দরজায় মিহি করে টোকা পড়ছে। জীবনবাবু কয়েক বার কেশে ফিসফিস করে ডাকলেন,হিমু ভাই! হিমু ভাই!
আমি চিঠি পড়া বন্ধ রেখে বললাম, কি হল জীবন বাবু?
‘নামটা মনে পড়েছে।’
‘বলুন। বলে বিদেয় হোন।’
‘এটা ছাড়াও আরো একটা কথা বলতে চাচ্ছি।’
‘কাগজে লিখে রাখুন। আমি পরে পড়ব।’
‘লিখে রাখতে গিয়েছিলাম—তারপর দেখি বল পয়েন্টে কালি নেই। আপনার কাছে কি বল পয়েন্ট আছে?’
আমি দরজা খুলে বললাম, লিখতে হবে না। মুখে বলুন, শুনে নিচ্ছি।
তরঙ্গিণী স্টোর থেকে মুহিব সাহেব এসেছিলেন।
‘কিছু বলেছেন?’
‘জ্বি-না, কিছু বললেনি।’
‘ও, আচ্ছা।’
‘প্রায় সারা দিন বসে ছিলেন। দুপুরে কিছু খানওনি। এক কাপ চা আনিয়ে দিয়েছিলাম—সেটাও খাননি।’
‘চা না খাওয়ারই কথা। মুহিব সাহেব চা পান সিগারেট কিছুই খান না। কি জন্যে এসেছিলেন কিছু বলেননি?’
‘জ্বি-না।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। এখন তা হলে যান।’
‘অন্য অরেকটা কথা হিমু ভাই। গোপন কথা।’
‘বলুন কি বলবেন?’
জীবনবাবু বসলেন। মাথা নিচু করে বসলেন। অসহায় বসার ভঙ্গি।
‘খুব বিপদে পড়েছি হিমু ভাই। ভয়ংকর বিপদ।’
‘বলুন।’
‘আজ থাক, অন্য একদিন বলব।’
‘আপনার মেয়ে ভাল আছে তো?’
‘জ্বি জ্বি । মেয়ে ভাল আছে। ওর কোনো সমস্যা নয়।মেয়েটার বিয়েও মোটামুটি ঠিকঠাক। সিরাজগঞ্জের ছেলে। কাপড়ের ব্যবসা আছে। অতসীকে দেখে পছন্দ করেছে। তিন লাখ টাকা পণ চাচ্ছে। দেব তিন লাখ টাকা। মেসবাড়িটা বেচে দেব। একটাই তো মেয়ে। আমিও একা মানুষ—মেয়ে বিয়ে দিয়ে বাকি জীবণটা হোটেলে কাটিয়ে দেব।বুদ্ধিটা ভাল না হিমু ভাই?’
‘হ্যাঁ, ভাল।’
‘আমি আজ উঠি, অন্য আরেকদিন এসে আমার বিপদের কথাটা বলব।’
‘আমাকে বললে আপনার বিপদ কি কমবে? যদি মনে করেন বিপদ কমবে, তা হলে বলুন। আর যদি বিপদ না কমে, শুধুশুধু কেন বলবেন?
রুপার চিঠির শেষটা আমার পড়া হল না। চিঠি ভাঁজ করে পকেটে রেখে দিলাম—আজ থাক। অন্য কোনো সময় পড়া যাবে।
বড় রাস্তার ফুটপাতে
বড় রাস্তার ফুটপাতে উবু হয়ে বসে বয়স্ক এক ভদ্রলোক ঠোঙ্গা থেকে বাদাম নিয়ে নিয়ে খাচ্ছেন। খাওয়ার ব্যাপারটায় বেশ আয়োজন আছে। খোসা থেকে বাদাম ছড়ানো হয়। খোসাগুলি রাখা হয় সামনে। ভদ্রলোক অনেকক্ষণ বাদামে ফুঁ দিতে থাকেন। ফুঁয়ের কারণে বাদামের গায়ে লেগে থাকা লাল খোসা উড়ে যায়। তখন তিনি অনেক উপর থেকে একটা একটা করে বাদাম তাঁর মুখে ফেলেন। আমি কৌতুহলী হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার মতো আরো কয়েকজন কৌতুহলী হয়েছে। তারাও দেখি দূর থেকে তাকিয়ে আছে।
ভদ্রলোক শেষ বাদামের টুকরো মুখে ফেলে উঠে দাঁড়ালেন। আমার দিকে তাকিয়ে আনন্দিত গলায় বললেন, ছোটমামা না?
আজ তিনিই প্রথম আমাকে চিনলেন। আমি চিনতে পারিনি। এখন চিনলাম—মোরশেদ সাহেব। ঐদিন স্যুট-টাই পরা ছিলেন, আজ পায়জামা পাঞ্জাবি চাদর। ভদ্রলোককে পায়জামা-পাঞ্জাবিতে আরো সুন্দর লাগছে।
‘কি করছিলেন মোরশেদ সাহেব?’
