ভেবেছিলাম তোমার জন্মদিনে উদ্ভট কিছু করে তোমাকে চমকে দেব। কি করা যায় অনেক ভাবলাম। দামী গিফ্টের কথা একবার মনে হয়েছিল। গিফ্টের ব্যাপারে তোমার আসক্তি নেই—মাঝখান থেকে টাকা নষ্ট হবে। তারপর ভাবলাম সব ক’টি দৈনিক পত্রিকায় একপাতার বিজ্ঞাপন দিই—বিজ্ঞাপনে লেখা থাকবে—শুভ জন্মদিন হিমু। বাবার ম্যানেজার সাহেবকে ডেকে এনে বললাম পরিকল্পনার কথা। শুনে তাঁর চোয়াল ঝুলে পড়ল। তিনি হাঁ করে তাকিয়ে আছেন তো তাকিয়েই আছেন। আমি বললাম—পরিকল্পনাটা আপনার কাছে ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে না?
তিনি বললেন, হচ্ছে।
আমি বললাম, তাহলে খোঁজ নিয়ে বলুন কত লাগবে। আমি চেক লিখে দিচ্ছি।
তিনি বললেন,হিমু লোকটা কে?’
‘আমার চেনা একজন। পাগলা ধরনের মানুষ।’
তিনি মাথা চুলকে বললেন, পাগলা ধরনের একজন মানুষের জন্মদিনের কথা যত কম লোক জানে ততই ভাল। দেশসুদ্ধ লোককে জানিয়ে লাভ কি?
ম্যনেজার চাচার কথা আমার মনে ধরল। আসলেই তো, সবাইকে জানিয়ে কী হবে? যার জানার কথা সেই তো জানবে না। তুমি নিজেই তো পত্রিকা পড় না। ম্যনেজার চাচা বললেন, মা, তুমি সুন্দর দেখে একটা কার্ড কিনে লিখে দাও—হ্যাপি বাথ ডে। আমি অনাকে দিয়ে আসব। এক শ’ টাকার মধ্যে গোলাপের তোড়া পাওয়া যায়, ঐ একটাও না হয় সঙ্গে দিয়ে দিব।
আমি বললাম, আচ্ছা, তাই করব।
ম্যনেজার চাচা চলে গেলেন যাবার সময় অদ্ভুত চোখে আসার দিকে তাকাতে লাগলেন, যেন আমার নিজের মাথার সুস্থতা বোধ করছি। নানান ধরনের ছোটখাটো পাগলামি করছি। ইচ্ছা করে যে করছি তা নয়। সেদিন বাবার সঙ্গে ঝগরা করলাম। আমার ছো্টমামা স্টেটস থেকে মেম-বউ নিয়ে দেশে এসেছেন। সেই মেমসাহেবের সস্মানে পাটি। সবাই সেজেগুজে তৈরি হয়ে আচ্ছে। আমি নিজেও খুব সেজেছি। গয়নাটয়না পরে একটা কান্ড করেছি—গাড়িতে ওঠার সময় কী যে হল, আমি বললাম, আমার যেতে ইচ্ছে করছে না।
বাবা বললেন, তার মানে কি?
আমি বললাম, আমার রিসিপশনে যেতে ভাল লাগছে না।
‘তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?’
