ইয়াদের বাড়ি একটা হুলস্থুল ব্যাপার।বাইরে থেকে মনে হয় জেলখানা। গেটটাও এমন যে বাইরে থেকে কিছূই দেখা যায় না। বড় গেট কখনো খোলা হয় না।বড় গেটের সঙ্গে আছে একটা খোকা গেট। অনেক ধাক্কাধাক্কির পর সেটা খোলা হয়। বাড়িতে ঢুকতে হয় মাথা নিচু করে। একবার ঢোকার পর সঙ্গে সঙ্গে ছুটে বের হয়ে যেতে ইচ্ছা করে—কারণ তীব্র বেগে দু’টা অ্যালসেশিয়ান ছুটে আসে। এদের একজন কুচকুচে কালো, অন্যজন ধবধবে শাদা। রঙ ভিন্ন হলেও এদের স্বভাব অভিন্ন, দু’জন ভয়ংকর হিংস্র, এদের একজনের নাম টুর্টি, অন্যজনের নাম ফুর্টি।
দারোয়ান বলে—চুপ টুর্টি-ফুর্টি। এরা চুপ করে, তবে এমনভাবে তাকায় যাতে মনে হয় যে-কোনো সুযোগে এরা ঘাড় কামড়ে ধরবে।
গেট থেকে বাড়ি পর্যন্ত যেতে খানিকক্ষণ বাগানের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হয়। সেই বাগানও দারুন বাগান। এদের বাড়ি দোতলা—সিড়ি মার্বেল পাথরের।বাড়ির বারান্দায় ইউ আকৃতিতে কিছু বেতের চেয়ার বসানো। মনে হয় প্রতিদিন চেয়ারগুলিতে রঙ করা হয়, কারণ যখনি আমি দেখি—ঝকঝক করছে। চেয়ারের গদিগুলির রঙ হালকা সবুজ। শাদা ও সবুজে যে এত সুন্দর কম্বিনেশন হয় তা ইয়াদদের বাড়িতে না এলে কখনো জানতে পারতাম না।
ঠিক মাঝখানের বেতের চেয়ারে নীতু বসে ছিল।নীতু হল নায়িকা-স্বভাবের মেয়ে। সব সময় সেজেগুজে থাকে এবং নায়িকাদের মতো চোখে থাকে সানগ্লাস। দিন-রাত সব সময়ই সানগ্লাস।তাকে যখনি দেখি তখনি মনে হয়—সে পার্টিতে যাচ্ছে, কিংবা পার্টি থেকে ফিরেছে।স্বাভাবিক ভঙ্গিতে এই মেয়েটিকে একবার আমার দেখতে ইচ্ছা করে। সেটা বোধহয় সম্ভব না। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়াল, হাসিমুখে বলল—যাক, আপনাকে তাহলে পাওয়া গেল! ও খুব ব্যাকুল হয়ে আপনাকে খুঁজছে।
‘ব্যাপার কি খোঁজ নিতে এলাম।’
‘ব্যাপার কি আমি জানি না, ভিক্ষুক সম্পর্কিত কিছু হবে। আমি জানতেও চাইনি। আপনাকে এমন লাগছে কেন?
‘কেমন লাগছে?’
‘মনে হচ্ছে ম্যানহোলের গর্তের কাজ করছিলেন—কাজ বন্ধ করে বেড়াতে এসেছেন। ফিরে গিয়ে আবার কাজ শুরু করবেন।’
‘এতটা খারাপ?’
‘হ্যাঁ, এতটাই খারাপ। আপনি কি গোসল করেন, না করেন না?’
‘শীতের সময় কম করি—।’
‘বাথটাবো গরম পানি দিলে আপনি কি গোসল করবেন?’
‘আমার প্রয়োজন নেই। নোংরা থাকতে ভাল লাগছে।’
‘নোংরা থাকতে ভাল লাগছে মানে! এটা কোন ধরণের কথা?’
