নীতু লিখেছে—
হিমু সাহেব,
আশা করি সুখে আছেন। অবশ্যি আমার আশা করা না করায় কিছু যায় আসে না। আপনি সব সময় সুখেই থাকবেন, এবং আপনার আশেপাশের মানুষদের নানানভাবে বিভ্রান্ত করবেন, বিপদে ফেলবেন। অন্যদের সমস্যায় ফেলাতেও সুখ আছে। সেই সুখের ঘাটতি আপনার কখনো হয় না।
আপনি নিশ্চয়ই ইতোমধ্যে জেনেছেন যে আপনার বন্ধু অবশেষে আপনার সুচিন্তিত পরামর্শ গ্রহণ করেছেন। তিনি ভিখিরি হয়েছেন। ভিখিরির মতো সাজসজ্জা করে পথে-পথে ঘুরছেন।এমন হাস্যকর ব্যাপার যে ঘটতে পারে তা কোনোদিনও কল্পনা করিনি।ইয়াদ বুদ্ধিমান নয় এই তথ্য আপনি যেমন জানেন, আমিও জানি। কিন্তু ও যে কতটা বোকা তা আপনিই চোখে আঙুল দিয়ে আমাকে দেখালেন।
ইয়াদের আত্মীয়স্বজনদের আমি বলেছি ব্যাপারটা আর কিছুই না,
ইয়াদের একধরনের খেলা। ওরা ব্যাপারটা সেভাবেই নিয়েছে, এবং বেশ মজাও পাচ্ছে। কিন্তু আমি তো জানি ব্যাপারটা খেলা হলেও আপনার জন্যে খেলা,ইয়াদের জন্যে নয়। আপনি যে খেলা খেলছেন তা হল dangerous game. আশা করি আপনি জানেন খেলা কোথায় শেষ করতে হয়।
আমি দু’জন লোক ইয়াদের পেছনে লাগিয়ে রেখেছি। ওরা সব সময় তার দিকে লক্ষ রাখছে। আমার ধারণা ছিল, দু’দিন পার হবার আগেই ওর মোহভঙ্গ হবে এবং সে বাড়িতে ফিরে আসবে। আমাকে জোর খাটিয়ে কিছু করতে হবে না। কিন্তু সে বাসায় ফিরছে না। আপনি এই চিঠি পাওয়ামাত্র এমন ব্যবস্থা করবেন যেন সে বাড়িতে ফিরে আসে। আমি একটি ব্যাপার খুব পরিষ্কার করে আপনাকে জানাতে চাই, তা হল—ও বোকা হোক, যা হোক, ওকে আমি অসম্ভব ভালবাসি।
ভালবাসা মাপার যন্ত্র বের হয়নি। বের হলে আমার ভালবাসার পরিমাণ আপনাকে মেপে দেখাতাম। ওর কোনোরকম ক্ষতি আমি সহ্য করব না। কাউকে সেই ক্ষতি করতেও দেব না। ও কোথায় রাত্রি যাপন করে তা আমাদের ম্যানেজার সাহেব জানেন। উনিই আপনাকে সেখানে নিয়ে যাবেন।
ওর মাথা থেকে ভূত সরিয়ে আপনি ওকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেবেন এবং আর কোনোদিনও ওর সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন না।আপনার জন্যে এই কাজ কঠিন নয়, বেশ সহজ।এই সহজ কাজের জন্যে আমি অনেক বড় মূল্যে দিতে প্রস্তুত আছি। Tell me price.
আরো কিছু কথা বলার ছিল, ক্লান্ত বোধ করছি।
নীতু
আমি চিঠি শেষ করে ডাকলাম, ম্যানেজার সাহেব।
ভদ্রলোক তৎক্ষণাৎ সাড়া দিল, জ্বি স্যার।
‘আপনাকে কি চিঠির জবাব নিয়ে যেতে বলেছে?’
‘জ্বি।’
‘বল পয়েন্ট এনেছেন?’
‘জ্বি।’
‘কত নিয়েছে?
‘চার টাকা চেয়েছিল—আপনি দশ টাকা দিতে বলেছেন, দিয়েছি। নিতে চাচ্ছিল না। আপনার কথা বলে জোর করে দিয়ে এসেছি।’
‘ভাল করেছেন।’
‘আপনি কি চিঠির জবাব দেবেন?’
