- বইয়ের নামঃ হিমু
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- সিজির বইঃ হিমু সিরিজ
- প্রকাশনাঃ প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
উৎসর্গ / প্রসঙ্গ – হিমু (১৯৯৩)
উৎসর্গ
আয়েশা মোমেন,
আপা, আপনি ভালবাসার যে কঠিন ঋণে আমাকে
জড়িয়ে রেখেছেন, সেই ঋণ শোধ করা সম্ভব নয়।।
ঋণ হয়ে থাকতে ভাল লাগে না, কিন্তু কী আর করা!
প্রসঙ্গ হিমু
—————–
হিমু আমার প্রিয় চরিত্রের একটি। যখন হিমুকে নিয়ে কিছু লিখি—নিজেকে হিমু মনে হয়, একধরণের ঘোর অনুভব করি। এই ব্যাপারটা অন্য কোনো লেখার সময় তেমন ঘটে না। হিমুকে নিয়ে আমার প্রথম লেখা ময়ুরাক্ষি। ময়ুরাক্ষি লেখার সময় ব্যাপারটা প্রথম লক্ষ করি। দ্বিতীয়বারে লিখলাম দরজার ওপাশে। তখনো একই ব্যাপার। কেন এরকম হয়? মানুষ হিসেবে আমি যুক্তিবাদী। হিমুর যুক্তিহীন, রহস্যময় জগৎ একজন যুক্তিবাদীকে কেন আকর্ষণ করবে? আমার জানা নেই। যদি কখনো জানতে পারি—পাঠকদের জানাবো।
হুমায়ুন আহমেদ
এলিফেন্ট রোড।
কি নাম বললেন আপনার
‘কি নাম বললেন আপনার, হিমু?’
‘জ্বি, হিমু।’
‘হিম থেকে হিমু?’
‘জ্বি-না, হিমালয় থেকে হিমু। আমার ভাল নাম হিমালয়।
‘ঠাট্টা করছেন?’
‘না, ঠাট্টা করছি না।’
আমি পাঞ্জাবির পকেট থেকে ম্যাট্রিক সার্টিফিকেট বের করে এগিয়ে দিলাম।
হাসিমুখে বললাম, সার্টিফিকেটে লেখা আছে। দেখুন।
এষা হতভম্ব হয়ে বলল, আপনি কি সার্টিফিকেট পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ান?
‘জ্বি, সার্টিফিকেটটা পকেটেই রাখি।হিমালয় নাম বললে অনেকেই বিশ্বাস করে না, তখন সার্টিফিকেট দেখাই। ওরা তখন বড় ধরণের ঝাঁকি খায়।’
আমি উঠে দাড়ালাম।এষা বলল, আপনি কি চলে যাচ্ছেন?
‘হুঁ।’
‘এখন যাবেন না। একটু বসুন।’
আমার যেহেতু কখনোই কোনো তাড়া থাকে না—আমি বসলাম। রাত ন’টার মতো বাজে। এমন কিছু রাত হয়নি—কিন্তু এ বাড়িতে মনে হচ্ছে নিশুতি। কারো কোনো সাড়াশব্দ নেই। বুড়ো মনে হয় এই ফ্ল্যাটের নয়। পাশের ফ্ল্যাটের।
এষা আমার সামনে বসে আছে। তার চোখে অবিশ্বাস এবং কৌতুহল একসঙ্গে খেলা করছে। সে অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছে, আবার জিজ্ঞেস করতে ভরসা পাচ্ছে না। আমি তাদের কাছে নিতান্তই অপরিচিত একজন। তার দাদীমা রিকসা থেকে পড়ে মাথা ফাটিয়েছেন। আমি ভদ্রমহিলাকে হাসপাতালে নিয়ে মাথা ব্যান্ডেজ করে বাসায়ে পৌঁছে বেতের সোফায় বসে আছি।এদের কাছে এই হচ্ছে আমার পরিচয়।
আমি খানিকটা উপকার করেছি। উপকারের প্রতিদান দিতে না পেরে পরিবারটা একটু অস্বস্তির মধ্যে পড়েছে।ঘরে বোধহয় চা-পাতা নেই। চা-পাতা থাকলে এতক্ষণে চা চলে আসত। প্রায় আধঘণ্টা হয়েছে। এর মধ্যে চা চলে আসার কথা।
আমি বললাম, আপনাদের বাসায় চা-পাতা নেই, তাই না?
