মনে হয় পুড়াবেন না। অতি তুচ্ছ মশা মাছিকে শাস্তি দেয়ার কিছু নাই।
আমি বললাম, আল্লাহর কাছে মানুষতো মশা মাছির মতই তুচ্ছ। মানুষকে তিনি কেন শাস্তি দিবেন?
আলম গভীর হয়ে বলল, এটাও একটা বিবেচনার কথা। এটা নিয়ে আলাদা ভাবে চিন্তা করতে হবে।
এলিতার ঘুম ভাঙ্গল রাত আটটা বাজার কিছু আগে। লোডশেডিং হচ্ছে বলে বাতি জুলছে না। টেবিলের উপর দুটা মোমবাতি জ্বলছে। মশারির ভেতর এলিতা অবাক হয়ে বসে আছে। ঘরে আলো আধারের খেলা। এলিতা বিম্মিত গলায় বলল, আমি কোথায়?
আমি বললাম, তুমি আমাদের মেস বাড়ির একটা ঘরে।
আমার মাথার উপরে জালের মত এই তাবুটা কি?
একে বলে মশারি। ঘুমের মধ্যে যেন মশা বা মাছি তোমাকে বিরক্ত না করে তার জন্যেই এই ব্যবস্থা।
আমি ভেবেছিলাম মারা গেছি। মৃত্যুর পর আমার আত্মাকে আটকে রাখা হয়েছে। কি যে ভয় পেয়েছিলাম।
ভয় কেটেছে?
হ্যাঁ। প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে।
দশ মিনিটের মধ্যে তোমার খাবার ব্যবস্থা হবে। আজ আমরা যা দিব তাই খাবে। খাওয়া দাওয়া শেষ হলে তোমাকে হোটেলে পৌঁছে দেব। এখানকার টয়লেটগুলির অবস্থা খুবই খারাপ তারপরেও একটা পরিষ্কার করে রাখা হয়েছে। একটা মোমবাতি হাতে নিয়ে আমার পেছনে পেছনে আসা আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।
এলিতা বলল, আমি তোমাকে বলেছিলাম আমার ভয় কেটেছে, আসলে কাটে নি। আমার এখনো মনে হচ্ছে। আমি মৃত আমার ‘soul’ তোমার সঙ্গে ঘুরছে।
আমি বললাম, কিছুক্ষণের মধ্যেই তুমি আলো ঝলমল ফাইভস্টার হোটেলে যাবে তখন আর নিজেকে মৃত মনে হবে না।
খেতে বসে এলিতা বলল, কাঁটাচামচ কোথায়? আমিতো হাত দিয়ে খেতে পারি না।
আমি বললাম, বাংলাদেশের খাবার হাত দিয়ে স্পর্শ করে তারপর মুখে দিতে হয়। এটাই নিয়ম। একবেলা আমাদের মত খেয়ে দেখ।
এলিতা খাওয়া শেষ করল গম্ভীর মুখে। খাবার তার পছন্দ হচ্ছে কি না তা তার মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে ভু্রু কুচকাচ্ছে তা দেখে মনে হয়। খাবার ভাল লাগছে না।
এলিতা খাওয়া শেষ করে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, আমি আমার জীবনে ভাল যত খাবার খেয়েছি আজকেরটা তার মধ্যে আছে। আমি ‘Food’ শিরোনামে যে সব ছবি তুলব। সেখানে এই খাবারের ছবিও থাকবে। গরম ভাত থেকে ধোঁয়া উড়ছে। গরম ভাত একজন হাত দিয়ে স্পর্শ করছে।
আজকের খাবারের শেফ কে?
আমি আলমকে পরিচয় করিয়ে দিলাম। এলিতা অবাক হয়ে বলল, আপনার চোখে পানি কেন?
আলম বলল, সামান্য খানা বিষয়ে এত ভাল কথা বলেছেন এই জন্যে চোখে পানি এসেছে। সিস্টার আমি ক্ষমা চাই।
এলিতা বলল, আপনার চোখের পানি দেখে আমি খুবই অবাক হয়েছি। আপনি কি ফুল টাইম শেফ? কোন রেক্টরেন্টে কাজ করেন?