‘না। তবে আপনাকে নিয়ে ইয়াদের খোঁজে যাব। চলুন যাওয়া যাক।’
‘এখন গেলে উনাকে পাওয়া যাবে না। উনার একটা ঘুমাবার জায়গা আছে— রাত এগারোটায় দিকে সেখানে ফেরেন।’
‘তাকে কি এখন ভিখিরির মতো লাগে?’
‘জ্বি, লাগে।’
‘ভিক্ষা শুরু করেছে?’
‘জ্বি-না।’
‘চলছে কীভাবে?’
‘তা ঠিক জানি না। কিছু টাকাপয়সা নিয়ে বের হয়েছিলেন বলে মনে হয়।’
‘খাওয়াদাওয়া করছে?’
‘প্রথম দিন কিছু খাননি। রাতে একটা পাউরুটি খেয়েছেন।’
‘তারপর?’
‘আমি শুধু প্রথম দিনের খবর জানি।’
‘ওর দিকে লক্ষ রাখার জন্যে লোক রাখা আছে না?’
‘জ্বি-আছে।’
‘ম্যানেজার সাহেব, আপনি নিজে কি খাওয়া-দাওয়া করেছেন, না দুপুর থেকে এখানেই বসে আছেন?’
‘খাইনি কিছু।’
‘যান, খেয়ে আসুন।’
‘জ্বি-না।’
‘না কেন?’
ম্যানেজার জবাব দিল না। আমি বললাম, নীতু কি বলে দিয়েছে আমাকে এক মুহূর্তের জন্যেও চোখের আড়াল না করতে?
‘জ্বি।’
‘তা হলে চলুন। আমার সঙ্গেই চলুন। আপনাকে খাইয়ে আনি।’
‘লাগবে না।’
‘আসুন যাই।’
‘স্যার, কিছু খাব না।’
রাত এগারোটায় ইয়াদের সন্ধ্যানে
রাত এগারোটায় ইয়াদের সন্ধ্যানে বের হলাম।
ইয়াদ থাকে মীরপুর দশ নম্বরে, সিঅ্যান্ডবি গুদামে। গুদামের ভেতর গাদাগাদি করে রাখা রাস্তার কালভার্টের সিরামিক স্ল্যাব। দেখতে বিশাল আকৃতির সিলিন্ডারের মতো। তার একটিতে ইয়াদের সংসার। বাইরে থেকে ইয়াদ বলে ডাকতেই সে খুশি-খুলি গলায় বলল, চলে আয়। মাথা নিচু করে ঢুকবি। দাঁড়া এক সেকেণ্ড, বাতি জ্বালাই। সে কুপি জ্বালল। আমি ঢুকলাম। ভক করে খানিকটা পচা দুর্গন্ধ নাকে ঢুকল।
‘গন্ধে নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসছে রে ইয়াদ।’
‘প্রথম খানিকক্ষণ গন্ধ পাবি। তারপর পাবি না। মাথা নিচু করে ঢোক।’
সিলিন্ডার স্লাবের এক মাথা পলিথিন দিয়ে মোড়ানো, অন্য মাথায় চটের পর্দা। নিচে পুরানো একটো কম্বল লম্বালম্বি বিছানো। কম্বলের উপর ইয়াদ হাসিমুখে বসে আছে।
‘তুই আসবি জানতাম। ইচ্ছা করেই তোকে খবর দিইনি। তুই হচ্ছিস গ্রে হাউন্ড টাইপ। গন্ধ শুঁকে-শুঁকে চলে আসবি। আমার সংসার কেমন দেখছিস?’
‘মন্দ না।’
‘মন্দ না মানে? একসেলেন্ট। শীত টের পাচ্ছিস?’
‘না।’
‘পুব-পশ্চিমে মুখ করা। উত্তরী বাতাস ভেতরে ঢোকার কোনো উপায় নেই। মশা লাগছে?’
‘না।’
‘এক মুখ পলিথিন দিয়ে ঢাকা, অন্য মুখে চটের পর্দা। মশা ঢোকার কোনো উপায় নেই।’
‘এরকম আরামের জায়গার খোঁজ পেলি কোথায়?’
‘এরচেয়েও আরামের জায়গা আছে। ভাড়া বেশি।’
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ভাড়া দিতে হয়!
‘অবশ্যই দিতে হয়।’
‘এর ভাড়া কত?’