‘রসিকতা করার চেষ্টা করছি।’
নীতু ঠোট বাঁকিয়ে বলল, রসিকতা বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে না। আপনি আসলেই নোংরা থাকতে ভালবাসেন। যাই হোক—আমার জন্যে হলেও দয়া করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে আসুন। আপনার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলি। আপনাক নতুন একসেট কাপড় দিচ্ছি। গায়ের কাপড় বাথটাবে রেখে আসবেন। ইস্ত্রি করে আপনার কাছে পাঠিয়ে দেয়া হবে।’
আমি হাসলাম। নীতু বলল, হাসবেন না। হাসির কোনো কথা বলিনি। যান, বাথরুমে ঢুকে পড়ুন। কুইক।
একদল মানুষ আছে—বাথরুম প্রেমিক। তারা অন্য কিছুতেই মুগ্ধ হয় না, বাথরুম দেখে মুগ্ধ হয়। আমি সেই দলে পড়ি না, কিন্তু ইয়াদের বাড়ির বাথরুমে ঢুকে খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে মনে-মনে বলি—‘এ কী!’ আজ আবার বললাম। বাথটাব ভর্তি পানি। সেই বাথটাব এতবড় যে ইচ্ছা করলে সাঁতার কাটা যায়। ডুব দেয়া যায়। গোসল করতে-করতে ‘সংগীত শ্রবণের’ ব্যবস্থা আছে। সংগীতের কন্ট্রোল অবশ্যি বাইরে। যে-রেকর্ড বাজানো হবে, স্পীকারের মাধ্যমে তা চলে আসবে বাথরুমে। এখন গান হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে আহত হতেন, কারণ বাথটাবে শুয়ে আমি শুনছি তাঁর মায়ার খেলা। সখী বলছে,
ওগো কেন, ওগো কেন মিছে এ পিপাসা।
আপনি যে আছে আপনার কাছে
নিখিল জগতে কী অভাব আছে—
আছে মন্দ সমীরণ, পুষ্পভূষণ, কোকিল, কুজিত কুঞ্জ।
প্রায় ঘণ্টাখানিক বাথরুমে কাটিয়ে বের হয়ে এলাম। গায়ে ধবধবে শাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি, একটা হালকা নীল উলের চাদর। পায়ে দিয়েছি চটিজুতো।সেগুলিও নতুন। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেরই লজ্জা লাগছে। নীতু বলল, বাহ, আপনাকে ভাল দেখাচ্ছে! আসুন, চা খেতে আসুন।
বিভিন্ন খাবারের জন্যে এদের বিভিন্ন ঘর আছে। চা খাবার জন্যে আছে টী-রুম। আমরা দু’জন টী-রুমে বসলাম। পটভর্তি চা। সঙ্গে অ্যাশট্রে এবং টিনভর্তি সিগারেট। নীতু বলল, চা নিন। সিগারেট নিন। যাবার সময় টিনটা নিয়ে যাবেন। এটা আপনার জন্যে।
‘আচ্ছা, নিয়ে যাব।’
‘এখন আপনার সঙ্গে আমি কিছুক্ষণ খোলামেলা কথা বলব। যা জানতে চাইব আপনি দয়া করে উত্তর দেবেন।’
‘দেব।’
‘ইয়াদ আপনার কি রকম বন্ধু?’
‘ভাল বন্ধু।’
‘ভাল বন্ধু যদি হয় তাহলে ওকে আপনি গাধা বলেছিলেন কেন?’
‘গাধা একধরণের আদরের ডাক। অপরিচিত বা অর্ধ-পরিচিতদের গাধা বলা যাবে না। বললে মেরে তক্তা বানিয়ে দেবে। প্রিয় বন্ধুদেরেই গাধা বলা যায়। এতে প্রিয় বন্ধুরা রাগ করে না। বরং খুশি হয়।’
‘আপনি কি জানেন ইয়াদ অন্য দশজনের মতো নয়? সে সবকিছু সিরিয়াসলি নেয়। আপনি গাধা বলায় সে সারা রাত ঘুমায়নি—জেগে বসে ছিল—একটা খাতায় নোট করছিল কেন তাকে গাধা বলা যাবে না।’
‘আমি হাসতে-হাসতে বললাম, সে যা করছিল গাধা বলার জন্যে তা কি যথেষ্ট নয়?’
‘না, যথেষ্ট নয়। ভবিষ্যতে কখনো তাকে গাধা বলবেন না এবং তার মাথায় কোন অদ্ভুদ আইডিয়া ঢুকিয়ে দেবেন না।’
‘আমি ওর মাথায় কোনো অদ্ভুদ আইডিয়া ঢোকাইনি।’
‘ঢুকিয়েছেন—আপনি ওকে বলেছেন ভিক্ষুকদের জানতে হলে ভিক্ষুক হতে হবে। ওদের সঙ্গে থাকতে হবে। ওদের মতো ভিক্ষা করতে হবে। বলেননি এমন কথা?’
‘বলেছি?’