‘বাদাম খাচ্ছিলাম। অনেক দিন বাদাম খাই না। একটা ছেলে গরম-গরম বাদাম ভাজছিল। দেখে লোভ লাগল। দু’ টাকার কিনলাম। অনেকে হাঁটতে-হাঁটতে বাদাম খেতে পারে। আমি পারি না। ফুটপাতে বসে বাদাম খাচ্ছিলাম। লোকজন এমনভাবে তাকাচ্ছিলেন যেন আমি একটা পাগল।’
‘আপনি ভাল আছেন?’
‘জ্বি ছোটমামা ভাল।’
‘এষা, এষা কেমন আছে?’
‘মনে হয় ভালই আছে। আর খারাপ থাকলেও আমাকে বলবে না।’
‘আপনি গিয়েছিলেন কি এর মধ্যে গিয়েছিলেন ওর কাছে?’
‘আমি তো দু’-তিন দিন পরপর যাই। ও খুব বিরক্ত হয়। তার পরেও যাই।’
‘যান ভাল করেন। নিজের স্ত্রীর কাছে যাবেন না তো কার কাছে যাবেন?’
মোরশেদ সাহেব বিষণ্ন গলায় বললেন, এষাকে এখনও স্ত্রী বলা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না। ও উকিলের নোটিশ পাঠিয়েছে। ডিভোর্স চায়।
‘নোটিশ কবে পাঠিয়েছে?’
‘কবে পাঠিয়েছে সেই তারিখ দেখিনি। আমি পেয়েছি আজ। মন খুব খারাপ হয়েছে। আপনি হয়তো বিশ্বাস করবেন না ছোটমামা, নোটিশ পাওয়ার পর আমার চোখে পানি এসে গেল। সকালে যখন নাশতা খাচ্ছি তখন নোটিশটা এসেছে।
তারপর আর নাশতা খেতে পারি না। পরোটা ছিঁড়ে মুখে দিয়েছি। চাবাচ্ছি তো চাবাচ্ছিই, গলা দিয়ে আর নামছে না। এক ঢোক পানি খেলাম, যদি পানির সঙ্গে পরোটা নেমে যায়। পানে পেটে চলে গেল কিন্তু পরোটা মুখে রইল।’
‘আসুন মোরশেদ সাহেব, কোথাও গিয়ে বসি। আপনাকে ক্লান্ত লাগছে। সারা দিনই বোধহয় হাঁটাহাঁটি করছেন?’
‘জ্বি। দুপুরেও কিছু খাইনি। এমন খিদে লেগেছে। তারপর বাদাম কিনে ফেললাম দু’ টাকার। কিনতাম না, ছেলেটা গরম গরম বাদাম ভাজছিল। দেখে খুব লোভ লাগল।’
আমি ভদ্রলোককে নিয়ে গেলাম সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে। সময় কাটানোর জন্যে খুব ভাল জায়গা। জোড়ায়-জোড়ায় ছেলেমেয়ে গল্প করে। দেখতে ভাল লাগে। এরা যখন গল্প করে তখন মনে হয় পৃথিবীতে এরা দু’ জন ছাড়া আর কেউ নেই। কোনদিন থাকবেও না। ক্ষুধা-তৃষ্ণা, শীত-বর্ষা কোনোকিছুই এদের স্পর্শ করে না। একবার ঘোর বর্ষায় দু’জনকে দেখেছি ভিজে-ভিজে গল্প করছে। মেয়েটি কাজল পরে এসেছিল। পানিতে সেই কাজল ধুয়ে তাকে ডাইনীর মত লাগছিল। সেই ভয়ংকর দৃশ্যও ছেলেটির চোখে পড়ছে না। সে তাকিয়ে আছে মুগ্ধ চোখে।
‘মোরশেদ সাহেব।’
‘জ্বি?’
‘কিছু খাবেন? এখানে ভ্রাম্যমান হোটেল আছে, চা, কোল্ড ড্রিংস এমনকি বিরিয়ানীর প্যাকেট পর্যন্ত পাওয়া যায়।’
‘আমি কিছু খাব না। আচ্ছা ছোটমামাত, আপনি আমাকে মোরশেদ সাহেব ডাকেন কেন? আপনি আমার নাম ধরে ডাকবেন। আপনি হচ্ছেন এষার মামা।’
‘আচ্ছা তাই ডাকব। এখন বলুন তো দেখি—এষা আপনাকে ডিভোর্স দিতে চাচ্ছে কেন?’
‘আমি তো মামা অসুস্থ। খারাপ ধরণের এপিলেপ্সি। ডাক্তাররা বলেন গ্রান্ডমোল। একেকবার যখন অ্যাটাক হয় ভয়ংকর অবস্থা হয়। অসুখের জন্য চাকরি টাকরি সব চলে গেছে।’
‘অ্যাটাক কি খুব ঘন ঘন হয়?’
‘আগে হত না। এখন হচ্ছে।’
‘চিকিৎসা করাচ্ছেন না?’
‘চিকিৎসা তো মামা নেই। ডাক্তাররা কড়া ঘুমের অষুধ দেন। এগুলি খেয়ে-খেয়ে মাথা কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আমাদের বাসার সামনে কোনো আমগাছ নেই। কিন্তু যখনই আমি বাইরে থেকে বাসায় যাই তখনি আমি দেখি বিশাল এক আমগাছ।
‘চোখে দেখেন?’