‘দু’ টাকা।’
‘মাসে দু’ টাকা?’
ইয়াদ বিরক্ত হয়ে বলল, তুই পাগলটাগল হয়ে গেলি? শায়েস্তা খাঁর আমল ভেবেছিস? পার নাইট দু’টাকা। শীতকালে চার্জ বেশি। গরমকালে পার নাইট এক টাকা। মাসচুক্তির কোনো ব্যাপার নেই।
‘ভাড়া নেয় কে?’
‘সর্দার আছে। সর্দার নেয়। সিঅ্যান্ডবি-ব দারোয়ান নেয়, পুলিশ নেয়, অনেক ভাগাভাগি। পুরোপুরি জানি না।’
‘দু’টাকা ভাড়া দিয়ে কেউ থাকে?’
‘অবশ্যই থাকে। কোনটা খালি নেই। তা ছাড়া অনেক স্পেস। কোনো-কোনটায় পুরো ফ্যামিলি আঁটে। চা খাবি?’
‘তোর এখানে কি চা বানাবার ব্যাবস্থা আছে?’
‘আরে না। তবে কাছেপিঠেই আছে। ডাক দিলে দিয়ে যাবে। চা, সিগারেট, পান।’
‘সুখে আছিস মনে হয়।’
‘অবশ্যিই সুখে আছি। কোনোরকম চিন্তা-ভাবনা নেই। কে কি বলল তা নিয়ে মথাব্যাথা নেই—কী আরামের ঘুম যে হয়, তুই বিশ্বাস করতে পারবি না। আমার কি মনে হয় জানিস? আরামের ঘুম কী জিনিস এটা জানার জন্যেই আমাদের সবার কিছুদিনের জন্যে হলেও ভিখিরি হওয়া উচিত। তার উপর ভিখিরিদের মধ্যে কমিউনিটি ফিলিং যা আছে তারও তুলনা নেই। বাইরে থেকে আমাদের মনে হয় এক ভিখিরি অন্য ভিখিরিকে দেখতে পায় না, এটা খুবই ভুল কথা। সবাই সবার খোঁজ রাখে। ধর্, সিগারেট খা।’
‘সিগারেট ধরেছিস?’
‘হুঁ, ধরেছি। হাইকোর্ট মাজারের কাছে এক রাতে গাঁজা খেয়েছি। দু’টান দিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। উঠলাম সকালে—হা হা হা।’
ইয়াদ গা দুলিয়ে হাসতে লাগল। আমি বললাম, নীতুর কথা মনে হয় না?
ইয়াদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, না।
‘একেবারেই না?’
‘উহু। তুই বলায় মনে পড়ল।’
‘ও কেমন আছে জানতে চাস না?’
‘ভাল আছে তো বটেই। খারাপ থাকবে কেন?’
‘তোর আসল কাজ কেমন এগুচ্ছে?’
‘এগুচ্ছে না। অবশ্যি আমি নিজেই গা করছি না। তাড়া তো কিছু নেই। হোক ধীরেসুস্থে। আগে ওদের মেইন স্ট্রীমের সঙ্গে মিশে নিই—তারপর।’
‘ওদের মেইন স্ট্রীমের সঙ্গে এখানো মিশতে পারিসনি?’
‘উহু। ওরা খুব চালাক, বুঝলি হিমু, চট করে ধরে ফেলে যে আমি ওদের একজন না। বাইরের কেউ।’
‘কিছু বলে না?’
‘না, কিচ্ছু বলে না। চুপ করে থাকে। তবে আমার মতো অনেকেই আছে।’
‘বলিস কী।’
‘নানান ধাক্কায় ভিখিরি সেজে ঘোরে। বিদেশী আছে বেশ কয়েকটা। এর মধ্যে একটা আছে নেদারল্যান্ডের, বিরাট চোর। চা খাবি কিনা তা তো বললি না। খাবি?’
‘খাব।’
ইয়াদ চটের পর্দা সরিয়ে ডাকল, তুলসী, তুলসী, দু’টা চা।
‘তুলসীকে দেখে রাখ্—অসাধারণ একটা মেয়ে। আমি আমার জীবনে এত ভাল মেয়ে দেখিনি—কী যে বুদ্ধি, তোকেও সে এক হাটে কিনে অন্য হাটে বেচে ফেললে তুই টেরও পাবি না।’
‘তুলসীর বয়স কত?’
