ফুপার অফিসঘরে শীতকালেও এয়ার কুলার চলে। এয়ার কুলারের বিজবিজ আওয়াজ না হলে বোধহয় তাঁর মেজাজ আসে না।
‘কেমন আছেন ফুপা?’
ফুপা ফাইল থেকে মুখ না তুলেই বললেন, ভেতরে আস। অনেক দিন দেখা হয় না। তোমাকে তুই করে বলতাম, না তুমি করে বলতাম ভুলে গেছি। ভাল আছ?
‘জ্বি।’
‘আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম যে তুমি জেলে আছ। তোমার মতো লোক দীর্ঘদিন বাইরে ঘুরে বেড়াতে পারে না। একসময়-না একসময় তাদের জেলে ঢুকতে হয়। এর মধ্যে পুলিশ ধরেনি তোমাকে?’
‘না’
‘আমি অবশ্যি বাদলকে বলেছি—তুমি জেলে আছ। তোমার এক বছরের সাজা হয়েছে। না বললে তোমার খোঁজ বের করার জন্যে অস্থির হয়ে পড়ত।’
‘আমি কি বসব ফুপা।’
ফুপা বিস্মিত হয়ে বললেন, অনুমতি নিচ্ছ কেন? বস।
‘আপনার অফিসে ঢুকলেই নিজেকে অফিসের একজন কর্মচারী বলে মনে হয়।
আপনাকে মনে হয় বড় সাহেব। সামনে বসতে ভয় লাগে।’
ফুপা খুশি হলেন। ফাইল সরিয়ে আমার দিকে তাকালেন।
‘তোমার টাকা আলাদা করে রেখেছি।’
‘থ্যাংকস ফুপা।’
‘নাও, খাম দু’টা রাখ। চার’শ চার’শ করে আটশ’ আছে।’
খাম পকেটে ভরলাম। ফুপা আমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন, তুমি ইচ্ছা করলে আমার অফিসে কাজ করতে পার। এন্ট্রি লেভেল অফিসারের একটা পোস্ট খালি হয়েছে। আমরা অ্যাডভাটাইজ করব না। অ্যাডভাটাইজ করলে সামাল দেয়া যাবে না। তুমি চাইলে আজই তোমাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেয়া যেতে পারে।
‘বেতন কত?’
‘বেসিক তিন হাজার প্লাস ফর্টি পারসেন্ট হাউস রেন্ট। টু হানড্রেড কনভেন্স। থ্রী হানড্রেড মেডিকেল –হিসেব কর। কত হল?’
‘জটিল হিসাবে আমাকে দিয়ে হবে না ফুপা। তবে আমি খুব ভাল একজন লোক দিতে পারি। ভেরি অনেস্ট।’
‘তোমার কাছে তো আমি লোক চাইনি।’
‘তা চাননি। তবু হাত যখন আছে তখন বললাম। আমার জানামতে তাঁর মতো মানুষ এই পৃথিবীতে দ্বিতীয় কেউ নেই। এর উপর আমি আট শ’ টাকা বাজি রাখতে পারি। এই টাকাটাই আমার সম্বল। আপনি যদি এমন কাউকে পান যে ঐ লোকটার মতো, তাহলে আমি সঙ্গে-সঙ্গে আপনাকে আট শ’ দিয়ে দেব।’
ফুপা চুরুট ধরাতে ধরাতে বললেন, কি আছে লোকটার যা অন্য কারোর নেই?
‘সে তার বাড়ির সামনে একটা আমগাছ দেখতে পার, যদিও সেখানে কোনো গাছ নেই। কোনোদিন ছিলও না। সে পরিষ্কার আমগাছ দেখে, গাছে পাখি বসে থাকতে দেখে। পাখির কিচিমিচির শুনতে পায়।’
ফুপা বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমি এই বদ্ধ উন্মাদকে আমার এখানে চাকরি দিতে চাচ্ছ?
‘জ্বি।’
‘কেন বল তো?’
‘ভদ্রলোকের চাকরি খুব দরকার। উনি অসুস্থ। এপিলেপ্সি আছে। আগে ভাল চাকরি করতেন। এখন চাকরি নেই। যদি চাকরি হয় মানসিক শক্তি পাবেন। এতে শরীর সুস্থ হতে থাকবে।’
‘তোমার ধারণা,আমার অফিস পাগল সারাবার কারখানা?’
‘না, তা হবে কেন?’
