এইখানে এই তরুর তলে
তোমার আমার কৌতুহলে
যে ক’টি দিন কাটিয়ে যাব প্রিয়ে
সঙ্গে রবে সুরার পাত্র
অল্প কিছু আহার মাত্র
আরেকখানি ছন্দ মধুর কাব্য হাতে নিয়ে।’
‘ও মারা যাবে কেন?’
‘শরীর খুবই খারাপ। তা ছাড়া টাকাপয়সাও নেই। বাড়িভাড়া বাকি পড়েছে। বাড়িওয়ালা খুব তাড়াতাড়িই মনে হয় বাড়ি থেকে বের করে দেবে। তখন খেয়ে না খেয়ে, পথে-পথে ঘুরতে গিয়ে কিছু –একটা ঘটিয়ে ফেলবেন।’
‘আপনি জানেন না, ওর অনেক বড়-বড় আত্মীয়স্বজন আছে।’
‘ঐ লোক কি আত্মীয়স্বজনের কাছে যাবে? হাত পাতবে ওদের কাছে?’
‘না।’
‘এষা, এখন আমি উঠব। আরেকদিন আসব। আপনার দাদীমা’র জন্যে আর অপেক্ষা করতে পারছি না। আমাকে একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যেতে হবে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। রাত ন’টায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট। ন’টা প্রায় বাজতে চলল।’
‘কবে আসবেন?’
‘খুব শিগ্গিরই আসব। এষা, আপনাকে আরেকটা কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি। কথাটা হচ্ছে—আমার কথাবার্তা থেকে দয়া করে কোনো ভ্রান্ত ধারণা নেবেন না। মনে করবেন না আমি খুব কায়দা করে মোরশেদ সাহেবের কাছে আপনাকে ফিরে যেতে বলছি।’
‘আপনি বলছেন না?’
‘অবশ্যই না। মোরশেদ সাহেব যদি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতেন আমি হয়তো- বা বলতাম। সেই সম্ভাবনা একেবারেই নেই। উঠি এষা’
ডক্টর ইরতাজুল করিম সাহেবও ঠিক এষার মতো ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকালেন, যেন চিনতে পারছেন না।
‘স্লামালিকুম ডাক্তার সাহেব, আমি হিমু।’
‘কি ব্যাপার?’
‘আপনার সঙ্গে আমার অ্যপয়েন্টমেন্ট আছে।’
‘আপনি ডাইরিতে লেখে রেখেছেন। প্রথম যেদিন এসেছিলাম সেদিনই বলেছিলেন এক সপ্তাহ পর রাত ন’টার দিকে আসতে। বসব?’
‘বসুন।’
‘শুরু করব?’
‘কী শুরু করতে চাচ্ছেন?’
‘জীবন-কাহিনী। আমার বাবা কি করে আমাকে মহাপুরুষ বানানো চেষ্টা করতে লাগলেন, তিনি কতটুকু পারলেন, কতটুকু পারলেন না। অর্থাৎ ঐ রাতে যেখানে শেষ করেছিলাম, সেখান থেকে শুরু…’
‘হিমু সাহেব।’
‘জ্বি?’
‘আমার একটি মেয়ে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে পড়ে আছে। আপনি সেই খবর খুব ভাল করেই জানেন। ওর এখন স্কিন গ্রাফটিং হচ্ছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় থেকে চামড়া কেটে লাগানো হচ্ছে। আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। রোগী দেখছি না। কিছু করার নেই বলে চেম্বারে এসে বসেছি।’
‘আমি তা হলে চলে যাই?’
‘এসেছেন যখন বসুন। আমার কাছে আপনার একটি ডিনার পাওনা আছে। আসুন, আমরা একসঙ্গে ডিনার করি। ঘরে সাত দনি ধরে রান্নাবান্না হচ্ছে না। আমার স্ত্রী থাকেন হাসপাতালে, কাজেই আমরা কোনো-একটা হোটেলে বসব। আপনার আপত্তি আছে?’
‘না, আপত্তি নেই।’
‘চলুন তাহলে ওঠা যাক।’
আমরা গুলশান এলাকার একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। ডাক্তার সাহেব বললেন, এই রেস্টুরেন্টটা ছোট, কিন্তু খুব ভাল। এদের কুক একজন ভিয়েতনামি মহিলা। তিনি খাবার তৎক্ষণাৎ তৈরি করে দেন। আপনি কি খাবেন মেনু দেখে অর্ডার দিন। আমি নিজে শুধু একটা স্যুপ খাব। আপনি কি মদ্যপান করেন?
‘জ্বি-না।’
‘বিয়ার? বিয়ার নিশ্চয়ই চলতে পারে।’
‘আপনি খান। আমার লাগবে না।’
বিয়ারের ক্যান খুলতে-খুলতে ডাক্তার সাহবে বললেন, আমি আপনার একটি বিষয় জানার জন্যে আগ্রহী। আপনার ভবিষ্যৎ বলার ক্ষমতা কি সত্যি আপনার আছে?
‘আমি ঠিক জানি না। মাঝে-মাঝে যা ভাবি তা হয়ে যায়। সে তো সবারই হয়। আপনারও নিশ্চয়ই হয়?’