‘সাত-আট হবে। বেশি না।’
‘ও কি ভিক্ষা করে?’
‘গাবতলি বাসস্ট্যান্ডে চা বিক্রি করে। তুলসীর বাবা আর সে দু’জনের ব্যবসা। ভাল রোজগার।’
তুলসী চা নিয়ে ঢুকল। মেয়েটার গায়ে সুন্দর গরম স্যুয়েটার। মাথার চুল লাল। স্বর্ণকেশী বালিকা। ইয়াদ বলল, তুলসী হল আমার খুবই ক্লোজ ফ্রেন্ড।
তুলসী আড়চোখে আমাকে দেখল, কিছু বলল না। ইয়াদ বলল, চায়ের কাপ থাক্, পরে নিয়ে যাবি। হিমু, তুলসীকে কেমন দেখলি?
‘ভাল।’
‘মারাত্মক বুদ্ধি! কি করে বুঝলাম জানিস? তুলসী আমাকে বলল, দু’জন লোক আমার উপর নজর রাখছে। আমি কিচ্ছু বুঝিনি।’
‘দু’জন তাহলে তোর উপর নজর রাখছে?’
‘হুঁ। নীতুর কাণ্ড। আমাকে সারাক্ষণ চোখে-চোখে রাখা হল ওর অভ্যাস। কোনোদিন দেখব টুটি-ফুটিকে নিয়ে উপস্থিত হয়েছে।’
‘উপস্থিত হলে কি করবি?’
ইয়াদ গম্ভীর গলায় বলল, সত্যি সত্যি উপস্থিত যদি হয়, তাহলে বলব, আমার সঙ্গে থেকে যাও নীতু।
‘কি মনে হয় তোর, নীতু থাকবে?’
‘কিছু বলা যায় না, থাকতেও পারে। এখানে থাকাটা কিন্তু আরামদায়ক। এক রাত থেকে যা, তু্ই নিজেই টের পাবি। থাকবি?’
‘উঁহু, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।’
‘কুপির ধোঁয়ায় দম বন্ধ হচ্ছে। কুপি নিভিয়ে দিলেই দেখবি—আরাম।’
ইয়াদ ফুঁ দিয়ে কুপি নিভিয়ে দির চারদিকে ঘন অন্ধকার । এমন অন্ধকার আমি আমার জীবনে দেখিনি।’
‘হিমু।’
‘হুঁ।’
‘ভিখিরিদের সঙ্গে আমার একদিন-দু’দিন শুরু করিনি, তবু অদ্ভুত অদ্ভুত তথ্য পাচ্ছি। একটা তোকে বলি—আমাদের ধারণা, মাসের এক-দুই তারিখের দিকে ভিখিরিরা বেশি ভিক্ষা পায়। লোকজনের হাতে বেতনের টাকা থাকে। তারা ভিক্ষা বেশি দেয়। ব্যাপার মোটেই তা না। সবচে’বেশি ভিক্ষা পায় মাসের শেষ সপ্তাহে। ইন্টারেস্টিং না?’
‘হুঁ। ইন্টারেস্টিং।’
‘রিসার্চের অনেক কিছু আছে। যারা ভিক্ষা দিচ্ছে তাদের নিয়েও রিসার্চ হওয়া দরকার। এই দিকে কোনো কাজই হয়নি। ভিক্ষুকদের মধ্যে শ্রেণীভেদ আছে, এটা জানিস?’
‘জানি না, তবে আন্দাজ করতে পারি।’
‘নাস্তিকতা যে ভিখিরিদের মধ্যে সবচে’ বেশি এটা জানিস?’
‘আঁচ করতে পারি।’
‘ফ্যামিলি স্ট্রাকচার ওদের ভেঙে পড়েছে। স্বামী-স্ত্রীর একসঙ্গে থাকে, আবার স্ত্রী অন্য কারো সঙ্গেও কিছুদিন থেকে স্বামীর কাছে ফিরে আসে। স্বামীর বেলাতেও এটা সত্যি—এরা সম্পূর্ণ নতুন ধরনের এক সমাজ তৈরি করছে। সেই সমাজের আইনকানুন আলাদা। এরা যাযাবরদের মতো হয়ে যাচ্ছে। কোথাও একনাগাড়ে তিন রাতের বেশি থাকবে না। ঘুরে-ঘুরে বেড়াবে। তোর কাছে ইন্টারেস্টিং লাগছে?