‘একে উন্মাদ, তার উপর এপিলেপটিক পেশেন্ট, তাকে তুমি আমার এখানে চাকরি দেবার কথা ভাবলে কি করে বল তো?’
‘আর ভাবব না ফুপা।এখন তাহলে যাই?’
‘যাও। খবর্দার, বাসায় আসবে না।’
‘বাদল আছে কেমন?’
‘ও ভালই আছে। তোমার প্রভাব থেকে দুরে আছে, ভাল না থাকার তো কোনো কারণ নেই।’
‘আমি কি ওর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতে পারি ফুপা? অনেক দিন দেখি না—কথা বলতে ইচ্ছা করে।’
‘অসম্ভব! টেলিফোন করতে পারবে না। একেবারেই অসম্ভব।’
‘বলব—ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে টেলিফোন করা হচ্ছে। মিনিট দুই কথা বলব। দু’মিনিটে কী আর হবে।’
‘কিছু হবার থাকলে দু’ মিনিট হবে। বাদলের মাথা খারাপ হয়েই আছে—ঠিক করার চেষ্টা করছি। তোমার টেলিফোন পেলে—আর ঠিক হবে না। হিমু, তুমি বিদেয় হও। ক্লিয়ার আউট। এখন থাক কোথায়?’
কোথায় থাকি বলতে যাচ্ছিলাম, ফুপা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, থাক, বলতে হবে না।জানতে চাচ্ছি না।
আমি ঘর ছেড়ে বেরুবার আগে বললাম, ফুপা। বাদলের ব্যাপারে একটা ক্ষুদ্র সমস্যা হতে পারে। ঐ সমস্যাটা নিয়ে কি ভেবেছেন?
‘কি সমস্যা?’
‘আমি জেলে আছি শুনে সেও ভাবতে পারে জেলে যাওয়াটা প্রয়োজনীয়। কাজেই জেলে যাবার একটা চেষ্টা করতে পারে।’
ফুপার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। আমি চলে এলাম। মজনু মিয়ার ভাতের হোটেলে যেতে হবে। ভাতের বিল দিতে হবে। অনেক টাকা বাকি পড়ে আছে।
মজনু মিয়া হোটেলে খুব ভিড়। প্রচুর কাস্টমার। সবার জায়গা হচ্ছে না। কেউ—কেউ দাঁড়িয়ে আছে। মজনু মিয়া টাকা গুনতে হিমশিম খাচ্ছে। আমাকে দেখে শীতল গলায় বলল, ভাইজান, কথা আছে।
‘কি কথা—সাধারণ না প্রাইভেট?’
‘প্রাইভেট।’
আমি প্রাইভেট কথা শোনার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। বসার জায়গা নেই। দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। মজনু মিয়া তার ছোট ভাইটাকে ক্যাশে বসিয়ে এগিয়ে এল। আমি বললাম, খুব ভাল বিজনেস হচ্ছে, মজনু মিয়া। ব্যাপার কি?
‘ব্যবসাপাতি হইল আপনার ভাগ্যের ব্যাপার। কখন কি হয় কিছু বলা যায় না। কয়েকদিন ধরে দেখতেছি আমার সামনের হোটেলের সব বান্ধা কার্স্টমার এইখানে আসতেছে।’
‘বয়-বাবুর্চি তো বাড়াতে হবে। এরা পারছে না। আরো কয়েকজন নিন।’
‘দেখি।’
‘আর এদের বেতন বাড়িয়ে দিন।’
‘বাজে কথা বলবেন না তো হিমু ভাই। বাজে কথা শুনেতে ভাল লাগে না।’
‘আচ্ছা যান। বাজে কথা বলব না। আপনার প্রাইভেট কথা শুনব। প্রাইভেট কথাটা কি?’
‘আপনি যে আপনার এক ভাগ্নেকে গছায়ে দিয়ে গেলেন—তার আছে মৃগী বেরাম। ঐ দিন দুপুরে শরীর কাঁপতে কাঁপতে পড়ে গেল। কেলেঙ্কারি অবস্থা। কার্স্টমাররা সব খাওয়া ফেলে উঠে দাঁড়িয়েছে।’
‘তাতে অসুবিধা কী?’
