‘খুঁজে পাচ্ছি না। জরুরি প্রয়োজন।
দয়া করে যোগাযোগ কর। ভিডিও
ক্যামেরা কিনেছি।
ইয়াদ।’
দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ার সময় মনে হল রুপার চিঠি আমার সঙ্গে নেই।
নীতুদের বাসায় পুরানো কাপড়ের সঙ্গে ফেলে এসেছি। কাপড়গুলি ইতমধ্যে নিশ্চয়ই ধোপার বাড়িতে চলে গেছে।
মাথার যন্ত্রনা বাড়ছে। এই অসহ্য তীব্র যন্ত্রনার উৎস কি? তীব্র আনন্দ যিনি দেন, তীব্র ব্যথাও কি তাঁরই দেয়া? কিন্তু তা তো হবার কথা না। যিনি পরম মঙ্গলময়, ব্যথা তাঁর সৃষ্টি হতে পারে না।
পাশের ঘরে হৈচৈ হচ্ছে। তাসখেলা হচ্ছে নিশ্চয়ই। আজ বৃহস্পতিবার। সপ্তাহে এই একটা দিন মেসে তাস খেলা হয়। শুধু তাস না, অতি সস্তার বাংলা মদ আনা হয়। যারা এই জিনিস খান না, তাঁরাও দু’-এক চুমুক খান। সারা রাতই তাঁদের আনন্দিত কথাবার্তা শোনা যায়। এই আনন্দও কি তাঁর দেয়া?
ধুম-ধুম করে দরজায় কিল পড়ছে
ধুম-ধুম করে দরজায় কিল পড়ছে।
আমি ঘুমের ঘোরে বললাম, কে? কেউ জবাব দিল না। দরজায় শব্দ হতে থাকল। আমার সমস্যা হচ্ছে—শীতের ভোরে একবার লেপের ভেতর থেকে বের হলে আবার ঢুকতে পারি না। এখনো ঠিকমতো ভোর হয়নি—চারদিক আঁধার হয়ে আছে। কাঁচের জানালায় গাঢ় কুয়াশা দেখা যাচ্ছে। এত ভোরে আমার কাছে আসার মতো কে আছে ভাবতে-ভাবতে দরজা খুলে দেখি—ইয়াদ। এই প্রচণ্ড শীতে তার গায়ে একটা ট্রাকিং স্যুট। পায়ে কেড্স জুতা। নিশ্চয় দৌড়ে এসেছে। চোখ-মুখ লাল। বড়-বড় করে শ্বাস নিচ্ছে। ইয়াদ বলল, জগিং করতে বের হয়েছিলাম। ভাবলাম, একটা চান্স নিয়ে দেখি তোকে পাওয়া যায় কিনা।কতবার যে এসেছি তোর খোঁজে। এই ক’দিন কোথায় ছিলি?
আমি জবাব না দিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলাম। বাথরুমের দরজা ঠেলে ইয়াদও ঢুকে গেল। আমি মুখে পানি দিচ্ছি। ইয়াদ পাশে। সে বলল, ছিলি কোথায় তুই?
ইয়াদের স্বভাব-চরিত্রের একটি ভাল দিক হচ্ছে অধিকাংশ প্রশ্নেরই সে কোনো জবাব শুনতে চায় না। প্রশ্ন করা প্রয়োজন বলেই প্রশ্ন করে। জবাব দিলে ভাল, না দিলেও ক্ষতি নেই। সে প্রশ্ন করে যাবে তার মনের আনন্দে।
‘হিমু।’
‘কি?’
‘কাল রাতে আমার বউকে তুই খামোকা ভয় দেখালি কেন?’
‘ভয় দেখিয়েছে?’
‘অফকোর্স ভয় দেখিয়েছিস—তুই তাকে বললি আমি নাকি রাতে ফিরব না। এদিকে আমি সত্যি-সত্যি আটকা পড়ে গেলাম ছোটখালার বাসায়। ফিরতে ফিরতে রাত দু’টা বেজে গেছে। এসে দেখি নীতুর মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে—পরিচিত-অপরিচিত সব জায়গায় টেলিফোন করা হয়েছে। ম্যানেজারকে পাঠানো হয়েছে সব হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে আসতে। ম্যানেজার ব্যাটা গাড়ি নিয়ে বের হয়ে সেই গাড়ি ড্রেনে ফেলে দিয়েছে।
‘এই অবস্থা?’