‘জ্বি, দেখি। শুধু গাছটা দেখি তাই না, গাছে পাখি বসে থাকে,সেগুলি দেখি। ওরা কিচিরমিচির করে, সেই শব্দ শুনতে পাই’
‘বলেন কী!’
মোরশেদ সাহেব দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, একজন সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে কথা বলা দরকার। কিন্তু যেতে ইচ্ছা করে না। তার উপর শুনেছি ওরা অনেক টাকা নেয়। জমানো টাকা খরচ করে করে চলছি তো মামা। প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।
‘আমার চেনা একজন সাইকিয়াট্রিস্ট আছেন। আমি একদিন তাঁর কাছে আপনাকে নিয়ে যাব।’
‘জ্বি আচ্ছা।’
‘চলুন, আপনাকে বাসায় দিয়ে আসি।’
‘আমি এখন বাসায় যাব না মামা। উকিল নোটিশটা টেবিলে ফেলে এসেছি। বাসায় গেলেই নোটিশটা চোখে পড়বে। মনটা খারাপ হবে। এখানে বসে থাকতেই ভাল লাগছে।’
‘বেশ, তাহলে বসে থাকুন।’
মোরশেদ সাহেব ইতস্তত করে বললেন, মামা, আপনি কি একটু এষার সঙ্গে কথা বলে দেখবেন? কোনো লাভ হবে না জানি, তবু যদি একটু…’
‘আমি বলব।’
‘আমার একটা ক্যামেরা আছে। ক্যামেরাটা বিক্রি করে দেব বলে ঠিক করেছি। হাত এক্কেবারে খালি হয়ে এসেছে। দেখবেন তো কাউকে পাওয়া যায় কিনা। বিয়ের সময় কিনেছিলাম। এষার খুব ছবি তোলার শখ ছিল। ওর জন্যেই কেনা।’
‘আচ্ছা দেখব, ক্যামেরা বিক্রি করা যায় কিনা।’
‘থ্যাংকস মামা। আপনি সাইকিয়াট্রিস্ট ভদ্রলোকের সঙ্গেও একটু কথা বলবেন। কত টাকা নেন, এইসব।’
আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চলে এলাম। মোরশেদ সাহেব পা তুলে সন্ন্যাসীর ভঙ্গিতে বসে আছেন। দূর থেকে দৃশ্যটা দেখতে ভাল লাগছে। নীতু একজন সাইকিয়াট্রিস্টের ঠিকানা দিয়েছিল। কার্ডটা হারিয়ে ফেলেছি। নীতুর কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে একবার ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করে আসতে হবে।
নীতুর সাইকিয়াট্রিস্ট
নীতুর সাইকিয়াট্রিস্ট ভদ্রলোকের নাম ইরতাজুল করিম। নামের শেষে বি সি ডি অনেক অক্ষর।এতগুলি অক্ষর যিনি জোগাড় করেছেন তাঁর অনেক বয়স হবার কথা, কিন্তু ভদ্রলোক মধ্যবয়স্ক এবং হাসিখুশি। মুখে জর্দা দেয়া পান। বিদেশি ডিগ্রীধারী ভদ্র্রলোকেরা জর্দ্দা দেয়া পান খান না। আর খেলেও বাড়িতে চুপিচুপি খান। কেউ এলে দাঁত মেজে বের হন। এই ভদ্রলোক দেখি বেশ আয়েশ করে পান খাচ্ছেন। এবং পিক করে অ্যাশট্রেতে পানের পিক ফেলছেন। তাঁর চেম্বারটাও সুন্দর। অফিস-অফিস লাগে না, মনে হয় ড্রয়িংরুম। ডাক্তার সাহেবের ঠিক মাথার উপর ক্লদ মানের আঁকা water lily-র বিখ্যাত পেইনটিং-এর প্রিন্ট। প্রিন্ট দেখতেই এত সুন্দর, আসলটা না জানি কত সুন্দর! আমি ডাক্তার সাহেবের সামনের চেয়ারটায় বসলাম। ভদ্রলোক আমার দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, কেমন আছেন হিমু সাহেব?
‘জ্বি ভাল।’
‘ইয়াদ সাহেবের স্ত্রী মিসেস নীতু অনেক দিন আগেই আপনার ব্যাপারে আমাকে টেলিফোন করেছিলেন। তাও একবার না, দু’বার। তাদের মত ফ্যামিলি থেকে যখন দু’বার টেলিফোন আসে তখন চিন্তিত হতে হয়। আমি চিন্তিত হয়েই আপনার জন্যে অপেক্ষা করছি। আরাম করে বসুন তো।’
আমি নড়েচড়ে বসলাম। ডাক্তার সাহেব আমার দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, আসতে এত দেরি করেছেন কেন?
‘টাকাপয়সা ছিল না, তাই দেরি করেছি। আপনি কত টাকা নেন তা তো জানি না।’
‘আমি অনেক টাকা নিই। তবে টাকা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনার চিকিৎসার সমস্ত ব্যায়ভার মিসেস নীতু নিয়েছেন।’
‘আমি তাহলে অসুস্থ?’