‘অসুবিধা আছে না? এইরকম রোগী নিয়ে কারবার করলে তো হবে না ভাইজান। দোকানের বদনাম হবে। লোক আসা কমে যাবে। আপনে উনারে আমার দোকানে আসতে নিষেধ করে দেবেন।’
‘আচ্ছা, নিষেধ করে দেব।’
‘আপনি রাগ হলেও কিছু করার নাই। আপনার জন্যে সব মাপ। কিন্তু হিমু ভাই—পাগল, ছাগল, মৃগীরোগী এদের আমি দোকানে ঢুকাব না। ঐদিন আপনার ভাগ্নেরে দেখে আমি কানে হাত দিয়েছি। অনেক কাস্টমার বাইরে দাঁড় হয়েছিল। গণ্ডগোল দেখে ভিতরে ঢুকে নাই। আপনার ভাগ্নেরে আমি বলে দিয়েছি আর যেন এখানে না আসে।’
‘আপনি নিজেই বলে দিয়েছেন?’
‘জ্বি ভাইজান, আমি বলেছি। মৃগীরোগী আমার দরকার নেই।’
‘আমি পকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে বললাম, রুগ্ন মানুষের প্রতি মমতা দেখানোর বদলে আপনি দেখাচ্ছেন ঘৃণা। এটা কি ঠিক হচ্ছে? রোগটা তো আপনারো হতো পারত। তা ছাড়া এই যে আজ আপনার দোকানে এত বিক্রি বেড়েছে, হয়তো আমার ভাগ্নের কারণেই বেড়েছে। এই ক’দিন তাকে যত্ন করে খাইয়েছেন বলেই বেড়েছে। এখন তাকে বিদেয় করে দিয়েছেন—দেখা যাবে হুট করে বিক্রিবাটা পড়ে যাবে।’
‘আমাকে ভয় দেখায়ে লাভ নাই হিমু ভাই। আমি ভয় খাওয়ার লোক না। ঐ মৃগীরোগী আমি আর দোকানে ঢুকতে দেব না।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’
‘আপনি মনে কিছু নিবেন না হিমু ভাই। আপনার জন্যে আমি আছি। অন্য কারো জন্যে না।’
আমি মজনু মিয়ার টাকাপয়সা মিটিয়ে মোরশেদ সাহেবের খোঁজে গেলাম। খিলগাঁয়ে তাঁর বাড়িতে তাঁকে পাওয়া গেল না। ঘর তালাবন্ধ। বাড়িওয়ালাকে খুঁজে বের করলাম। বয়স্ক ভদ্রলোক। তিনি আমাকে খুব আন্তরিকতার সঙ্গেই ঘরে নিয়ে বসালেন। বললেন,
উনি বাসা ছেড়ে দিয়েছেন। আমি বললাম, কোথায় আছে জানেন?
‘জ্বি-না।’
‘বাসা ছেড়েছেন কবে?’
‘গত পরশু। দু’ মাসের ভাড়া পাওনা ছিল। উনি ভাড়াটাড়া সব মিটিঁয়ে দিয়ে গেছেন। আমি বললাম, থাক্, ভাড়া দিতে হবে না। বাদ দেন। রাজি হলেন না।’
‘জিনিসপত্রগুলি কোথায়?’
‘জিনিসপত্রগুলি কিছু তো ছিল না। একটা খাট, কিছু চেয়ার-টেবিল। ঐসব একটা ঘরে তালা দিয়ে রেখেছি। বলেছি, একসময় এসে নিয়ে যাবেন, কোনো অসুবিধা নাই। ভদ্রলোকের উপর মায়া পড়ে গিয়েছিল, বুঝলেন? ভাল চাকরি করছিল, সুন্দর সংসার—হঠাৎ কি হয়ে গেল দেখেন। সব ছারখার। যাবার সময় বাসার সামনে খোলা জায়গাটায় দাঁড়িয়ে খুব কাঁদছিলেন। দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমার বড় বৌমা বলল, বাবা, উনাকে বলেন—বাসা ছাড়ার দরকার নাই। উনাকে থাকতে বলেন। এইগুলা হচ্ছে ভাই ভাবের কথা। সংসার তো ভাই ভাবের কথায় চলে না।’
‘তা তো ঠিকই।’
‘বিনা পয়সায় থাকতে দিলে আমার চলে কী করে। আমি তো এতিমখানা খুলি নাই। এই কথাই বৌমাকে বুঝায়ে বললাম।’
‘উনি কী বললেন?’