‘হ্যাঁ, এই অবস্থা। নীতুর হাইপারটেনশান আছে। অল্পতেই এমন নার্ভাস হয়। ওর একজন পোষা সাইকিয়াট্রিস্ট আছে।দু’দিন পরপর তার কাছে যায়। একগাদা করে টাকা নিয়ে আসে।’
‘তোর তো টাকা খরচ করার পথ নেই—কিছু খরচ হচ্ছে, মন্দ কি?’
‘টাকা কোনো সমস্যা না, নীতুই সমস্যা। অল্পতেই এত আপসেট হয়—এই কারণেই তোকে খুঁজছি। নীতুকে সামলানোর ব্যাপারে কী করা যায়?’
‘সামলানোর দরকার কী?’
‘দরকার আছে। তোর প্রস্তাব আমি গ্রহণ করেছি। ভিখিরি হয়ে যাব। সাত দিনের ক্র্যাশ প্রোগ্রাম। সাত দিন ভিখিরি হয়ে ওদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরব। ভিক্ষা করব।’
‘সাত দিনে কিছু হবে না।’
‘কত দিন লাগবে?’
‘দু’ বছর।’
‘বলিস কী!’
‘ঠিকমতো ওদের জানতে হলে ওদের একজন হতে হবে। ওদের একজন হতে সময় লাগবে।’
‘নীতুকে সামলাবো কী করে?’
‘যারা ছোটখাট ঘটনাতে আপসেট হয় তারা বড় ঘটনায় সাধারণত আপসেট হয় না। নীতু সামলে উঠবে। আরো বেশি-বেশি করে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাবে। তুই ঘর ছাড়ছিস কবে?’
ইয়াদ বিরক্ত গলায় বলল, আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন? এটা তো তোর উপর নির্ভর করছে। আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত।তুই বললেই শুরু করব—তুই একটা ডেট বল। আমি নীতুকে বলি।
‘আমি ডেট বলব কেন?’
‘তুইও তো যাবি আমার সঙ্গে। আমি একা-একা পথে-পথে ভিক্ষা করব?’
‘হ্যাঁ, করবি। তোরই ভিক্ষুকদের জীবনচর্চা দরকার। আমার না।’
‘তুই আমার সঙ্গে যাচ্ছিস না?’
‘না।’
‘ও মাই গড! আমি তো ধরেই রেখেছি তুই যাচ্ছিস। সেইভাবেই প্রস্তুতি নিয়েছি।’
সকালবেলা খালিপেটে আমি সিগারেট খেতে পারি না। শুধুমাত্র বিরক্তিতে আমি সিগারেট ধরালাম। বিরক্তি ভাব গলার স্বরে যথাসম্ভব ফুটিয়ে তুলে বললাম—তুই ভিক্ষা করতে যাবি, সেখানেও একজন ম্যানেজার নিয়ে যেতে চাস? তুই ভিক্ষা করবি। তোর ম্যানেজার টাকাপয়সার হিসাব রাখবে। খাওয়াদাওয়া দেখবে। ইট বিছিয়ে আগুন করে পানি ফোটাবে যাতে তুই ফুটন্ত পানি খেতে পারিস। যা ব্যাটা গাধা!
ইয়াদ আহত গলায় বলল, গাধা বলছিস কেন?
‘যে যা তাকে তাই বলতে হয়। তুই গাধা, তোকে আমি হাতি বলব? যা বলছি, বিদেয় হ।’
‘চলে যেতে বলছিস?’
‘হ্যাঁ, চলে যেতে বলছি—আর আসিস না।’
‘আর আসব না?’
‘না। তোকে দেখলেই বিরক্তি লাগে।’
‘বিরক্তি লাগে কেন?’
‘বেকুবদের সঙ্গে কথা বললে বিরক্তি লাগবে না?’
‘গাধা বলছিস ভাল কথা, বেকুব বলছিস কেন?’
‘বাথরুমে ঢুকে পড়েছিস-এই জন্যে বেকুব বলছি।’
ইয়াদ বলল, ভুল করে বাথরুমে ঢুকে পড়েছি, খেয়াল করিনি। যাই।
আমি ওর দিকে না তাকিয়ে বললাম, আচ্ছা যা, আর আসিস না।’
ইয়াদ বের হয়ে গেল। আমার মনে হল এতটা কঠিন না হলেও বোধহয় হত। তবে আমার কাছ থেকে এ ধরণের ব্যবহার পেয়ে সে অভ্যস্ত। তার খুব খারাপ লাগবে না।লাগলেও সামলে উঠবে। ইয়াদকে আমার পছন্দ হয়। শুধু পছন্দ না, বেশ পছন্দ। রুঢ় ব্যবহার করতে হয় পছন্দের মানুষদের সঙ্গে। আমার বাবার উপদেশনামার একটি উপদেশ হল—