হিমু, খুঁজে পাচ্ছি না। কোথায় আছ?
ভিডিও ক্যামেরা কিনেছি। সব ভিডিও হবে।
ইয়াদ।
ঘরে থাকলেই ইয়াদের হাতে পড়তে হবে। সারা দিনের জন্যে আটকে যেতে হবে। আমার কাজ হবে তার পেটমোটা কালো ব্যাগ নিয়ে ঘুরে বেড়ানো—এখন যেহেতু ভিডিও ক্যামেরা কেনা হয়েছে—ভিক্ষুকদের ইন্টারভ্যু হবে ভিডিওতে। এতদিন ক্যাসেট রেকর্ডারে হচ্ছিল। ইয়াদের কাজকর্ম পরিষ্কার। তৈরি প্রশ্নমালা আছে—ইন্টারভ্যুর সময় তৈরি প্রশ্নমালার বাইরে কোন প্রশ্ন করা যাবে না।
প্রশ্নের নমুনা হল—
নাম?
স্ত্রী না পুরুষ?
বয়স?
শিক্ষা?
পিতার নাম?
ঠিকানা ক) স্থায়ী?
খ) অস্থায়ী?
কতদিন ধরে ভিক্ষা করছেন?
দৈনিক গড় আয় কত?
পরিবারের সদস্য সংখ্যা?
সদস্যদের মধ্যে কতজন ভিক্ষুক?
খাবার রান্না করে খান, না ভিক্ষালব্ধ খাবার খান?
এরকম মোট পঞ্চাশটা প্রশ্ন। একেকজনের উত্তর দিতে ঘণ্টাখানিক লাগে। এক ঘণ্টার জন্যে তাকে পাঁচ টাকা দেয়া হয়। পাঁচ টাকার চকচকে একটা নোট হাতে নিয়ে অধিকাংশ ভিক্ষুকই চোখ কপালে তুলে বলেন, অতক্ষণ খাটনি করাইয়া এইডা কী দিলেন? আফনের বিচার নাই?
আমি ইয়াদকে বলার চেষ্টা করেছি, এ-জাতীয় প্রশ্ন অর্থহীন।ইয়াদ মানতে রাজি নয়। সে নাকি তিন মাস দিনরাত খেটে প্রশ্ন তৈরি করেছে। প্রশ্ন তৈরির আগে স্ট্যাটিসটিক্যাল মডেল দাঁড়া করিয়েছে। কম্প্যুটার সফটওয়্যরে পরিবর্তন করেছে—ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি তার বকবকানি শুনে বিরক্ত হয়ে বলেছি, চুপ কর্ গাধা। সে খুবই অবাক হয়ে বলেছে—গাধা বলছিস কেন? আমাকে গাধা বলার পেছনে তোর কি কি যুক্তি আছে তুই পয়েন্ট ওয়াইজ কাগজে লিখে আমাকে দে। আমি ঠাণ্ডা মাথায় অ্যানালাইসিস করব। যদি দেখি তোর যুক্তি ঠিক না, তা হলে আমাকে গাধা বলার জন্যে তোকে লিখিতভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে।
এ-জাতীয় মানুষদের কাছ থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই মঙ্গল। আমি সবসময় দূরে থাকার চেষ্টাই করি। আমি পালিয়ে-পালিয়ে বেড়াই।গাধাটা আমাকে খুঁজে খুঁজে বের করে। একধরণের চোর-পুলিশ খেলা। আমি চোর—সে পুলিশ। যেহেতু চোরের বুদ্ধি সবসময়ই পুলিশের বুদ্ধির চেয়ে বেশি, সেহেতু সে গত এক সপ্তাহ আমার দেখা পায় নি। আজো পাবে না। আমি আবার বের হয়ে পড়লাম। আমার কোনো রকম পরিকল্পনা নেই। প্রথমে রুপার কাছে যাওয়া যায়। ওর সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয় না। প্রিয় মুখ কিছুদিন পরপর দেখতে হয়। মানুষের মস্তিষ্ক অপ্রিয়জনদের ছবি সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে। প্রিয়জনদের ছবি কোনো এক বিচিত্র কারণে কখনো সাজায় না। যে জন্যে চোখ বন্ধ করে প্রিয়জনদের চেহারা কখনোই মনে করা যায় না।
রুপাকে পাওয়া গেল না। রুপার বাবার সঙ্গে দেখা হল। তিনি ভুরু কুঁচকে বললেন
—ও তো ঢাকায় নেই।
এই ভদ্রলোক সহজ গলায় মিথ্যা বলেন। রুপা ঢাকায় আছে তা তাঁর কথা থেকেই আমি বুঝতে পারছি।
আমি বললাম, কোথায় গেছে?
‘সেটা জানার কি খুব প্রয়োজন আছে?’
‘না, জানার প্রয়োজন নেই—তবু জানতে ইচ্ছা করছে।’
‘ও যশোর গিয়েছে।’
‘ঠিকানাটা বলবেন?’
ভদ্রলোক শুকনো গলায় বললেন, ঠিকানা দিতে চাচ্ছি না। ও অসুস্থ্। আমরা চাই না অসুস্থ অবস্থায় কেউ ওকে বিরক্ত করে।
‘অসুস্থ্ অবস্থায় মানুষের বন্ধুবান্ধবের প্রয়োজন পড়ে। আমি ওর খুব ভাল ব্ন্ধু।
‘ওর ঠিকানা দেয়া যাবে না।’
‘ও কোথায় গেছে বললেন যেন?’