‘না, শরীর খারাপ লাগছে না—শুধু যেতে ইচ্ছে করছে না।’
বাবা বললেন, তুমি আমার সঙ্গে ড্রয়িংরুমে আস। আমি তোমাকে কয়েকটা কথা বলব।
সবাই গাড়ি- বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল। বাবা আমাকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে গেলেন। স্কুলের হেডমাষ্টারদের মতো গলার বললেন, সিট ডাউন ইয়াং লেডি।
আমি বসলাম। বাবা বললেন, তোমার ছোটমামাকে যে পার্টি দেয়া হচ্ছে সেই পার্টি আমরা দিচ্ছি। আমরা হচ্ছি হোস্ট। কাজেই আমাদের উপস্থিত থাকতেই হবে। তোমার শরীর খারাপ থাকলে তোমাকে কিছু বলতাম না। তোমার শরীর ভাল আছে। তোমার যেতে ইচ্ছে করছে না, সেটা বুঝতে পারছি। অনেক সময় আমাদের অনেককিছু করতে ইচ্ছা করে না। তবু আমরা করি। মানুষ হয়ে জন্মালে সামাজিক রীতিনীতি মানতে হয়। এখন চল আমার সঙ্গে – সবাই দাঁড়িয়ে আছে।
আমি বললাম, না।
বাবা খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। আমি বুঝতে পারছি ভেতরে-ভেতরে রাগে তিনি কাঁপছেন। তার পরেও রাগ সমলে নিয়ে বললেন, রূপা, তুমি না হয় খানিক্ষণ থেকে চলে এসো।
আমি আবারো বললাম, না। বাবা আর কিছু বললেন না। আমাকে রেখে চলে গেলেন। খালি বাসায় আমি একা। তখন আবার মনে হল—কেন যে থাকলাম, চলে গেলেই হত।
হিমু, আমি এরকম হয়ে যাচ্ছি কেন বল তো? ইদানীং বিকট-বিকট সব দুঃস্বপ্ন দেখছি। শুধু যে বিকট তাই না—নোংরা সব স্বপ্ন। এত নোংরা যে ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। কি দেখি জান? দেখি লম্বা রোগা বিকলাঙ্গ একজন মানুষ সমনে মগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার সারা গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করছে।কুষ্ঠ রোগীর হাতের মত হাত। তার হাত থেকে পুঁজ,রক্ত আমার সারা গায়ে লেগে যাচ্ছে। চিৎকার করে জেগে উঠি। সারা গা ঘিনঘিন করতে থাকে। আমি বাথরুমে ঢুকে সাবান দিয়ে গা ধুই। হিমু, আমার কি হচ্ছে বল তো? আমার মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে কিনা কে জানে। তোমার সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয় না। দেখা হলে বলতাম, আমার হাতটা একটু দেখে দাও তো!
কোথায় জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাব তা না, আজেবাজে সব কথা বলে সময় নষ্ট করছি। জন্মদিনের শুভেচ্ছা নাও। আমি কথার কথা হিসেবে শুভেচ্ছা বলছি না।আমি মনেপ্রাণে কামনা করছি। তোমার দিন সুন্দর হোক।
রাতে দরজা-জানালা বন্ধ করে আমি অনেকক্ষণ তোমার জন্যে প্রার্থনা করেছি, যেন তুমি সুখে থাক। মধ্যবিত্তের সহজ সুখ নয়—অসাধারণ সুখ—খুব অল্প মানুষই যে-সুখের সন্ধান পায়।
তোমার সঙ্গে অনেকদিন আমার দেখা হয় না। এবার দেখা হলে কী করব জান? এবার দেখা হলে তোমাকে যশোর নিয়ে আসব। এখানে আমাদের একটা খামারবাড়ি আছে। বাংলো প্যার্টের্নের বাড়ি। চারদিক গাছ-গাছড়ায় ঢাকা। বাড়ির সামনেই পুকুর। তোমাকে ঐ খামারবাড়িতে নিয়ে যেতে চাই—একটা জিনিস দেখানোর জন্যে—সেটা হচ্ছে—পুকুরের পানি কত পরিষ্কার হতে পারে সেটা স্বচক্ষে দেখা। শীত-বর্ষা, শরৎ-হেমন্ত সব সময় এই পুকুরের পানি কাঁচের মতো ঝকঝক করছে। আমি এই পুকুরের নাম দিয়েছি—‘অশ্রুদিঘি। বল তো কেন?’
আমার জীবনে অসংখ্য বাসনার একটি হচ্ছে কোনো-এক ভরা পূর্ণিমায় তোমার সঙ্গে অশ্রুদিঘিতে সাঁতার কাটব। অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে আমি সাতাঁর জানি না।
আচ্ছা হিমু, আমার এই চাওয়া কি খুব বড় কিছু চাওয়া? আমি কখনো কারো কাছে কিছু চাই না। ঠিক করেছি এ জীবনে কিছু চাইব না। আলাদীনের চেরাগের দৈত্য যদি হঠাৎ উপস্থিত হয়ে আমাকে বলে—রূপা, চট-চট করে বল। তোমার তিনটা ইচ্ছা আমি পূর্ণ করব। তাহলে মাথা চুলকে আমি বলব, স্যার থ্যাংক য্যু, আপনার কাছে আমার কিছু চাইবার নেই। আমার যা চাইবার তা চাইতে হবে হিমুর কাছে। ওকে একটু আমার কাছে এনে আপনি বিদেয় হোন। আপনার গা থেকে বিশ্রী গন্ধ আসছে।……