‘উনার তাই ধারণা।’
‘আপনার কী ধারণা ডাক্তার সাহেব?’
‘আপনার সঙ্গে খানিকক্ষন কথাবার্তা না বল ধরতে পারব না।’
‘কথাবার্তা বললেই ধরতে পারবেন?’
‘হ্যাঁ পারব। পারা উচিত। অবশ্যি আমার প্রশ্নের উত্তরে আপনাকে সত্যি কথা বলতে হবে। আমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবেন না। অধিকাংশ লোক তাই করে—সাইকিয়াট্রিস্টদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে।’
‘বিভ্রান্ত করার চেষ্টা থেকেই তো আপনার ধরতে পারার কথা—লোকটি কী চায়? তার সমস্যা কি?’
‘ধরতে চেষ্টা করি। সব সময় পারি না। মানুষের ব্রেইন নিয়ে আমাদের কাজকর্ম—সেই ব্রেইন কেমন জটিল তা কি আপনি জানেন হিমু সাহেব?’
‘জানি না, তবে আঁচ করতে পারি।’
‘না, আপনি আঁচও করতে পারেন না। মানুষের ব্রেইনে আছে এক বিলিয়ন নিউরোন। এক-একটি নিউরোনের কর্মপদ্ধতি বর্তমানে আধুনিক কম্পুটারের চেয়ে জটিল। বুঝতে পারছেন কিছু?’
‘না।’
‘বুঝতে পারার কথাও না। এখন আমরা কথা বলা। শুরু করি। আপনি বেশ রিলাক্সড ভঙ্গিতে নিজের কথা বলুন তো শুনি। যা মনে আসে বলতে থাকুন। নিজের কথা বলুন, নিজের বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনের কথা বলুন, বন্ধুবান্ধবের কথা বলুন।চা খেতে-খেতে, সিগারেট খেতে-খেতে বলুন।’
‘আমাকে কি কৌচে শুয়ে নিতে হবে না?’
‘না, ঐসব ফ্রয়েডীয় পদ্ধতি বাতিল হয়ে গেছে। আপনি শুরু করুন।’
‘আপনার কি তাড়া আছে ডাক্তার সাহেব?’
‘না, আমার কোনো তাড়া নেই। অন্যসব রোগী বিদায় করে দিয়েছি। আপনি হচ্ছেন—বিশেষ এক রোগী, ভেরি স্পেশাল। চা দিতে বলি, নাকি কফি খাবেন?’
‘চা কফি কিছুই লাগবে না। যা শুনতে চাচ্ছেন বলছি। দু’ভাবে বলতে পারি—সাধারণভাবে কিংবা ইন্টারেস্টিং করে। কীভাবে শুনতে চান?’
‘সাধারণভাবেই বলুন। ইন্টারেস্টিং করার প্রয়োজন দেখছি না। আমার ধারণা এমনিতেই ইন্টারেস্টিং হবে।’
‘আমি কি পা উঠিয়ে বসতে পারি?’
‘পারেন।’
আমি জীবন-ইতিহাস শুরু করলাম।
‘ডাক্তার সাহেব, আমার বাবা ছিলেন একজন অসুস্থ মানুষ। সাইকোপ্যাথ। এবং আমার ধারণা খুব খারাপ ধরনের সাইকোপ্যাথ। তাঁর মাথায় কি করে যেন ঢুকে গেল—মহাপুরুষ তৈরি করা যায়। যথাযথ ট্রেনিং দিয়েই তা করা সম্ভব। তাঁর যুক্তি হচ্ছে—ডাক্তার , ইনজিনীয়ার, ডাকাত, খুনী যদি শিক্ষা এবং ট্রেনিং-এ তৈরি করা যায়, তাহলে মহাপরুষ কেন তৈরি করা যাবে না? অসুস্থ মানুষদের চিন্তা হয় সিঙ্গেল ট্র্যাকে। তাঁর চিন্তা সেইরকম হল—তিনি মহাপরুষ তৈরির খেলায় নামলেন। আমি হলাম তাঁর একমাত্র ছাত্র। তিনি এগুলেন খুব ঠাণ্ডা মাথায়। তাঁর ধারণা হল, আমার মা বেঁচে থাকলে তিনি তাঁকে এ-জাতীয় ট্রেনিং দিতে দেবেন না।
কাজেই তিনি মা’কে সরিয়ে দিলেন।’
‘সরিয়ে দিলেন মানে?’
‘মেরে ফেললেন।’
‘কী বলছেন এসব!’
‘আমি অবশ্যি মা’কে খুন হতে দেখিনি। তেমন কোনো প্রমাণও পাইনি। বাবা প্রমাণ রেখে খুন করবেন এমন মানুষই না। খুব ঠাণ্ডা মাথার লোক। তাঁর মাথা এত ঠাণ্ডা যে মাঝে মাঝে আমার মনে হয় হয়তো তিনি অসুস্থ ছিলেন না। অসুস্থ মানুষ এত ভেবেচিন্তে কাজ করে না। অসুস্থ মানুষের মাথা এত পরিষ্কার থাকে না।’
‘তারপর বলুন।’
‘আপনার কাছে কি ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে?’