এষা আবারো হকচকিয়ে গেল।বিস্ময় গোপন করতে পারল না। গলায় অনেকখানি বিস্ময় নিয়ে বলল, না, নেই। আমাদের কাজের মেয়েটা দেশে গেছে। ওই বাজার-টাজার করে। চা-পাতা না থাকায় আজ বিকেলে আমি চা খেতে পারিনি।
‘আমি কি চা-পাতা এনে দেব?’
‘না না, আপনাকে আনতে হবে না। আপনি বসুন। আপনি কী করেন?’
‘আমি একজন পরিব্রাজক।’
‘আপনার কথা বুঝতে পারছি না।’
‘আমি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াই।’
এষা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, আপনি কি ইচ্ছা করে আমার প্রশ্নের উদ্ভট উদ্ভট জবাব দিচ্ছেন?’
আমি হাসিমুখে বললাম, যা সত্যি তাই বলছি।সত্যিকার বিপদ হল—সত্যি কথার গ্রহণযোগ্যতা কম। যদি বলতাম, আমি একজন বেকার, পথে-পথে ঘুরি, তা হলে আপনি আমার কথা সহজে বিশ্বাস করতেন।’
‘আপনি বেকার নন?’
‘জ্বি-না। ঘুরে বেড়ানোই আমার কাজ। তবে চাকরিবাকরি কিছু করি না। আজ বরং উঠি?’
‘দাদীমা আপনাকে বসতে বলেছে।’
‘উনি কী করছেন?’
‘শুয়ে আছেন। মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। আপনি যদি চলে যান তা হলে দাদীমা খুব রাগ করবেন।’
‘তা হলে বরং অপেক্ষাই করি।’
আমি বেতে সোফায় বসে অপেক্ষা করছি। আমার সামনে বিব্রত ভঙ্গিতে এষা বসে আছে। বসে থাকতে ভাল লাগছে না তা বোঝা যাচ্ছে। বারবার তাকাচ্ছে ভেতরের দরজার দিকে।এর মধ্যে দু’বার হাতঘড়ির দিকে তাকাল। উপকারী অতিথীকে একা ফেলে রেখে চলে যেতেও পারছে না। আজকালকার মেয়েরা অনেক স্মার্ট হয়। এষা ফট করে বলে বসে—আপনি বসে-বসে পত্রিকা পড়ুন, আমার কাজ আছে! এ তা বলতে পারছে না। আবার বসে থাকতেও ইচ্ছা করছে না।তার গায়ে ছেলেদের চাদর। বয়স কত হবে—চব্বিশ-পঁচিশ? কমও হতে পারে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমার জন্যে হয়তো বয়স বেশি লাগছে। গায়ের রঙ শ্যামলা। রঙটা আরেকটু ভাল হলে মেয়েটিকে দারুণ রুপবতী বলা যেত। শীতের দিনে ঠান্ডা মেঝেতে মেয়েটা খালিপায়ে এসেছে। এটা ইন্টারেস্টিং। যেসব মেয়ে বাসায় খালিপায়ে হাঁটাহাঁটি করে তারা খুব নরম স্বভাবের হয় বলে আমি জানি।
এষা অস্বস্তির সঙ্গে বলল, আমার পরীক্ষা আছে। আমি পড়তে যাব। একা একা বসে থাকতে কি আপনার খারাপ লাগবে?