‘আপনি তা বিশ্বাস করেন?’
‘করি।’
‘তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন, কেউ যদি পিঁপড়াদের সম্পর্কে গবেষণা করতে চায়, তা হলে তাকে পিঁপড়া হতে হবে, এবং পিঁপড়াদের সঙ্গে থাকতে হবে, পিঁপড়াদের খাবার খেতে হবে?’
‘ওদের ভালমতো জানতে হলে তাই করতে হবে, কিন্তু সে উপায় নেই। ভিক্ষুকদের ব্যাপারে উপায় আছে। তা ছাড়া পিঁপড়া মানুষ না, ভিক্ষুকরা মানুষ।’
‘আমি যে আপনাকে কী পরিমাণ অপছন্দ করি তা কি আপনি জানেন?’
‘না, জানি না।’
‘মাকড়সা আমি যতটা অপছন্দ করি আপনাকে তারচেয়ে বেশি অপছন্দ করি।আজ আমি বারান্দায় বসে ছিলাম। আপনি যখন আসছিলেন তখন ইচ্ছা করছিল—টুর্টি-ফুর্টিকে বলি—ধর্ ঐ লোকটাকে, ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো করে ফেল। বলেই ফেলতাম। নিজেকে সামলেছি। আমি নিজেকে কনট্রোল করেছি। আজ যা করেছি অন্য একদিন যে তা করতে পারব তা তো না। একদিন হয়তো সত্যি কুকুর লেলিয়ে দেব। নিন, আরেক কাপ চা খান।’
আমি আরেক কাপ চা নিলাম। নীতু বলল, আপনার সম্পর্কে অনেক গল্প প্রচলিত আছে।আপনি নাকি মহাপুরষজাতীয় মানুষ। মানুষের ভবিষ্যৎ বলতে পারেন। আমি তার একবিন্দুও বিশ্বাস করি না।
‘আমি নিজেও করি না।’
‘কিন্তু কেউ-কেউ করে।আপনার অদ্ভুদ জীবনযাপন প্রণালীর জন্যেই করে। নোংরা কাপড় পরে রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়ালেই মানুষ মহাপুরুষ হয় না। যদি হত, তা হলে ঢাকা শহরে তিন লক্ষ মহাপুরুষ থাকত। এই শহরে রাস্তায় ঘুরে-বেড়ানো মানুষের সংখ্যা তিন লক্ষ। বুঝতে পারছেন?’
‘পারছি।’
‘আপনার কোনো ক্ষমতা নেই তা বলছি না। একটা ক্ষমতা আছে। ভালই আছে। সেটা হল—সুন্দর করে কথা বলা। আপনি যা বলেন তা-ই সত্যি বলে মনে হয়। বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে। এই ক্ষমতা নিম্নশ্রেণীর ক্ষমতা। রাস্তায়-রাস্তায় যারা অষুধ বিক্রি করে তাদেরও এই ক্ষমতা আছে। আপনি যদি দাঁতের মাজন কিংবা সর্বব্যথানিবারণী অষুধ বিক্রি করেন তাহলে বেশ ভাল বিক্রি করবেন।’
নীতুর সঙ্গে অন্যদের এক জায়গায় বেশ ভাল অমিল আছে। রাগের কথা বলতে-বলতে অন্যদের রাগ পড়ে যায়। তার রাগ বাড়তেই থাকে। আস্তে-আস্তে মুখ লাল হতে থাকে। একসময়-সারা মুখ লাল টকটকে হয়ে যায়।এখন যেমন হয়েছে। নীতু বলল, আমি অনেক কথা বললাম, আপনি তার উত্তরে কিছু বলতে চাইলে বলতে পারেন।
‘আমি কিছু বলতে চাচ্ছি না।’
‘তা হলে আপনি কি স্বীকার করে নিলেন, আমি যা বললাম সবই সত্যি?’
‘হ্যাঁ।’
‘ইন দ্যাট কেইস আপনি কি আমার পরামর্শ শুনবেন?’