‘যশোর।’
‘খুব শিগ্গির ফেরার সম্ভাবনা নেই—তাই না?’
‘দেরি হবে।’
আমি খুব চিন্তিত মুখে বললাম, একটা ঝামেলা হয়ে গেল যে! আজই প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তায় রুপার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গেল।সে-ই আমাকে বাসায় আসতে বলেছে। ব্যাপারটা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, আপনি বলছেন রুপা যশোরে। আপনার মত বয়স্ক, দায়িত্ববান একজন মানুষে আমার সঙ্গে নিশ্চয়ই মিথ্যাকথা বলবেন না। তাহলে রুপার সঙ্গে দেখা হল কী ভাবে?
ভদ্রলোক তাকিয়ে আছেন। কিছু বললেন না। তাঁকে মোক্ষম আঘাত করা হয়েছে। সামলে উঠতে সময় লাগবে। তাঁর মুখের ভাবের পরিবর্তন দেখতে ভাল লাগছে।
‘তোমার নাম হিমু না?’
‘জ্বি।’
‘মিথ্যা যা বলার তুমি বলেছ। রুপার সঙ্গে তোমার দেখা হয়নি, ও যশোরে আছে। আমার সঙ্গে তুমি যে ক্ষুদ্র রসিকতা করার চেষ্টা করলে তা আর করবে না।
মনে থাকবে?’
‘জ্বি স্যার, থাকবে।’
‘গেট আউট।’
‘থ্যাংক ইউ স্যার।’
আমি চলে এলাম। এমন কঠিন ধরণের একজন মানুষ রুপার মতো মেয়ের বাবা কী করে হলেন ভাবতে-ভাবতে আমি হাঁটছি—রুপার চিঠি এখনো পড়া হয়নি। পড়লে তো ফুরিয়ে গেল। চিঠির এই হল ম্যাজিক। যতক্ষণ পড়া হয় না, ততক্ষণ ম্যাজিক থাকে। পড়ামাত্রই ম্যাজিক ফু্রিয়ে যায়।
কোথায় যাওয়া যায়? মেসে ফিরে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। ইয়াদ সেখানে নিশ্চয়ই বসে আছে। আমি মোরশেদ সাহেবের বাসার দিকে রওনা হলাম। খিলগাঁ—দূর আছে। অনেকক্ষণ হাঁটতে হবে। কোনো-একটা উদ্দেশ্য সামনে রেখে হাঁটতে ভাল লাগে। যদিও জানি মোরশেদ সাহেব কে পাওয়া যাবে না। কোনো-কোনো দিন এমন যায় যে কাউকেই পাওয়া যায় না। আজ বোধহয় সেরকম একটা দিন।
মোরশেদ সাহেব কে পাওয়া গেল না। দরজা তালাবন্ধ। তবে একটা মজার ব্যাপার লক্ষ করলাম। বাসার ঠিকানা বলার সমকয় তিনি বলেছিলেন—১৩২ নং খিলগাঁ, একতলা বাড়ি, সামনে বিরাট আমগাছ। সবই ঠিক আছে, শুধু আমগাছ নেই। শুধু এই বাড়ি না, আশেপাশের কোনো বাড়ির সামনেই আমগাছ নেই। মোরশেদ সাহেবের বাড়িতে দারোয়ান জাতীয় একজন কে পাওয়া গেল। তাকে জিজ্ঞেস করলাম—এখানে কি আমগাছ কখনো ছিল? সে বিরক্ত হয়ে বলল, আমগাছ কেন থাকবে?
যেন আমগাছ থাকাটা অপরাধ। আমি খুবই বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আপনি এ বাড়িতে কতদিন ধরে আছেন?
‘ছোটবেলা থাইক্যা আছি।’
‘এটা কি মোরশেদ সাহেবের কেনা বাড়ি?’
‘জ্বে না, ভাড়া বাসা। তয় বেশিদিন থাকব না। বাড়িওয়ালা নোটিশ দিছে।’
‘আচ্ছা ভাই, যাই।’
‘উনারে কিছু বলা লাগব?’
‘না।’
আমি আবার হাঁটা ধরলাম।রাত একটা পর্যন্ত পথে-পথে থাকতে হবে। ইয়াদ একটা পর্যন্ত আমার জন্যে বসে থাকবে না।তাকে রাত রাত বারোটার মধ্যে বাড়ি ফিরতে হবে।নীতুর কঠিন নির্দেশ। নীতুর মতো মেয়ের নির্দেশ অগ্রাহ্য করা ইয়াদের পক্ষে সম্ভব না।
নীতুর সঙ্গে দেখা করে এলে কেমন হয়? ইয়াদের হাত থেকে বাঁচার সবচে’ ভাল উপায় হচ্ছে ইয়াদের বাসায় গিয়ে বসে থাকা। সে বসে থাকবে আমার মেসে, আমি বসে থাকব তার বাড়িতে। চো-পুলিশ খেলার এরচে’ ভাল স্ট্রাটিজি আর হয় না। ফুল প্রুফ।