‘না, আমার হয় না?’
‘অবশ্যই হয়। ভাল করে ভেবে দেখুন—এরকম কি হয় না যে আপনি দুপুরে বাসায় ফিরছেন—আপনার মনে হল আজ বাসায় বেগুন দিয়ে ইলিশ মাছ রান্না হয়েছে। খেতে বসে দেখেন, সত্যি তাই।’
‘এটা হচ্ছে কো-ইনসিডেন্স।’
‘আমার ব্যাপারগুলিও কো-ইনসিডেন্স। এর বাইরে কিছু না।’
‘আপনি বলতে চাচ্ছেন আপনার কোনো ক্ষমতা নেই?’
‘না।’
ডাক্তার সাহেব তিনটি বিয়ার শেষ করে চতুর্থ বিয়ারের ক্যানে হাত দিলেন। মদ্যপান তিনি খুব অভ্যস্ত বলে মনে হচ্ছে না। চোখটোখ লাল হয়ে গেছে। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে।
‘হিমু সাহেব।’
‘জ্বি?’
‘আমার কিন্তু ধারণা, আপনার ক্ষমতা আছে। আপনার বাবা পুরোপুরি ব্যর্থ হননি—strange কিছু জিনিস আপনার ভেতর তৈরি করতে পেরেছেন। তার একটি হচ্ছে মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা। এই ক্ষমতা আপনার প্রচুর আছে।’
‘এই ক্ষমতা অল্পবিস্তর সবারই আছে।’
‘আপনাকে অনেক বেশি আছে। ইয়াদ সাহেবের সঙ্গে কি রিসেন্টলি আপনার দেখা হয়েছে?’
না।’
আপনি কি জানেন তিনি গত দু’দিন ধরে ভিক্ষুক সেজে পথে-পথে ঘুরছেন? দু’রাত বাড়ি ফেরেননি?’
‘না—জানি না।’
‘ইয়াদ সাহেবের স্ত্রী আপনি আসার কিছুক্ষণ আগেই আমার কাছে এসেছিলেন। ভদ্রমহিলা যে কী পরিমাণ মানসিক অর্ডিয়েলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন তা তাঁকে না দেখলে বিশ্বাস করা অসম্ভব।’
‘আপনি তাঁকে কী বলেছেন?’
‘বলেছি এটা সাময়িক ঝোঁক। ঝোঁক কেটে যাবে। ইয়াদ সাহেব বাসায় ফিরবেন। আপনার কি ধারণা হিমু সাহেব?’
‘কোন ধারণার কথা জানতে চাচ্ছেন?’
‘ইয়াদ সাহেব প্রসঙ্গে জানতে চাচ্ছি।উনার ঝোঁক কাটতে কতদিন লাবে?’
‘বলতে পারছি না। ঝোঁক নাও কাটতে পারে।’
‘তার মানে?’
খাওয়া বন্ধ করে আমি সিগারেট ধরাতে-ধরাতে বললাম, মানুষ খুব বিচিত্র প্রাণী ডাক্তার সাহেব। সে সারা জীবন অনেক কিছুই অনুসন্ধান করে ফেরে। সেই অনেক অনুসন্ধানের একটি হল—তার অবস্থান। সে কোথায় খাপ খায় তা জানতে চায়—সেই বিশেষ জায়গাটা যখন পেয়ে যায় তখন তাঁকে নড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে।
‘আপনি ভুলে যাচ্ছেন হিমু সাহেব, মানুষ খুব Rotional প্রাণী।’
‘মানুষ মোটেই Rational প্রাণী নয়। সমস্ত পশুপাখি, কীটপতঙ্গ Rational, মানুষ নয়।যখন বৃষ্টি হয়, পাখি তখন বুষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য গাছের নিচে আশ্রয় নেয়। এর কোনো ব্যতিক্রম নেই। মানুষের ভেতর ব্যতিক্রম আছে। এদের কেউ –কেউ ইচ্ছা করে বৃষ্টিতে ভেজে। কেউ-কেউ গাছের নিচে দাঁড়ায় ঠিকই,কিন্ত মন পড়ে থাকে বৃষ্টিতে। সে মনে-মনে ভিজতে থাকে।’
‘হিমু সাহেব।’
‘জ্বি?’
‘আপনি কিছুই খাচ্ছেন না। খাবারটা কি আপনার পছন্দ হচ্ছে না?’
‘জ্বি-না, সবকিছুর মধ্যে ধোঁয়া-ধোঁয়া গন্ধ পাচ্ছি।’
ডাক্তার সাহেব বিল মিটিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, আপনাকে কোথায় নামিয়ে দেব বলুন।
‘কোথাও নামাতে হবে না। আমি এখান থেকেই হেঁটে-হেঁটে চলে যাব।’
‘অনেকটা দুর কিন্ত।’
‘খুব দুর নয়। আবার কবে আপনার কাছে আসব,ডাক্তার সাহেব?’
‘আপনাকে আর আসতে হবে না। আমি আপনার চিকিৎসা করব না।’
‘আপনার কি ধারণা আমি অসুস্থ না?’