‘অবশ্যই ইনটারেস্টিং, তবে আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আপনি আমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন।’
আমি হেসে ফেললাম।
ডাক্তার সাহেব বললেন, হাসছেন কেন?
আমি বললাম, গল্প বলে আমি আপনাকে বিভ্রান্ত করব না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। যা বলছি সবই সত্যি। আপনাকে গল্প ছাড়াই আমি বিভ্রান্ত করতে পারি।
‘করুন তো দেখি!’
আমি হাসিমুখে কিছুক্ষণ ডাক্তার সাহেবের দিকে তাকিয়ে সহজ গলায় বললাম, আপনার বাড়িতে এই মুহূর্তে একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। আপনার ছোট মেয়ে কিছুক্ষণ আগে তার পায়ে কিংবা হাতে ফুটন্ত পানি ফেলেছে। তাকে হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে।
‘আপনি আমাকে এই কথা বিশ্বাস করতে বলছেন?’
‘জ্বি, বলছি।’
ইরতাজুল করিম সাহেব অ্যাসট্রেতে পানের পিক ফেলতে ফেলতে বললেন, হিমু সাহেব, আপনি কি চান আমি বাসায় টেলিফোন করি?
‘করুন।’
ডাক্তার সাহেব টেলিফোন করতে লাগলেন,লাইন এনগেইজড্ পাওয়া যাচ্ছে। ডাক্তার সাহেবের চোখ-মুখ শক্ত হতে শুরু করেছে। তিনি রিসিভার নামিয়ে রাখছেন, আবার ডায়াল করছেন। আমি সিগারেট ধরিয়ে আগ্রহ নিয়ে ডাক্তার সাহেবকে দেখছি। ডায়াল করতে করতে তিনি আমার দিকে সরু চোখে তাকাচ্ছেন।
লাইন পেতে তাঁর দশ মিনিটের মতো লাগল। এই দশ মিনিটে তিনি ঘেমে গেলেন। কপাল ভর্তি ফোঁটা-ফোঁটা ঘাম। লাইন পাবার পর তিনি কাঁপা গলায় বললেন, কে, কে?
ওপাশের কথা শুনতে পাচ্ছি না। তবে ডাক্তার সাহেবের কথা থেকে বুঝতে পারছি ওপাশে তাঁর স্ত্রী ধরছেন।
ডাক্তার সাহেব বললেন, কেমন আছ? সবাই ভাল? শুচি কী করছে? টিভি দেখছে? আমার আসতে দেরি হবে। আচ্ছা রাখি।
তিনি রিসিভার নামিয়ে রেখে রাগী গলায় বললেন, আমার ছোটমেয়ে শুচি ভাল আছে। টিভি দেখছে। আপনি আমাকে ভয় দেখালেন কেন?
‘ভয় তো দেখাইনি! বিভ্রান্ত করেছি। আপনার মতো অতি আধুনিক একজন মানুষ আমার কথা বিশ্বাস করে আতঙ্কে অস্থির হয়ে গেলেন। কাজেই দেখুন—বিভ্রান্ত করতে চাইলে আমি করতে পারি। আমি কি আমার জীবনবৃত্তান্ত বলব, না আপনি উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন?’
‘বলুন। সংক্ষেপে বলুন। ডিটেইলসে যেতে হবে না”
‘সংক্ষেপেই বলছি—বাবা আমাকে মহাপুরুষ বানানোর কাজে লেগে গেলেন। আমাকে সংসার, চারপাশের জীবন, অপরূপ প্রকৃতি প্রসঙ্গে নিরাসক্ত করতে চাইলেন।’
‘কীভাবে?’
‘বুদ্ধি খাটিয়ে আসক্তি কাটানোর তিনি নানা পদ্ধিতি বের করেছিলেন। সংক্ষেপে বলতে বলছেন বলেই পদ্ধতিগুলি আর বর্ণনা করছি না।’
‘একটি পদ্ধতি বলুন।’
‘একবার বাবা আমার জন্যে একটা তোতা পাখি আনলেন। আমার বয়স তখন চার কিংবা পাঁচ। আমি পাখি দেখে মুগ্ধ। বাবা বললেন, তোতা খুব সহজে কথা শিখতে পারে। তুই ওকে কথা শেখা। রোজ এর কাছে দাঁড়িয়ে বলবি—হিমু, হিমু। একদিন দেখবি সে সুন্দর করে তোকে ডাকবে—হিমু। হি…মু….। আমি মহাউৎসাহে পাখিকে কথা শেখাই। একদিন সত্যি-সত্যি সে পরিষ্কার গলায় ডেকে উঠল—হিমু, হিমু। আমি আনন্দে কেঁদে ফেললাম। বাবা তখন পাখিটাকে খাঁচা থেকে বের করে একটানে মাথা ধড় থেকে আলাদা করে ফেললেন।’
ডাক্তার সাহেব চাপা গলায় বললেন, মাই গড!