‘খারাপ লাগবে না। পত্রিকা থাকলে দিন, বসে বসে পত্রিকা পড়ি।’
‘আমাদের বাসায় কোন পত্রিকা রাখা হয় না।’
‘ও আচ্ছা।’
‘টিভি দেখবেন, টিভি ছেড়ে দি?’
‘আচ্ছা দিন।’
এষা টিভি ছাড়ল। ছবি ঠিকমত আসছে না। ঝাপসা ঝাপসা ছবি।
এষা বলল, অ্যান্টেনার তার ছিড়ে গেছে বলে এই অবস্থা।
‘আমার অসুবিধা হচ্ছে না।’
‘আমি খুব লজ্জিত যে আপনাকে একা বসিয়ে রেখে চলে যেতে হচ্ছে।’
‘লজ্জিত হবার কিছু নেই।’
‘আপনি কাইন্ডলি পাশের চেয়ারটায় বসুন। এই চেয়ারটা ভাঙা। হেলান দিয়ে পড়ে যেতে পারেন।’
আমি পাশের চেয়ারে বসলাম। কিছু-কিছু বাড়ি আছে-যার কোনো কিছুই ঠিক থাকে না। এটা বোধহয় সেরকম একটা বাড়ি। দেয়ালে বাঁকাভাবে ক্যালেন্ডার ঝুলছে, যার পাতা ওল্টানো হয়নি। ডিসেম্বর মাস চলছে—ধুলা জমে আছে।
আমি ক্যালেন্ডার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকালাম টিভির দিকে। নাটক হচ্ছে।
মাঝখান থেকে একটা নাটক দেখতে শুরু করলাম। এটা মন্দ না। পেছনে কি ঘটে গেছে আন্দাজ করতে করতে সামনে এগিয়ে যাওয়া—নাটকে একটি মধ্যবয়স্ক লোক তার স্ত্রীকে বলছে—এ তুমি কি বলছ সীমা? না না না। তোমার এ কথা আমি গ্রহণ করতে পারি না। বলেই ভেউ ভেউ করে মুখ বাঁকিয়ে কান্না।
সীমা তখন কঠিন মুখে বলছে—চোখের জলের কোনো মূল্য নেই ফরিদ। এ পৃথিবীতে অশ্রু মূল্যহীন।
কিছুদুর নাটক দেখার পর মনে হল এরা স্বামী-স্ত্রী নয়। নাটকের স্ত্রীরা স্বামীদের নাম ধরে ডাকে না।সহপাঠী প্রেমিক-প্রেমিকা হতে পারে। মাঝবয়েসী প্রেমিক-প্রেমিকা। ব্যাপারটায় একটু খটকা লাগছে। যথেষ্ট আগ্রহ নিয়ে নাটক দেখছি। মাঝখান থেকে নাটক দেখার এত মজা আগে জানতাম না। জিগ-স পাজল-এর মত। পাজল শেষ করার আনন্দ পাওয়া যাচ্ছে। নাটক শেষ হল।
মিলনান্তক ব্যাপার। শেষ দৃশ্যে সীমা জড়িয়ে ধরেছে ফরিদকে। ফরিদ বলছে—জীবনের কাছে আমরা পরাজিত হতে পারি না সীমা। ব্যাকগ্রাউন্ডে রবীন্দ্রসংগীত হচ্ছে—পাখি আমার নীড়ের পাখি। নাটকের শেষ দৃশ্যে রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহার করার একটা নতুন স্টাইল শুরু হয়ে হয়েছে—যার ফলে গানটা ভাল লাগে, নাটক ভাল লাগে না।
আমি টিভি বন্ধ করে চুপচাপ বসে আছি। েএ বাড়ির ড্রয়িংরুমে সময় কাটাবার মতো কিছু নেই। একটি মাত্র ক্যালেন্ডারের দিকে কতক্ষণ আর তাকিয়ে থাকা যায়!