‘লাগছে।’
‘ভিখিরিদের রোজগার সম্পর্কে আগে যে সমীক্ষা করেছিলাম সেটা পুরোপুরি ভুল। ভিখিরিদের মধ্যে নতুন মা যারা, অর্থাৎ যাদের বাচ্চার বয়স এক মাস-দু’মাস, তারা খুব ভাল রোজগার করতে পারে। তবে এইসব ক্ষেত্রে নতুন মা’র শীরর দুর্বল বলে বের হতে পারে না—বাচ্চাটা ভাড়া খাটে। চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ টাকা দৈনিক ভাড়া। এত সব তথ্য পাচ্ছি যে তুই কল্পনাও করতে পারবি না। এইসব তথ্য নিতে—নিতেই এক জীবন কেটে যাবে।’
‘এর মানে কি এই যে—তুই তোর জীবন এই গর্তে কাটিয়ে দিবি? নীতুর কাছে ফিরে যাবি না?’
ইয়াদ হাই তুলতে তুলতে বলল, দেখি।
‘আমি আজ যাচ্ছি।’
‘কাল আসবি?’
‘বুঝতে পারছি না—আসাতেও পারি। তোর কিছু লাগবে? লাগলে বল, নিয়ে আসব।’
‘কিছু লাগবে না।’
‘টাকাপয়সা লাগবে?’
‘না। পকেটে রুমাল থাকলে রেখে যা। সর্দি হয়ে গেছে। রুমালের অভাবে সামান্য অসুবিধা হচ্ছে।’
ইয়াদের কাছ থেকে বের হয়ে বড় রাস্তায় নেমে দেখি গাড়ি নিয়ে ম্যানেজার অপেক্ষা করছে। আমি বললাম, আপনি এখনো যাননি? চলে যান।
‘আপনাকে পৌঁছে দিয়ে যাই স্যার।’
‘আমি হেঁটে বাড়ি ফিরব। পৌঁছে দিতে হবে না।’
‘আপাকে কী বলব?’
আমি কয়েকদিনের মধ্যে তাঁর সঙ্গে দেখা করব। যা বলার আমি তখন বলব।’
‘উনি খুব অস্থির হয়ে আছেন স্যার।’
‘বুঝতে পারছি।’
‘আগামী কাল সকালের দিকে আসতে পারেন?’
‘না।’
‘কবে নাগাদ আসবেন? ঠিক দিনটা বললে আমার জন্যে ভাল হয়। আপা জিজ্ঞেস করবেন, কিছু বলতে না পারলে রাগ করবেন।’
‘ম্যানেজার হয়ে জন্মেছেন—বসের রাগ তো সহ্য করতেই হবে। ভিখিরি হয়ে জন্মালে কারোর ধার ধারতে হত না। বেঁচে থাকচেন যাদের দয়ায় উপর তাদের সমীহ করতে হচ্ছে না, ইন্টারেস্টিং না?’
ম্যানেজার জবাব দিল না। দুঃখিত চোখে তাকিয়ে রইল। বেচারার জন্যে আমার মায়া লাগছে—কিন্তু কিছু করার নেই। নীতু সঙ্গে দেখা করতে যাবার সময় হয়নি। নীতুকে অপেক্ষা করতে হবে।
রূপার চিঠি এসেছে
রূপার চিঠি এসেছে। কী অবহেলায় খামটা মেঝেতে পড়ে আছে। আরেকটু হলে চিঠির উপর পা দিয়ে দাঁড়াতোম। খাম খুলে
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম—এতবড় কাগজে একটি মাত্র লাইন, তুমি কেমন আছ? নাম সই করেনি, তারিখ দেয়নি। চিঠি কোথেকে লেখা তাও জানার উপায় নেই। শুধু একটি বাক্য—তুমি কেমন আছ? প্রশ্নবোধক চিহ্নটি শাদা কাগজে কী কোমল ভঙ্গিতে আঁকা হয়েছে। আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম এবং সঙ্গে সঙ্গে মনে হল