আলমের চোখে পানির পরিমাণ আরো বাড়ল। তার চরিত্রে যে এমন স্যাঁত স্যাঁতে ব্যাপার আছে তা এই প্রথম জানলাম। আমি এলিতাকে বললাম, আলম কোনো প্রফেশনাল কুক না। তিনি নিজের খাবার নিজে রেধে খান। দরজা জানালা বন্ধ করে দিন রাত চিন্তা করেন।
এলিতা বিস্মিত গলায় বলল, কি চিন্তা করেন?
জটিল সব বিষয় নিয়ে চিন্তা করে যেমন–গতকাল চিন্তা করছেন মশাদের soul আছে কি-না তা নিয়ে–
বল কি?
তোমার যদি চিন্তার কোনো সাবজেক্ট থাকে, আলমকে বললেই তিনি চিন্তা শুরু করে দেবেন।
চিন্তার জন্যে তিনি কি কোন ফিস নেন?
না।
আমরা এলিতাকে সোনারগাঁ হোটেলে নামিয়ে দিয়ে এলাম। আলম বললেন, সিস্টার যাই? এই দু’টি শব্দ বলতে গিয়ে তার গলা ভেঙ্গে গেল এবং চোখ ছলছল করতে লাগল। এলিতা অবাক হয়ে বলল, Oh God! what a strange man.
এলিতা তার প্রথম ছবির সন্ধানে বের হবে
এলিতা তার প্রথম ছবির সন্ধানে বের হবে। বাহন হিসেবে সে সাইকেল চেয়েছিল। সাইকেলের বদলে রিকশার ব্যবস্থা হয়েছে। রিকশা এলিতার পছন্দ হয়েছে। এলিতার পেছনে পেছনে আমার থাকার কথা, আমি আরেকটা রিকশা নিয়েছি। আমাদের সঙ্গে একটা ভ্যানগাড়িও আছে। সেখানে আলম এবং কাদের বসে আছে। তাদের সঙ্গে নানান ধরনের রিফ্লেকটর, সান গান। ছবি তুলতে এত কিছু লাগে জানতাম না।
এলিতা বলল, আমরা দু’জনতো এক রিকশাতেই যেতে পারি।
আমি বললাম, তা সম্ভব না।
সম্ভব না কেন?
গায়ের সঙ্গে গা লেগে যেতে পারে।
তাতে অসুবিধা কি?
আমি বললাম, গাতের সঙ্গে গা লাগলে তোমার শরীরের ইলেকট্রন আমার শরীরে ঢুকবে। আমার কিছু ইলেকট্রন যাবে তোমার শরীরে। দু’জনের মধ্যে বন্ধন তৈরি হবে। এটা ঠিক হবে না।
এলিতা বিরক্ত গলায় বলল, এমন উদ্ভট কথা আমি আগে শুনি নি। আমি অনেকের সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে বাসে ট্রেনে ঘুরেছি। কারো সঙ্গেই আমার কোনো বন্ধন তৈরি হয় নি।
আমি বললাম, কেন হয় নি বুঝতে পারছি না। বন্ধন হবার কথা। একজন সাধুর সঙ্গে তুমি যদি কিছুদিন থাক তোমার মধ্যে সাধু স্বভাব চলে আসবে। দুষ্ট লোকের সঙ্গে কিছুদিন থাক তোমার মধ্যে ঢুকবে দুষ্ট স্বভাব।
বক্তৃতা বন্ধ করা। বেশি কথা বলা মানুষ আমি পছন্দ করি না।
আমি বললাম, হুট করে মাঝখান থেকে বক্তৃতা বন্ধ করা যায় না। শেষটা শোন। আমাদের কালচার বলে পাশাপাশি সাত পা হাঁটলে বন্ধুত্ব হয়। তুমি ছবি তুলতে এসেছ, দেশের কালচার মাথায় রেখে ছবি তুলবে। এখন বল কিসের ছবি তুলবে?
ডাষ্টবিনের ছবি। ডাস্টবিনে মানুষ খাদ্য অনুসন্ধান করছে এরকম ছবি।