দরজার কড়া নড়ছে। আমি দরজা খুললাম। স্যুট-টাই পরা এক ভদ্রলোক।
ছেলেমানুষি চেহারা। মাথাভর্তি চুল।এত চুল আমি কারো মাথায় আগে দেখিনি।
হাত বুলিয়ে দেখতে ইচ্ছা করছে। ভদ্রলোককে দেখে মনে হল দরজার কড়া নেড়ে তিনি খুবই বিব্রত বোধ করছেন। আমি বললাম, কি চাই?
ভদ্রলোক ক্ষীণ গলায় বললেন, এষা কি আছে?
‘আছে। ওর পরীক্ষা। পড়াশোনা করছে।’
‘ও, আচ্ছা।’
ভদ্রলোক মনে হল আরো বিব্রত হলেন। আরো সংকুচিত হয়ে গেলেন। আগের চেয়ে ক্ষীণ গলায় বললেন, আমি ওকে একটা কথা বলে চলে যাব।
‘কথা বলতে রাজি হবে কিনা জানি না।’
‘কাইন্ডলি একটু আমার কথা বলুন। বলুন মোরশেদ।’
‘মোরশেদ বললেই চিনবে?’
‘জ্বি।’
‘ভেতরে এসে বসুন, আমি বলছি।’
‘আমি ভেতরে যাব না।এখানেই দাঁড়াচ্ছি।’
‘আচ্ছা দাঁড়ান—কি নাম যেন বললেন আপনার—মোরশেদ?’
‘জ্বি, মোরশেদ।’
আমি কয়েক মুহুর্ত চিন্তা করলাম। কি করা যায়? এখান থেকে এষা এষা করে ডাকা যায়। ডাকতে ইচ্ছা করছে না। সরাসরি বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলে কেমন হয়? এষা কোথায় পড়াশোনা করছে তা আমি জানি। ভেতরের বারান্দার এক কোণায় তার পড়ার টেবিল। দাদীমাকে ধরাধরি করে ভেতরের বারান্দায় ইজিচেয়ারে শুইয়ে দিতে গিয়ে আমি এষার পড়ার টেবিলে দেখেছি। আগে যেহেতু একবার ভেতরে যেতে পেরেছি, এখন কেন পারব না? এষা রেগে যেতে পারে। রাগুক না! মাঝে-মাঝে রেগে যাওয়া ভাল। প্রচণ্ড রেগে গেলে শরীরের রোগজীবাণু মরে যায়। যারা ঘন ঘন রাগে তাদের অসুখবিসুখ হয় না বললেই চলে। আর যারা একেবারেই রাগে না, তারাই দু’দিন পরপর অসুখে ভোগে। সবচে’ বড় কথা, এষাকে খানিকটা ভড়কে দিতে ইচ্ছা করছে। আমাকে চুপচাপ বসিয়ে সে দিব্যি পড়াশোনা করবে তা হয় না। একটু হকচকিয়ে দেয়া যাক।
আমি পর্দা সরিয়ে নিতান্ত পরিচিত জনের মতো ভেতরে ঢুকে গেলাম। এষা চেয়ারে পা তুলে বসেছে। বইয়ের উপর ঝুঁকে আছে। তার মনোযোগ এতই বেশি যে আমার বারান্দায় আসা সে টের পেল না। মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বাচ্চা মেয়েদের মত পড়তেই থাকল। আমি ঠিক তার পেছনে দাঁড়িয়ে খুব সহ গলায় বললাম, এষা, মোরশেদ সাহেব এসেছেন। বাইরে দাঁড়িয়ে আছ্নে। তোমার সঙ্গে একটা কথা বলেই চলে যাবেন।
এষা ভূত দেখার মতো চমকে আমার দিকে তাকাল। আমি বললাম, ভদ্রলোককে কী চলে যেতে বলব? ভেতরে এসে বসতে বলেছিলাম, উনি রাজি হলেন না।
এষা কঠিন গলায় বলল, আপনি দয়া করে বসার ঘরে বসুন। আপনি হুট করে ঘরে ঢুকে গেলেন কী মনে করে?