রূপার আগের চিঠি পুরোটা পড়া হয়নি। কী লেখা ছিল সেই চিঠিতে? কোনোদিনও জানা যাবে না, কারণ চিঠি হারিয়ে ফেলেছি। নীতুকে জিজ্ঞেস করলে হয়তো জানা যাবে। চিঠিটা নীতু পড়েছে। নীতুর কাছে যেতে হবে। যেতে ভরসা পাচ্ছি না, কারণ ইয়াদের খোঁজ পাচ্ছি না। সে আগের জায়গায় নেই। তুলসী মেয়েটি ছিল। সে কিছু জানে না কিংবা জানলেও কিছু বলছে না।
নীতুর ম্যানাজারও জানে না। নীতু যাদের ইয়াদের পেছনে লাগিয়ে রেখেছিল তাদের ফাঁকি দিয়ে ইয়াদ সটকে পড়েছে। যে-মানুষ ভোল পাল্টে ঢাকার ভিক্ষুকদের সঙ্গে মিশে গেছে তাকে খুঁজে বের করবে। নীতু যখন তার সামনে এসে দাঁড়াবে তখন ইয়াদেক মাথা নিচু করে তার সঙ্গেই যেতে হবে, কারণ নীতুর আছে ভালবাসার প্রচণ্ড শক্তি।এই শক্তি আগ্রাহ্য করার ক্ষমতা ঈশ্বর মানুষকে দেননি। এই ক্ষমতা তিনি শুধু তাঁর কাছেই রেখে দিয়েছেন।
ইয়াদ কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা হল মোরশেদ। সেও উধাও হয়ে গেছে। মজনু মিয়ার ভাতের হোটেলে সে খেতে আসে না। পুরানো বাসায় যায় না। তাঁর আত্মীয়স্বজনদের ঠিকানা জানি না। তবে সে তার আত্মীয়স্বজনদের কাছে যাবে, তাও মনে হয় না।
সে একমাত্র এষার কাছেই যেতে পারে। কেন জানি মনে হচ্ছে তার কাছেও যায়নি। বড় শহরে হঠাৎ হঠাৎ কিছু লোকজন হারিয়ে যায়—কেউ তাদের কোনো খোঁজ দিতে পারে না। মোরশেদও কি হারিয়ে গেছে? অদৃশ্য হয়ে গেছে? প্রকৃতি মানুষকে অনেক ক্ষমতা দিয়েছে। অদৃশ্য হবার ক্ষমতা দেয়নি। তবে মানুষের সেই অক্ষমতা প্রকৃতি পুষিয়ে দেবার ব্যবস্থাও করেছে—কেউ অদৃশ্য হতে চাইলে প্রকৃতি সেই সুযোগ করে দেয়।
একদিন গেলাম এষাদের বাড়ি। এষা দরজা খুলে আনন্দিত গলায়, আরে আপনি।
‘কেমন আছেন?’
‘ভালো আছি। ঐ যে আপনি গেলেন আর খোঁজ নেই। দাদিমা রোজ একবার জিজ্ঞেস করে লোকটা এসেছে।’
‘উনি কি আছেন?’
‘না, নেই। আমার কি ধারণা জানেন? আমার ধারণা আপনি খোঁজখবর নিয়ে আসেন। যখন দাদীমা থাকে না, তখনি উপস্থিত হন। আসুন, ভেতরে আসুন।’
আজ এষাকে অনেক হাসিখুশি লাগছে। মনে হচ্ছে তার বয়সও কমে গেছে। উজ্জ্বল রঙের শাড়ি পরেছে। তবে আজো খালি পা।
ঐদিন আপনি দাদীমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। উনার অষুধপত্র লেগেছিল। আপনি কিনে দিলেন। দাদীমা ঐ টাকা আপনাকে দিতে চাচ্ছেন। সে জন্যেই তিনি আপনাকে এত খোঁজ করছেন। আমি দাদীমাকে বললাম, তুমি শুধু-শুধু ব্যস্ত হচ্ছ—টাকা দিলেও উনি নেবেন না।’
‘টাকা নেব না এই ধারণা আপনার কেন হল?’