আমি হাসিমুখে বললাম, আপনি চাইলে আরো দু’-একটা পদ্ধতির কথা বলতে পারি। বলব?
‘না, থাক। আমি আর শুনতে চাচ্ছি না।’
‘মানুষের চরিত্রের ভয়ংকর দিকগুলিও আমি যেন জানতে পারি বাবা সেই ব্যবস্থাও করলেন। কিছু ভয়ংকর ধরনের মানুষের সঙ্গে আমাকে বাস করতে পাঠালেন। তাঁরা সম্পর্কে আমার মামা। পিশাচদের সঙ্গে কাটিয়েছি। তবে মামারা আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। যাকে বলে অন্ধ স্নেহ। পাগলদের বিচিত্র মানিসকতা যেন আমি ধরতে পারি সে জন্যে তিনি প্রায়ই বাসায় পাগল ধরে নিয়ে আসতেন
যত্ন করে দু’দিন-তিন দিন রাখতেন। একজন এসেছিল ভয়াবহ উণ্মাদ। সে রান্নাঘর থেকে বটি এনে আমার গায়ে কোপ বসিয়েছিল। পিঠে এখনো দাগ আছে। দেখতে চান?’
‘না। আজ বরং থাক। আর শুনতে ভাল লাগছে না। এক সপ্তাহ পর ঠিক এই দিনে আবার কথা বলব। আমি ডাইরিতে লিখে রাখলাম। একটু রাত করে আসুন, দশটার দিকে।’
‘চলে যেতে বলছেন?’
‘হ্যাঁ, চলে যান। আমার নিজের শরীরও ভাল লাগছে না। মনে হচ্ছে আপনার গল্প আমাকে এফেক্ট করেছে। যাবার আগে শুধু বলে যান—আপনার বাবার এক্সপেরিমেন্ট কি সফল হয়েছে?’
আমি উঠে দাঁড়াতে-দাঁড়াতে বললাম—সফল হয়নি। বাবার এক্সপেরিমেন্টে ত্রুটি ছিল। তিনি মানুষের অন্ধকার দিকগুলিই আমাকে দেখাতে চেয়েছিলেন। আলোকিত দিক দেখাতে পারেননি। আমার প্রয়োজন ছিল ঈশ্বরের কাছাকাছি একজন মানুষ—যে আমাকে শেখাবে—ভালবাসা, আনন্দ, আবেগ এবং মঙ্গলময় মহাসত্য। আমি নিজে এখন সেইরকম মানুষই খুঁজে বেড়াচ্ছি। পাচ্ছি না। পেলে বাবার এক্সপেরিমেন্টের ফল দেখতে পারতাম।
‘আপনি বিশ্বাস করনে মহাপুরুষ হওয়া সম্ভব?’
‘হ্যাঁ, করি। ডাক্তার সাহেব, আর একটা কথা আপনাকে বলা দরকার। আমি কিন্তু মাঝে-মাঝে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি। কিছু-একটা বলি, তা লেগে যায়। আপনাকে যখন বললাম আপনার মেয়ে গরম পানিতে পুড়ে গেছে তখন আমি নিজে পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলাম যে তাই ঘটেছে। আপনি হয়ত লক্ষ করেননি যে আমি বলেছি আপনার সবচে’ ছোট মেয়ে। আমি জানতাম না আপনার কয়েকটি মেয়ে আছে।’
‘কাকতালীয় ব্যাপার, হিমু সাহেব।’
‘ঠিক কাকতালীয় নয়। আপনি কি আরেকবার টেলিফোন করে দেখবেন?’
‘না। আপনি একবার আমাকে বিভ্রান্ত করেছেন। আমি দ্বিতীয়বার আমাকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ আপনাকে দেব না। আপনি যথেষ্ট বুদ্ধিমান মানুষ, তবে আমাকে বোকা ভাবারও কারণ নেই।
আমি হেসে ফেলাম। ডাক্তার সাহের বলালেন, আপনি কোথায় যাবেন বলুন? আসুন আমার সঙ্গে, আপনাকে নামিয়ে দিব।
‘চলুন।’
বেশির ভাগ ডাক্তার নিজের গাড়ি নিজেই চালান। শিক্ষকরা যেমন সবাইকে ছাত্র মনে করেন, ডাক্তাররাও সেরকম সবাইকে রোগী ভাবেন। গাড়িও তাঁদের কাছে রোগীর মত। নিজের রোগী অন্যকে দিয়ে ভরসা পান না বলে নিজেদের গাড়ী নিজেরাই চালান। তবে ইনি ব্যতিক্রমী ডাক্তার। কারণ তাঁর গাড়ী ড্রাইভার চালাচ্ছে। তিনি হাত-পা ছড়িয়ে পেছনে সীটে বসেছেন। আমি তাঁর পাশে বসলাম।
‘পান খাবেন হিমু সাহেব?’