আমি নিতান্তই স্বাভাবিক গলায় বললাম, ভদ্রলোককে কি বসতে বলব?
‘তাঁকে যা বলার আমি বলব। প্লীজ, আপনি বসার ঘরে যান। আশ্চর্য, আপনি কী মনে করে ভেতরে চলে এলেন?’
আমি এষাকে হতচকিত অবস্থায় রেখে চলে এলাম। ভদ্রলোক বাইরে।সিগারেট ধরিয়েছেন। আমাকে দেখে আস্ত সিগারেট ফেলে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসলেন।আমি বললাম, ভেতরে গিয়ে বসুন, এষা আসছে।
‘আমাকে বসতে বলেছে?’
‘তা বলেনি, তবে আমার মনে হচ্ছে আপনি ভেতরে গিয়ে বসলে খুব রাগ করবে না।’
‘আমি বরং এখানেই থাকি?’
‘আচ্ছা, থাকুন।’
আমি লম্বা লম্বা পা ফেলে রাস্তায় চলে এলাম। আপাতত রাস্তার দোকানগুলির কোন-একটিতে বসে চা খাব। ইতিমধ্যে ভদ্রলোকের সঙ্গে এষার কথাবার্তা শেষ হবে—আমি আবার ফিরে যাব। ফিরে নাও যেতে পারি। এই জগৎ সংসারে আগেভাগে কিছুই বলা যায় না।
শীতের রাতে ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খাবার অন্যরকম আনন্দ আছে। চা খেতে-খেতে মাঝে-মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে আকাশের তারা দেখতে হয়। সারা শরীরে লাগবে কনকনে শীতের হাওয়া, হাতে থাকবে চায়ের কাপ। দৃষ্টি আকাশের তারার দিকে।তারাগুলিকে তখন মনে হবে সাদা বরফের ছোট-ছোট খণ্ড। হাত দিয়ে ছুঁতে ইচ্ছা করবে, কিন্তু ছোঁয়া যাবে না।
পরপর দু’কাপ চা খেয়ে তৃতীয় কাপের অর্ডার দিয়েছি, তখন দেখি মোরশেদ সাহেব হনহন করে যাচ্ছেন। মাটির দিকে তাকিয়ে এত দ্রুত আমি কাউকে হাঁটতে দেখিনি। আমি ডাকলাম—এই যে ভাই মোরশেদ সাহেব!
ভদ্রলোক থমকে দাঁড়ালেন। খুবই অবাক হয়ে তাকালেন। নিতান্তই অপরিচিত কেউ নাম ধরে ডাকলে আমরা যেরকম অবাক হই—সেরকম অবাক। ভদ্রলোক আমাকে চিনতে পারছেন না। আশ্চর্য আত্মভোলা মানুষ তো! আমি বললাম, চা খাবেন মোরশেদ সাহেব?
‘আমাকে বলছেন?’
‘হ্যাঁ, আপনাকেই বলছি। আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন না?’
‘জ্বি-না।’
‘একটু আগেই দেখা হয়েছে।’
ভদ্রলোক আরো বিস্মিত হলেন। আমি বললাম, এখন কি চিনতে পেরেছেন?
তিনি মাথা নেড়ে বললেন, জ্বি জ্বি। মাথা নাড়ার ভঙ্গি দেখেই বুঝতে পারছি তিনি মোটেই চেনেননি। আমি বললাম—এষার সঙ্গে কথা হয়েছে?
‘জ্বি, হয়েছে। এখন আপনাকে চিনতে পেরেছি। আপনি এষার ছোটমামা। এষাকে ডেকে দিয়েছেন।’
‘আপনার স্মৃতিশক্তি খুবই ভাল। আমি অবশ্যি এষার ছোটমামা না। সেটা কোনো বড় কথা না। এষা আপনার সঙ্গে কথা বলেছে। এটাই বড় কথা।’
‘এষা কথা বলেনি।’
‘কথা বলেনি?’
