হে মানব সন্তান, তুমি তোমার ভালবাসা লু্কাইয়া রাখিও। তোমার পছন্দের
মানুষদের সহিত তুমি রুঢ় আচরণ করিও, যেন সে তোমার স্বরুপ কখনো
বুঝিতে না পারে। মধুর আচরণ করিবে দুজনের সঙ্গে। নিজেকে অপ্রকাশ্য
রাখার ইহাই প্রথম পাঠ।
আমাদের মেসে সকালবেলা চা হয় না। চা খেতে রাস্তার ওপাশে ক্যান্টিনে যেতে হয়। সেই ক্যান্টিনে পৃথিবীর সবচে’ মিষ্টি এবং একই সঙ্গে পৃথিবীর সবচে’ গরম চা পাওয়া যায়। এই চা প্রথম দু’ দিন খেতে খারাপ লাগে। কিন্তু তৃতীয় দিন থেকে নেশা ধরে যায়। ঘুম থেকে উঠেই কয়েক কাপ চা খেতে ইচ্ছা করে।
ক্যান্টিনে পা দেয়ার সঙ্গে-সঙ্গে দেখলাম ইয়াদ আবার আসছে। সে আমাকে দেখতে পেয়েছে। হয়তো আশা করছে আমি হাত ইশারা করে তাকে ডাকব। আমি কিছুই করলাম না। মুখ কঠিন করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম।
ইয়াদ সামনের চেয়ারে বসতে-বসতে বলল, তুই কাল রাতে আমাদের বাড়িতে একটা চিঠি ফেলে এসেছিলি। নিয়ে এসেছিলাম, দিতে ভুলে গেছি। আমি ইয়াদের হাত থেকে চিঠি নিয়ে পকেটে রেখে দিলাম।
ইয়াদ বলল, পড়বি না?’
‘একসময় পড়ব। তাড়া নেই।’
‘নীতু বলে দিয়েছে এটা নাকি জরুরি চিঠি।’
‘ও পড়েছে বুঝি?’
ইয়াদ অপ্রস্তুত গলায় বলল, মনে হয় পড়েছে। ওর খুব সন্দেহবাতিক। হাতের কাছে খাম পেলে খুলে পড়ে ফেলে। খামে যার নামই থাকুক সে পড়বেই। সরি।
‘তোর সরি হবার কিছু নেই। চা খাবি?’
‘খাব।’
আমি ইয়াদকে চা দিতে বলে উঠে দাঁড়ালাম। সে বিস্মিত হয়ে বলল,যাচ্ছিস কোথায়?
‘কাজ আছে।’
‘চা-টা শেষ করি—তারপর যা।’
‘সময় নেই—খুব তাড়া।’
আমি ইয়াদকে রেখে মেসে ফিরে এলাম। দরজা বন্ধ করে লেপের ভেতর ঢুকে পড়লাম। আজ আমার কোনো প্ল্যান নেই—সারাদিন ঘুমাব। ঘুম এবং উপবাস। সন্ধ্যায় উপবাস ভঙ্গ করব এবং বিছানা থেকে নামব।
বিশ্রামের সবচে’ ভাল টেকনিক হল—কুকুরকুণ্ডলী হয়ে শুয়ে পড়া। মায়ের পেটে আমরা যে-ভঙ্গিতে থাকি—সেই ভঙ্গিটি নিয়ে আসা। মায়ের পেটে গাঢ় অন্ধকার। তাপ হতে হবে সামান্য বেশি। কারণ জরায়ুর তাপ শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে তিন ডিগ্রী বেশি।
আমার ঘর এম্নিতেই অন্ধকার। কম্বলে নাক-মুখ ঢেকে অন্ধকার আরও বাড়ানো হল। আমি কুণ্ডলী পাকিয়ে শোয়ামাত্র দরজার কড়া নাড়ল। আমাদের মেসের মালিক এবং ম্যানেজার জীবনবাবু মিহি গলায় ডাকলেন—হিমু ভাই, হিমু ভাই।
জীবনবাবুর ডাকে সাড়া দিতেই হবে এমন কোনো কথা নেই, তিনি আমার কাছে মেসভাড়া পান না। মাসের শুরুতেই ভাড়া দেয়া হয়েছে। ইচ্ছা করলেই চুপচাপ শুয়ে থাকা যায়, তবে তা করা সম্ভব না। কারণ জীবনবাবুর ধৈর্য রবার্ট ক্লসের চেয়েও বেশি। তিনি ডাকতেই থাকবেন। কড়া নাড়তেই থাকবেন। সিল্কের মতো মোলায়েম গলায় ডাকবেন। চুড়ির শব্দের মতো শব্দে কড়া নাড়বেন।
‘হিমু ভাই, হিমু ভাই।’
‘কি ব্যাপার?’
‘ঘুমুচ্ছেন?’
‘যদি বলি ঘুমুচ্ছি তাহলে কি বিশ্বাস করবেন?’
‘একটু আসুন, বিরাট বিপদে পড়েছি।’
দরজা খুলতে হল। জীবনবাবু ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। ফিসফিস করে বললেন, মাথায় বাড়ি পড়েছে হিমু ভাই। অকুল সমুদ্র পড়েছি।
‘বলুন কি ব্যাপার?’
জীবনবাবু গলার স্বর আরো নামিয়ে ফেললেন। কোনো সাধারণ কথাই তিনি ফিসফিস না করে বলতে পারেন না। বিশেষ কিছু নিশ্চয়ই ঘটেছে, কারণ আমি তাঁর কোনো কথাই প্রায় শুনতে পারছি না।
‘আরেকটু জোরে বলুন জীবনবাবু। কিছু শুনতে পাচ্ছি না।’
‘প্রতি বৃহস্পতিবার মেসের ছয় নম্বর ঘরে তাসখেলা হয় জানেন তো?’