‘কিছু বলে নাই। চুপ করে ছিল। লক্ষ্মী মেয়ে। শ্বশুরের মুখের উপর কোনো কথা বলবে না। তারপর শুনি—রাতে না খেয়ে শুয়ে পড়েছে। আমি বললাম, ভাত খাও নাই কেন, মা? সে বলল, মানুষটার জন্যে মনটা খুব খারাপ লাগছে বাবা। ভাত খেতে ইচ্ছা করছে না। কি রকম করে কাঁদছিল। যাই হোক, মেয়েছেলের কথা বাদ দেন। মেয়েছেলে বিড়ালের জন্যেও কাঁদে। এখন বলেন আপনি উনার কে হন?’
‘সম্পর্কে মামা হই।’
‘ও আচ্ছা। খুশি হয়েছি আপনার সঙ্গে কথা বলে।’
আমি বললাম, আপনার বড় বৌমাকে একটু ডাকবেন?
‘কেন?’
‘একটু দেখব। ভালমানুষ দেখার মধ্যেও পুণ্য আছে। যদি অসুবিধা না হয় একটু ডাকুন।’
ভদ্রলোক বিস্মিত হয়েই তাঁর বড় বৌমাকে ডাকলেন। সাদাসিধে সরল চেহারার মেয়ে, দু’ বছরের একটা বাচ্চা কোলো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কত বয়স হবে মেয়েটির? খুব বেশি হলে উনিশ-কুড়ি। তার কোলের শিশুটিও অবিকল তার মতো দেখতে। মা এবং শিশু যেন একই ছাঁচে তৈরী। আমি বললাম, আপনি কেমন আছেন?
মেয়েটি জবাব দিল না।
আমি বললাম,আপনার ছেলেটার কি নাম রেখেছেন?
মেয়েটি এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। বাচ্চা নিয়ে ভেতরে চলে গেল। বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক বলল, আমার বৌমা খুব লাজুক স্বভাবের। বাইরের কারোর সঙ্গে কথা বলতে পারে না।
আমি বললাম, আমি কথা বলতে চাইওনি। শুধু দেখেতে চেয়েছি। আচ্ছা ভাই, যাই।
‘আপনার ভাগ্নেকে বলবেন জিনিসপত্র সাবধানে রাখা আছে। যেন চিন্তা না করে।’
‘জ্বি আচ্ছা, বলব। আপনার অনেক মেহেরবানী।’
নীতুর একটি চিঠি এসেছে
নীতুর একটি চিঠি এসেছে। নীতুর স্বভাবও দেখা যাচ্ছে ইয়াদের মতো। চিঠি পাঠিয়েছে ইংরেজিতে টাইপ করে। ডাকে পাঠায়নি, হাতে-হাতে পাঠিয়েছে। নীতুর ম্যানেজার চিঠি নিয়ে এসেছে। তার উপর নির্দেশ, চিঠি আমার হাতে দিয়ে অপেক্ষা করবে এবং জবাব নিয়ে যাবে।
বড়লোকের ম্যানেজার শ্রেণীর কর্মচারীরা নিজের প্রভু ছাড়া সবার উপর বিরক্ত হয়ে থাকে। এই ভদ্রলোককে দেখলাম মহা বিরক্ত। প্রায় ধমকের স্বরে বলল, কোথায় থাকেন আপনি?
‘কেন বলুন তো?’
‘এই নিয়ে দশবার এসেছি। বসে যে অপেক্ষা করব সেই ব্যবস্থাও নেই। মেসের অফিস বন্ধ। একজনকে বললাম একটা চেয়ার এনে দিতে, সে আচ্ছা বলে চলে গেল। আর তার দেখা নেই।’
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, এর পর যখন আসবেন একটা ফোল্ডিং চেয়ার সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন।
ম্যানেজারের মুখ কঠিন হয়ে গেল। মনে হচ্ছে এ-জাতীয় কথাবার্তা শুনে সে অভ্যস্ত নয়। নীতুর চিঠি বের করে বলল, চিঠি পড়ে জবাব লিখে দিন। আপা বলেছেন—জবাব নিয়ে যেতে।
‘এখন চিঠি পড়েতে পাড়ব না।’
ম্যানেজার হতভম্ব গলায় বলল, এখন চিঠি পড়তে পারবেন না?
‘জ্বি-না।’
‘চিঠি আপা পাঠিয়েছেন।’
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, আপাই পাঠাক আর দিদিমণিই পাঠাক, চিঠি এখন পড়ব না।
‘কখন পড়বেন?’