‘জ্বি-না। আমাকে দেখে প্রচণ্ড রাগ করল। আপনি তো জানেন ও রাগ করলে কেঁদে ফেলে—কেঁদে ফেলল। তারপর বলল, বের হয়ে যাও।এক্ষুণি বের হও। আমি চলে এসেছি।’
‘ভাল করেছেন। আসুন চা খাওয়া যাক।’
‘আমি চা খাই না। চা খেলে রাতে ঘুম হয় না।’
‘তা হলে চা না খাওয়াই ভাল। এষা আপনার কে হয়?’
‘ও আমার স্ত্রী।’
‘আমি তাই আন্দাজ করছিলাম। চলুন যাওয়া যাক।’
‘চলুন।’
বড় রাস্তায় গিয়ে ভদ্রলোক রিকসা নিলেন। খিলগাঁ যাবেন। রিকসাওয়ালাকে বললেন, ১৩২ নম্বর খিলগাঁ, একতলা বাড়ি। সামনে একটা বড় আমগাছ আছে। রিকসাওয়ালাকে এইভাবে বাড়ির ঠিকানা দিতে আমি কখনো শুনিনি। তিনি রিকসায় উঠে বসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ছোটমামা, আপনি কোনদিকে যাবেন? আসুন আপনাকে নামিয়ে দি।
আমি এষার ছোট মামা নই। কিন্তু মনে হচ্ছে ভদ্রলোককে এইসব বলা অর্থহীন। তাঁর মাথায় ছোটমামার কাঁটা ঢুকে গেছে। সেই কাঁটা দূর করা এত সহজে সম্ভব না।
আমি বললাম, মোরশেদ সাহেব আমি উল্টোদিকে যাব।
‘আপনি এষাকে একটু বলবেন যে আমি সরি। একটা ভুল হয়ে গেছে।এরকম ভুল আর হবে না।’
‘যদি দেখা হয় বলব। অবশ্যই বলব।’
‘যাই ছোটমামা?’
‘আচ্ছা, আবার দেখা হবে।’
আমি উল্টোদিকে হাঁটা ধরলাম। এষাদের বাড়িতে আবার ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে না। কি করব এখনো ঠিক করিনি। ঘণ্টাখানিক রাস্তায় হেঁটে মেসে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ব। রাতের খাওয়া এখনো হয়নি—কোথায় খাওয়া যায়? কুড়ি টাকার একটা নোট পকেটে আছে।অনেক টাকা। কুড়ি কাপ চা পাওয়া যাবে। একজন ভিখিরির দু’দিনের রোজগার। ঢাকা শহরে ভিখিরিদের গড় রোজগার দশ টাকা। এই তথ্য ইয়াদের কাছ থেকে পাওয়া।সে হল আমার বোকা বন্ধুদের একজন। ইয়াদের অঢেল টাকা। টাকা বোকা মানুষকেও বুদ্ধিমান বানিয়ে দেয়। ইয়াদকে বুদ্ধিমান বানাতে পারেনি।ইয়াদদের পরিবারের যতই টাকা হচ্ছে, সে ততই বোকা হচ্ছে।
ইয়াদ ভিখিরিদের উপর গবেষণা করছে। তার পিএইচি.ডি. ডি থিসিসের বিষয় হল‘ভাসমান জনগোষ্ঠীঃ আর্থ-সামাজিক নিরীক্ষার আলোকে’।ইয়াদকে অনেক ডাটা কালেক্ট করতে হচ্ছে। আমি তাকে সাহায্য করছি। সাহায্য করার মানে হল—তার একটা বিশাল পেটমোটা কালো ব্যাগ হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো।
তার কালো ব্যাগে পাওয়া যাবে না এমন জিনিস নেই। কাগজপত্র ছাড়াও ছোট একটা টাইপ রাইটার। বোতলে ভর্তি চিড়া-গুড়। ইনসটেন্ট কফি, চিনি, ফার্স্ট এইডের জিনিসপত্র। একগাদা লম্বা নাইলনের দড়িও আছে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম—দড়ি কি জন্যে রে ইয়াদ? সে মুখ শুকনো করে বলেছে—কখন কাজে লাগে বলা তো যায় না। রেখে দিলাম। ভাল করিনি? ভাল করিনি—বলাটা ইয়াদের মুদ্রাদোষ! কিছু বলেই খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে বলবে—ভাল করিনি?’