‘জ্বি-না।’
‘পান খাওয়ার এক বিশ্রী অভ্যাস এক রোগী আমাকে ধরিয়ে দিয়ে গেছে। আমি জন্মেও পান খেতাম না। সেই রোগী রূপার তৈরী এক পানের কৌটা বের করে বলল, পান খাবেন ডাক্তার সাহেব? আমি কৌটা দেখে মুগ্ধ হয়ে একটা পান নিলাম। সেই থেকে শুরু। এখন দিনরাত পান খাই। পান কেনা হয় পণ হিসাবে।’
‘সব বড় জিনিস ছোট থেকে শুরু হয়।’
‘ঠিক বলেছেন—You start by killing a bird, you end by killing a man. আপনি নামবেন কোথায়?’
‘যে-কোনো একজায়গায় নামিয়ে দিলেই হবে।’
‘সে কী। পাটিকুলার কোথাও নামতে চান না?’
‘জ্বি-না। আচ্ছা ডাক্তার সাহেব, আমার এক বন্ধুকে কি আপনার কাছে নিয়ে আসতে পারি?’
‘অবশ্যই পারেন। উনিও কি আপনার মতো?’
‘না। আমার কেউ কারো মতো নই ডাক্তার সাহেব। আমরা সবাই আলাদা।’
‘আমার কাছে আনতে চাচ্ছেন কেন?’
‘ঐ ভদ্রলোকের একটা সমস্যা আছে। উনি থাকেন খিলগাঁয়। একতলা বাসা। উনার বাড়ির সামনে কোনো গাছপালা নেই। কিন্তু উনি সবসময় বাড়ির সামনে একটা প্রকাণ্ড আমগাছ দেখেন। এর মানে কি?’
‘ভদ্রলোককে একবার নিয়ে আসবেন।’
‘আচ্ছা, আনব।’
‘হিমু সাহেব।’
‘জ্বি?’
‘চলুন আমার সঙ্গে। আমার বাসায় চলুন—একসঙ্গে ডিনার করব। আপত্তি আছে?’
‘না, আপত্তি নেই।’
আমরা ধানমণ্ডি তিন নাম্বার রোডে কম্পাউন্ড দেয়া দোতলা বাসার সামনে থামলাম। গেটটা খোলা। গেটের সামনে জটলা হচ্ছে। জানা গেল—এই বাড়ির ছোট মেয়েটা কিছুক্ষণ আগে গরম পানির গামলায় পড়ে ঝলসে গেছে। তাকে অ্যাম্বুলেন্স এসে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। ডাক্তার ইরতাজুল করিম ছুটে ভেতরে চলে গেলেন। আমি একা-একা দাঁড়িয়ে রইলাম।
ডাক্তার সাহেব প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ফিরলেন। যান্ত্রিক গলায় বললেন,চেম্বার থেকে ফিরে আমি সবসময় গরম পানিতে গোসল করি। ঘরে ওয়ার্টার হীটার আছে। আজই হীটারটি কাজ করছিল না বলে আমার জন্যে পানি গরম করেছে।
আমি বললাম, খুব বেশি পুড়েছে?
ডাক্তার সাহেব নিচু গলায় বললেন, হ্যাঁ। তাকে অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতালে নেয়া হয়েছে।
‘চলুন, আমারাও হাসপাতালে যাই।’
ডাক্তার সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, আপনাকে হাসপাতালে যেতে হবে না। সরি, আপনাকে আজ ডিনার খাওয়াতে পারছি না।
মোরশেদ সাহেব
মোরশেদ সাহেব সম্ভবত বাসায় ফেরেননি। এখন সবে সন্ধ্যা। যাদের ঘরে কোনো আকর্ষণ নেই তারা সন্ধ্যাবেলা ঘরে ফেরে না। ঠিক সন্ধ্যায় তারা একধরনের অস্থিরতায় আক্রান্ত হয়। এই অস্থিরতা শুধু মানুষের বেলাতেই যে হয় তা না—পশুপাখিদের ক্ষেত্রেও হয়। সেই কারণেই হয়তো সব ধর্মে সন্ধ্যা হল উপাসনার সময়। মনের অস্থিরতা দুর করে মনকে শান্ত করার এক বিশেষ প্রক্রিয়া। পরম রহস্যময় মহাশক্তির কাছে আবেদন—আমাকে শান্ত কর। আমার অস্থিরতা দূর কর।
দিনের কর্ম সাধিতে সাধিতে ভেবে রাখি মনে মনে
কর্ম অন্তে সন্ধ্যাবেলায় বসিব তোমারি সনে।
খোলা গেট দিয়ে ঘরে ঢুকলাম। ঘর অন্ধকার, তবে দরজার তালা নেই। কয়েকবার ধাক্কা দিতেই মোরশেদ সাহেব দরজা খুলে দিলেন। মুখ শুকিয়ে কালো হয়ে আছে। মাথা ভেজা।
‘কি ব্যাপার মোরশেদ সাহেব?’
‘কিছু না ছোটমামা। আসুন, ভেতরে আসুন।’
‘শরীর খারাপ?’
‘জ্বি, দুপুরে একবার এপিলেপটিক সিজার হল। মেঝেতে পড়েছিলাম। ঘরে কেউ ছিল না।’
‘একা থাকেন?’