‘জানি।’
‘গত রাতে তাসখেলা নিয়ে মারামারি। মুর্শিদ সাহেব মশারির ডাণ্ডা খুলে জহির সাহেবের মাথায় বাড়ি মেরেছে। রক্তারক্তি কাণ্ড!’
‘আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, জহির সাহেব কি মারা গেছেন?’
‘মারা যায় নাই—তবে বেকায়দায় বাড়ি পড়লে উপায় ছিল? খুনখারাবি হলে পুলিশ আগে কাকে ধরত? আমাকে। আমি হলাম মাইনোরিটি দলের লোক। হিন্দু। সব চাপ যায় মাইনোরিটির উপর। আপনারা মেজরিটি হয়ে বেঁচে গেছেন।’
‘এইটাই আপনার বিশেষ কথা?’
‘জ্বি।’
‘আমাকে কিছু বলছেন? তাস ওদেরকে কি না-খেলতে বলব?’
‘না না, আপনার কিছু বলার দরকার নেই। ঘটনাটা আপনাকে জানিয়ে রাখলাম। খুনখারাবি যদি সত্যি কিছু হয়—তা হলে পুলিশের কাছে—আমার হয়ে দু’-একটা কথা বলবেন।’
‘আচ্ছা বলব। এখন তাহলে যান। আজ সারা দিন ঘুমাব বলে প্ল্যান করেছি। আজ হল আমার ঘুম-দিবস।’
জীবনবাবু নড়লেন না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি বললাম, আরো কিছু বলবেন?
‘জ্বি, বলব। মনে পড়ছে না। মনে করার চেষ্টা করছি।’
‘তেমন জরুরি কিছু নয়। জরুরি হলে মনে পড়ত।’
‘মনে পড়েছে—একজন মহিলা এসেছিলেন আপনার কাছে।’
‘রূপা?’
‘জ্বি-না—উনি না। উনাকে তো চিনি। যিনি এসেছিলেন তাঁকে আগে কখনো দেখেনি—নাম বলেছিলেন। নামটা মনে পড়ছে না। স্মৃতিশক্তি পুরোপুরি গেছে। মাইনোরিটির লোক তো—সারাক্ষণ টেনশনে থেকে থেকে ব্রেইন গেছে।’
‘মেয়েটা কিছু বলে গেছে?’
‘মেয়ে না তো, পুরুষমানুষ। আমাকে নাম বললেন, একবার না, কয়েকবার বললেন।’
‘আপনি দয়া করে বিদেয় হন।’
‘নামটা মনে করার চেষ্টা করছি। মনে পড়ছে না। বললাম না। আপনাকে—ব্রেইন একেবারে গেছে। কিছুই মনে থাকে না। ঐদিন দুপুরে ভাত খেতে গেছি—অতসী, বলল—বাবা, তুমি না একটু আগে ভাত খেয়ে গেল। বুঝুন অবস্থ। এদিকে ব্লাডপ্রেশারও নেমে গেছে। ব্রাডপ্রেশার হয়েছে সিক্সটি। সিক্সটি। সিক্সটি ব্লাডপ্রেশার মানুষের হয় না। গরু-ছাগলের হয়। গরু-ছাগলের পর্যায়ে চলে গেছি হিমু ভাই…’
জীবানবাবুকে বিদেয়ে করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। আশঙ্কা নিয়ে শুয়ে আছি। যে-কোনো মুহূর্তে ভদ্রলোকের নাম জীবনবাবুর মনে পড়বে।তিনি দরজায় ধাক্কা দিতে-দিতে ডাকবেন—হিমু ভাই, হিমু ভাই।
ঘুম আনার চেষ্টা করছি। লাভ হচ্ছে না। কোনোভাবেই শুয়ে আরাম পাচ্ছি না। বুকপকেটে রাখা খামটা খচখচ করছে। তার চিঠিটা পড়ে ফেলা দরকার।
চিঠি পড়ার মুহূর্ত আসছে না। প্রিয় চিঠি পড়ার জন্যে প্রয়োজন প্রিয় মুহূর্তের। আমার প্রিয় মুহূর্ত হল মধ্যরাত, যখন পৃথিবীর সব তক্ষক গম্ভীল স্বরে দু’ বার ডেকে ওঠে।
দরজায় আবার ঠকঠক শব্দ হচ্ছে। জীবনবাবু ডাকলেন—হিমু ভাই, হিমু ভাই।
আমি জবাব না দিয়ে রূপার চিঠি বের করলাম।
‘হিমু ভাই।’
‘বলুন। কথা কি মনে পড়েছে?’
‘জ্বি-না, মনে পড়েনি। অন্য একটা কথা বলতে এসেছি। বলব?’
‘বলুন।’
‘তাসখেলা নিয়ে উনাদের কিছু বলবেন না। রাগ করতে পারেন।’
‘আচ্ছা বলব না। আর শুনুন জীবনবাবু, এখন একটা জরুরি কাজ করছি—চিঠি পড়ছি। আমাকে বিরক্ত করবেন না। ঐ লোকের নাম মনে পড়লে—কাগজে লিখে ফেলবেন।’
‘জ্বি আচ্ছা।’
ঘরে চিঠি পড়ার মত আলো নেই—আধো আলো আধো আঁধার আমি চিঠি পড়ছি—