‘হ্যাঁ, শুনব।
‘আপনি একজন সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে কথা বলুন। আপনার মধ্যে যেসব অস্বাভাবিকতা আছে—একজন ভাল সাইকিয়াট্রিস্ট তা দূর করতে পারবে। আপনি অনেক দিন থেকেই মহাপুরুষের ভূমিকায় অভিনয় করছেন। অভিনয় করতে-করতে আপনার ধারণা হয়েছে আপনি একজন মহাপুরুষ।’
‘এরকম কোনো ধারণা আমার হয়নি।’
‘হয়েছে।ইয়াদের কাছে শুনেছি আপনি মজনু মিয়ার মাছ-ভাতের হোটেল নামে একটা হোটেলে ভাত খান। সেখানে এক রাতে বললেন—হোটেলের মালিক দু’ দিন হোটেলে আসবে না।এবং এই বলে কর্মচারীদের প্ররোচিত করলেন রোস্ট, পোলাওটোলাও রাঁধার জন্যে। করেননি?’
‘হ্যাঁ, করেছি।’
‘এগুলি হচ্ছে মহাপুরুষ সিনড্রম। নিজেকে আপনি অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ভাবতে শুরু করেছেন।’
‘মজনু মিয়া কিন্তু দু’ দিন ঠিকই হোটেলে আসেনি।’
‘তা আসেনি। কাকতালীয় ব্যাপার। মাঝে-মাঝে কাকতালীয় ব্যপার ঘটে। কেউ-কেউ সেসব ব্যাপার কাজে লাগাতে চেষ্টা করে, যেমন আপনি করেছেন। আপনি একজন অসুস্থ্ মানুষ। আপনার চিকিৎসা হওয়া দরকার।’
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, আমি চিকিৎসা করাব। আপনি সাইকিয়াট্রিস্টের ঠিকানা দিন।’
‘সত্যি করাবেন?’
‘হ্যাঁ, সত্যি।
‘আমার কাছে কার্ড আছে। কার্ড দিয়ে দিচ্ছি। আমি টেলিফোনেও উনার সঙ্গে কথা বলে রাখব।’
‘আচ্ছা। আজ তা হলে উঠি?’
‘আপনার বন্ধুর জন্যে অপেক্ষা করবেন না?’
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম,ও আজ রাতে বাসায় ফিরবে না।নীতু তীক্ষ্ণ গলায় বলল, তার মানে কি? আপনি কী বলতে চাচ্ছেন? আপনি কি আপনার তথাকথিত অলৌকিক ক্ষমতার নমুনা আমাকে দেখাতে চাচ্ছেন? আমাকে ভড়কে দিতে চাচ্ছেন?
‘তা না। আপনি শুধুশুধু রাগ করছেন। আমার মনে হচ্ছে ইয়াদ আজ রাতে বাসায় ফিরবে না। বললাম।’
‘শুনুন হিমু সাহেব, আমার সঙ্গে চালাকি করতে যাবেন না। আমি চালাকি পছন্দ করি না।’
নীতু বারান্দা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এল। টির্টি-ফুর্টি বারান্দায় বসে ছিল। নীতুকে দেখেই উঠে দাঁড়াল। লেজ নাড়তে লাগল।লেজ নাড়া দিয়ে কুকুর কী বোঝাতে চেষ্টা করে? লেজ নেড়ে সে কি বলে—আমি তোমাকে ভালবাসি? ভালবাসার পরিমাণও কি সে লেজ নেড়ে প্রকাশ করে? কেউ কি এই বিষয়টি নিয়ে রিসার্চ করেছে? ইয়াদের মতো কেউ একজন এসে ব্যাপারটা নিয়ে রিসার্চ করলেই পারে। ‘কুকুরের লেজ এবং ভালবাস।’
আমি মেসে ফিরলাম না।এত সকাল-সকাল ফেরা ঠিক হবে না। ইয়াদ হয়তো বসে আছে। রাস্তায় হাঁটতেও ইচ্ছা করছে না। ক্লান্তি লাগছে। কেন জানি মাথায় ভোঁতা ধরণের যন্ত্রনা হচ্ছে। মেসে ফিরে যাওয়াই ভাল। মাথার যন্ত্রনা ইদানীং আমাকে কাবু করে ফেলছে। হালকাভাবে শুরু হয়—শেষের দিকে ভয়াবহ অবস্থা। এক সময় ইচ্ছা করে কাউকে ডেকে বলি, ভাই, আপনি আমার মাথাটা ছুরি দিয়ে কেটে শরীর থেকে আলাদা করে দিতে পারেন? রুপার চিঠি এখনো পড়া হয়নি। বিছানায় শুয়ে-শুয়ে চিঠিটা পড়া যায়। আমি একটা রিকশা নিয়ে নিলাম।
ইয়াদ আমার জন্যে মেসে বসে নেই। এটা একটা সুসংবাদ। আগের মতো টাইপ করা ইংরেজি নোট রেখে গেছে—