‘জ্বি।’
‘বাতি জ্বালাননি কেন? সন্ধ্যাবেলা বাড়িঘর অন্ধকার দেখলে ভাল লাগে না।’
মোরশেদ সাহেব বাতি জ্বালালেন । আমি বসতে-বসতে বললাম, আপনার আত্মীয়স্বজন কেউ নেই? ওদের কাউকে সঙ্গে এন রাখতে পারেন না? আপনি অসুস্থ মানুষ। একজন কারো তো আপনার সঙ্গে থাকা দরকার।
‘ছোটভাই আছে। সে কানডায় থাকে। ছোটবোন ঢাকাতেই আছে। ওর নিজের স্বামী-সংসার আছে। ওকে বিরক্ত করতে ইচ্ছা করে না। আমি হলাম সবার বড়।’
‘এষার সঙ্গে কি এর মধ্যে দেখা হয়েছে?’
‘জ্বি, দেখা হয়েছে। ও এসেছি।’
‘নিজেই এসেছিল।–বাহ্, ভাল তো।’
‘ওর দাদীমাকে নিয়ে এসেছিল। আমাকে বোঝাল যে ডিভোসই আমাদের দু’জনের জন্যে মঙ্গলজনক। আমিও দেখলাম এষা ঠিকই বলছে। তা ছাড়া বেচারি আমার সঙ্গে থাকতে চাচ্ছে না। আমি তো জোর করে কাউকে ধরে রাখতে পারি না।’
‘তা তো বটেই। পশুকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা যায়, মানুষকে যায় না।’
‘আমি এষার সঙ্গে ম্যারিজ রেজিস্ট্রারের অফিসে গিয়ে কাগজপত্র সই করে এসেছি।’
‘ভাল করেছেন।’
‘এষার জন্যে হয়ত ভাল করেছি, আমার জন্যে না। আমার মনটা খুব খারাপ। মামা, আপনাকে চা করে দি। ঘরে আর কিছু নেই—শুধু চা।’
‘শুধু চা’ই দিন। রান্নাবান্না কি আপনি নিজেই করেন?’
‘চা-টা নিজেই বানাই, বাকি খাবার হোটেল থেকে খেয়ে আসি। সেখানেও বেশিদিন যাওয়া যাবে না। গেলেই টাকার জন্যে তাগদা দেয়। আচ্ছা মামা, আমার ক্যামেরাটা বিক্রির ব্যবস্থা করেছেন? এর সঙ্গে আলাদা একটা ঝুম লেন্স আছে। লেন্সটা আমার ভাই কানাডা থেকে পাঠিয়েছে।’
‘আপনার ভাইয়ের কাছে কিছু টাকা চেয়ে চিঠি লিখলে কেমন হয়?’
‘না না, তায় হয় না। ছোট ভাই তো। আপনি ক্যামেরা বিক্রির ব্যবস্থা করে দিন।’
‘ক্যামেরা বিক্রির টাকা যখন শেষ হয়ে যাবে তখন কী করবেন?’
‘আমি বেশিদিন বাঁচব না, ছোটমামা। আমার শরীর খুব খারাপ। নতুন একটা উপসর্গ দেখা দিয়েছে। আগে ছিল না।’
‘কি উপসর্গ?’
‘মাথার ভেতরে ঝিঝি পোকা ডাকে। ঝিঁঝি শব্দ হয়। সবসময় যদি হত তা হলে আমি অভ্যস্ত হয়ে যেতাম। সবসময় হয় না। মাঝে-মাঝে হয়।’
আমি চা খেলাম। মোরশেদ সাহেবের ঘর-দুয়ার দেখলাম। একা মানুষ, কিন্তু ঘর খুব সুন্দর করে সাজানো। দেখতে ভাল লাগে।
‘মোরশেদ সাহেব।’
‘জ্বি ছোটমামা?’
‘আপনার ঘর তো খুব সুন্দর করে সাজানো। দেয়ালে ছবি নেই কেন? আপনার এত দামী ক্যামেরা। ঘরভর্তি ছবি থাকা উচিত।’
‘ছবি ছিল। অনেক ছবি ছিল। সব এষার ছবি। এষা বলল, আমার ছবি দিয়ে ঘর ভর্তি করে রাখার তো কোনো মানে নেই। তোমার এখন উচিত আমাকে দ্রুত ভুলে যাওয়া। ছবি থাকলে তুমি তা পারবে না। তা ছাড়া তুমি নিশ্চয়ই আবার বিয়ে করবে। তোমার নতুন স্ত্রী আমার ছবি দেখলে রাগ করবে। ছবিগুলি তুমি আমাকে দিয়ে দাও। আমি দিয়ে দিলাম।’
‘ভাল করছেন। চলুন আমরা এখন বের হই।’
‘কোথায় যাব?’
‘আমার একটা চেনা ভাতের হোটেল আছে, আপনাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আসি। ওদের রান্না খুব ভাল। তারচে’ বড় কথা—বাকিতে খাওয়া যাবে। মাস পুরালেই টাকা দিতে হবে তাও না। একসময় দিলেই হবে।’
মোরশেদ সাহেব উজ্জ্বল মুখে বলল, চলুন। ক্যামেরাটা কি এখন দিয়ে দেব?
‘দিন।’