‘তাও তো বলতে পারছি না। আমার মাথাধরা রোগ আছে। খারাপ ধরনের মাথাধরা। এখন সেটা শুরু হয়েছে। আমি খুব ঠাণ্ডা পানিতে অনেকক্ষণ ধরে গোসল করব। তারপর দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘুমাব। ঘুম থেকে উঠে যদি দেখি মাথাব্যথা সেরেছে, তখন পড়তে পারি। আবার নাও পারি।’
‘জরুরি চিঠি।’
‘আমার ঘুমটা চিঠির চেয়েও জরুরি। আপনি বরং এক কাজ করুন, এখন চলে যান। রাতে একবার খোঁজ নেবেন।’
‘আপাকে কি বলব আপনি চিঠি পড়তে চাচ্ছেন না?’
আমি ম্যানেজারের মুখের দিকে তাকালাম, সে আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে। মানুষজন দ্রুত বদলে যাচ্ছে—সবাই ভয় দেখাতে চায়। ভয় দেখিয়ে কাজ সারতে চায়।
কেউ ভয় দেখালে উল্টা তাকে ভয় দেখাতে ইচ্ছা করে। ম্যানেজার ব্যাটাকে চুড়ান্ত রকমের ভয় কী করে দেখানো যায়? মাথায় কিছুই আসছে না। ম্যানেজার কঠিন মুখ করে বলল, আমি কি উনাকে বলব যে উনি বলেছেন যখন উনার ইচ্ছা হয় তখন পড়বেন। এখন ইচ্ছা হচ্ছে না।
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, বলতে পারেন।
‘আচ্ছা, বলব।’
‘চিঠিটা সঙ্গে করে নিয়ে যান। রাতে যখন আসবেন তখন নিয়ে আসবেন।’
‘আপনি কাজটা ঠিক করছেন না।’
‘সবাই তো আর ঠিকঠাক কাজ করে না। কেউ-কেউ ভুলভাল কাজ করে। আমি ভুলভাল কাজ করতেই অভ্যস্ত। আপনি চিঠি নিয়ে চলে যান।’
‘জ্বি-না, আমি অপেক্ষা করব।’
‘বেশ, অপেক্ষা করুন। আমার ঘরে একটা চেয়ার আছে। বের করে নিয়ে যান। বারান্দায় বসুন। শুভ বিকাল।’
আমি চেয়ার বের করে দিলাম। দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল সারলাম। ম্যানেজার বসে আছে মূর্তির মতো। আমি দরজা বন্ধ করে ঘুমাতে গেলাম। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যায়। দরজা না খুলেই ডাকলাম, ম্যানেজার সাহেব।
‘জ্বি?’
‘আপনি এখনো আছেন?’
‘জ্বি।’
‘সঙ্গে গাড়ি আছে?’
‘আছে।’
‘তাহলে তরঙ্গিণী স্টোরে চলে যান। একটা বল পয়েন্ট কিনে আনবেন। চিঠির জবাব লিখতে হবে। আমার কাছে একটা বল পয়েন্ট আছে। দশ টাকা দিয়ে কিনেছিলাম—লেখা দিচ্ছে না।’
‘আমার কাছে কলম আছে।’
‘আপনার কলমে কাজ হবে না। আমাকে লিখতে হবে নিজের কলমে।’
‘তরঙ্গিণী স্টোর থেকেই কিনতে হবে?’
‘জ্বি।’
‘স্টোরটা কোথায়?’
‘বলছি। আপনার কাছে বল পয়েন্টের দাশ হয়ত তিন টাকা চাইবে কিন্তু আপনি দেবেন দশ টাকা। নিতে না চাইলে জোর করে দেবেন।’
ম্যানেজার নিঃশ্বাস ফেলে বলল,জ্বি আচ্ছা, দেব। আপনি দয়া করে। চিঠিটা পড়ুন। তার কঠিন ভাব এখন আর নেই। এখন সে ভীত চোখেই আমাকে দেখছে।
আমি দরজা খুলে চিঠি নিলাম। ম্যানেজার সাহেবকে তরঙ্গিণী স্টোরটা কোথায় বুঝিয়ে বললাম। ভদ্রলোক আর একবার বলল, অন্য কোনো জায়গা থেকে কিনে আনলে হবে না?
আমি কঠিন গলায় বললাম, না।