‘আপনাকে দেখে, আপনার কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছে। আমি মানুষকে দেখে অনেক কিছু বুঝতে পারি।’
‘না, বুঝতে পারেন না। টাকা আমি নেব। সব মিলিয়ে একচল্লিশ টাকা খরচ হয়েছে। আজ টাকাটা নিতেই এসেছি।’
‘আপনি সত্যি বলছেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘বসুন, টাকা নিয়ে আসছি।’
এষা টাকা নিয়ে এল। আমি উঠে দাঁড়ালাম। এষা বলল, আপনি বসুন। আমি আবার বসলাম। এষা বসল আমার সামনে।সহজ গলায় বলল, আপনার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না। আমি সামনের সপ্তাহে দেশের বাহিরে চলে যাচ্ছি। আমেরিকার নিউজার্সিতে আমার মেজো ভাই থাকেন। ইমিগ্রেন্ট। তিনি আমার জন্যে গ্রীন কার্ডের ব্যবস্থা করেছেন। আমি তাঁর কাছে চলে যাব।
‘বাহ্,ভাল তো!’
‘ভাল-মন্দ জানি না। ভাল-মন্দ নিয়ে মাথা ঘামাইনি।’
‘ভাল হাবরই সম্ভাবনা। নতুন দেশে, সম্পূর্ণ নতুন করে জীবন শুরু করতে পারবেন। এখানে থাকলে হঠাৎ-হঠাৎ পুরানো স্মৃতি আপনাকে কষ্ট দেবে। হয়তো হঠা একদিন মোরশেদের সঙ্গে পথে দেখা হল। আপনি কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না, তিনিও ভেবে পাচ্ছেন না। কিংবা ধরুন খিলগাঁয় আপনাদের বাসার সামনে দিয়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ মনে হল, আরে, এই বাড়ির বারান্দায় চেয়ার পেতে জোছনা রাতে দু’জন বসে কত গল্প করেছি…’
এষা আমাকে থামিয়ে দিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বলল, এসব আমাকে কেন বলছেন?
‘এম্নি বলছি।’
‘শুনুন হিমু সাহেব! আপনি খুব সুক্ষ্ণাভাবে আমার মধ্যে একধরনের অপরাধবোধ সৃষ্টির চেষ্টা করছেন।’
‘চেষ্টা করতে হবে কেন ? আপনার ভেতর এম্নিতেই অপরাধবোধ আছে। দেশ ছেড়ে চলে যাবার পেছনেও এই অপরাধবোধ কাজ করছে।’
‘সেটা নিশ্চয়ই দুষণীয় নয়।’
‘দূষণীয়। মানুষকে পুরোপুরি ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে এমন ক’টি জিনিসের একটি হল অপরাধবোধ। আপনি এই অপরাধবোধ ঝেড়ে ফেলুন।’
‘কীভাবে ঝেড়ে ফেলব?’
‘দেশ ছেড়ে যাবার আগে মোরশেদ সাহেবের সঙ্গে একটা সহজ সম্পর্ক তৈরি করুন। কথা বলুন, গল্প করুন। তার একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়া যায় কিনা দেখুন। চাকরি খোঁজার ব্যাপারে আমি আপনাকে সাহায্য ও করতে পারি। কিছু ক্ষমতাবান মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে।’
‘হিমু সাহেব। আপনি নিতান্তই আজেবাজে কথা বলছেন। আমি এর কোনোটিই করব না। এগারো তারিখ বেলা তিনটায় আমার ফ্লাইট। আমি অসম্ভব ব্যস্ত। তা ছাড়া ইচ্ছাও নেই।’
‘টিকিট কাটা হয়েছে?’
‘হ্যাঁ, মেজো ভাই টিকিট পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট।’
আমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম, এষা, আপনি কিন্তু যেতে পারবেন না। আপনাকে থাকতেই হবে এই দেশেই।
‘তার মানে!’
‘মানে আমি জানি না। আমি মাঝে-মাঝে চোখের সামনে ভবিষ্যৎ দেখতে পাই। আমি স্পষ্ট দেখছি আপনি মোরশেদ সাহেবের হাত ধরে একটা আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন।’
‘আপনি কি আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছেন?’
‘ভয় দেখাচ্ছি না। কি ঘটবে তা আগেভাগে বলে দিচ্ছি।’
‘প্লীজ, আপনি এখন যান। আপনার সঙ্গে আমার কথা বলাই ভুল হয়েছে। শুনুন হিমু সাহেব, এগারো তারিখে বেলা তিনটায় আমার ফ্লাইট—আপনার কোনো ক্ষমতা নেই আমাকে আটকানোর। প্লীজ এখন যান। আর কখনো এখানো এসে আমাকে বিরক্ত করবেন না।’