‘বুঝতে পারছি না। আচ্ছা, গূড নাইড।’
বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত একটা বেজে গেল। মেসের অফিসে বাতি জ্বালিয়ে জীবনবাবু বসে আছেন। আমাকে দেখেই বললেন, আপনার জন্যে বসে আছি হিমু ভাই। আপনাকে বলেছি না, আমি একটা ভয়ংকর বিপদে পড়েছি?
বিপদের কথাটা বলতে চান?
‘জ্বি।’
‘আসুন আমার ঘরে। বলুন।’
জীবনবাবু অনেকক্ষণ আমার ঘরের চৌকিতে বসে থেকে, কিছু না বলেই চলে গেলেন। খুব জাকিয়ে শীত পড়েছে। আমার ঘরের জানালার একটা কাঁচ ভাঙ্গা। শীতের ঠান্ডা হাওয়া বাতাস আসছে। জীবনবাবুকে বলতে মনে থাকে না। আজ কি বার? বৃহস্পতিবার? পাশের ঘরে তাস খেলা হচ্ছে। হৈচৈ শোনা যাচ্ছে। বিছানায় যাবার পর লক্ষ করলাম—মাথাধরা শুরু হয়েছে। ইরতাজুল করিম সাহেবকে এই মাথাধরার কথাটা বলা হয়নি।
টেলিফোন করার জায়গা পাচ্ছি না
টেলিফোন করার জায়গা পাচ্ছি না। গ্রীন ফার্মেসি বন্ধ। কম্পউটারের নতুন একটা সার্ভিস সেন্টার হয়েছে। ওদের টেলিফোন আছে—গেলেই টেলিফোন করতে দেয়। সার্ভিস সেন্টারটিও বন্ধ। এসছি তরঙ্গিণী স্টোরে। নতুন ছেলেটা আমাকে দেখেই বলল, টেলিফোন নষ্ট। মিথ্যা বলছে বোঝাই যাচ্ছে। বলার সময় মুখের চামড়া শক্ত হয়ে গেছে। সে মনে হয় আগেই থেকে ঠিক করে রেখেছিল—আমাকে দেখলেই বলবে,“টেলিফোন নষ্ট।”
আমি আন্তরিক ভঙ্গিতে বললাম, গোটা দশেক টাকা দিলে কি ঠিক হবে?
‘বললাম তো নষ্ট।’
‘আপনার চাকরি কতদিন হয়েছে?’
‘তা দিয়ে আপনের কী প্রয়োজন?’
‘কোনো প্রয়োজন নেই, এম্নি জিজ্ঞেস করছি। মুহিব এসেছিল এর মধ্যে?’
‘না।’
‘ওর ঠিকানা জানেন?’
‘না।’
‘আপনার ঠিকানা কি?’
‘আমার ঠিকানা দিয়ে কি করবেন?’
ছেলাটা কঠিন গলার স্বর বের করছে। একে বিরক্ত করতে ভাল লাগছে। কি করে আরো রাগিয়ে দেয়া যায় তাই ভাবছি।
‘আপনাদের এই দোকান খোলে কখন?’
‘খামাখা প্যাচাল পাড়তেছেন ক্যান। সওদা করার থাকলে সওদা করেন, নয়তো যান গিয়া।’
‘আপনার ঠিকানাটা তো এখনও বলেননি?’
‘আরে দুত্তেরি।’
আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললাম, বল পয়েন্ট কলম আছে? দেখান দেখি।
সে একটা কলম সামনে রাখল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে কলম দিয়ে খোঁচা মেরে সে যদি আমার চোখ গেলে দিতে পারত তাহলে খুশি হত।
‘দাম কত?’
‘দশ টাকা।’
‘বাংলাদেশি বল পয়েন্ট না?’
‘হুঁ।’
‘এগুলি তিন টাকা করে বাইরে বিক্রি হয়। আপনার এখানে দশ টাকা কেন?’
‘আপনে বাইরে থাইক্যা কিনেন।’
‘আমি আপনার এখান থেকে কিনতে চাচ্ছি। তিন টাকার জিনিস বেশি হলে চার টাকা হবে। তার চেয়েও বেশি হলে হবে পাঁচ। দশ টাকা কেন?’
‘দাম বেশি ঠেকলে নিবেন না।’
‘মানিব্যাগ খুলে আমি আমার শেষ সম্বল দশ টাকার নোটটা দিয়ে তিন টাকা দামের বল পয়েন্ট কিনে বের হয়ে এলাম। টাকার সন্ধানে যেতে হবে। মাসের প্রথম তারিখে ফুপা আমাকে চার’শ টাকা দেন। শর্ত একটাই—আমি কখনো তাঁর বাসায় যেতে পারব না। তাঁর ছেলে বাদল যেন কখনো আমার দেখা না পায়। ফুপার ধারণা, আমার প্রভাবে বাদলের সর্বনাশ হচ্ছে। বাদলকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় আমার কাছ থেকে দুরে রাখা। দু’মাস ফুপার কাছ থেকে টাকা নেয়া হয়নি।