রাত একটার দিকে মজনুর দোকানে ভাত খেতে গেলাম। ভাতের হোটেলের সাধারণত কোনো নাম থাকে না। এটার নাম আছে। নাম হল—‘‘মজনু মিয়ার ভাত মাছের হোটেল।’’
বিরাট সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ডের এক মাথায় একটা মুরগির ছবি, আরেক মাথায় ছাগলের ছবি। ভাত-মাছের ছবি নেই। মজনুর দোকানে ভাত খেতে যাওয়ার আদর্শ সময় হল রাত একটা। কাস্টমাররা চলে যায়। কর্মচারীরা দু’টা টেবিল একত্র করে গোল হয়ে খেতে বসে। ওদের সঙ্গে বসে পড়লেই হল। মজনুর ‘ভাত-মাছের হোটেলে’র ঝাঁপ ফেলে দেয়া হয়েছে। বয়-বাবুর্চি একসঙ্গে খেতে বসেছে। খাবার যা বাঁচে তাই শেষ সময়ে খাওয়া হয়। আজ ওদের ভাগ্য ভাল—রুই মাছ। খাসি দু’টাই বেঁচে গেছে। প্রচুর বেঁচেছে। শুধু ভাত নেই। অল্পকটা আছে, তাই একটা টিনের থালায় রাখা আছে। তরকারির চামচে এক চামচ করেও সবার হবে না।আমাকে দেখে এরা জায়গা করে দিল।মজনু মিয়া বিরসমুখে বললেন, হিমু ভাই রোজ দেরি করেন। আপনার মতো কাস্টমার না থাকা ভাল। বড়ই যন্ত্রণা।
আমি বললাম, ভাত নেই নাকি?
‘যা আছে আপনার হয়ে যাবে। আপনে খান। ওরা মাছ, গোছ খাবে। এতবড় পেটি একটা খেলে পেট ভরে যায়।’
‘খানিকটা ভাত রান্না করে ফেললে কেমন হয়?’
‘হিমু ভাই, আপনি আর যন্ত্রণা করবেন না তো! রাত একটার সময় ভাত রানবে?’
‘অসুবিধা কি?’
‘অসুবিধা আছে। চাল নাই। পোলাওয়ের চাল সামান্য আছে—সকালে বিরানী হবে। এই, তোরা খা। আমি চললাম।
আর শুনেন হিমু ভাই, আপনার ঐ পাগলা বন্ধু ইয়াদ সাহেবকে আমার এখানে আসতে নিষেধ করে দিবেন। আজ একদিনে দুইবার দুইবার এসেছে আপনার খোঁজে। দুইবারেই খুব যন্ত্রণা করেছে। বলে, চা দিন। দিলাম চা। বলে কাপ পরিষ্কার হয়নি। গরম পানি দিয়ে ধুয়ে নিন, আমি ডাবল দাম দিব। দিলাম গরম পানি দিয়ে ধুয়ে।চা মুখে দিয়ে থু করে ফেলে দিয়ে বলে-চিনি কম দিয়ে আরেক কাপ দিতে বলুন, আমি ডবল দাম দিব।কথায় কথায় ডবল দাম। আরে ডবল দাম চায় কে তার কাছে?এতগুলো কাস্টমারের সামনে যে থু করে চা ফেলল, আমার অপমান হয় না? আপনি আপনার বন্ধুকে বলে দিবেন।
‘ইয়াদকে আমি বলে দেব।’
‘আজেবাজে লোককে হোটেল চিনায়ে দিয়েছেন, এরা জান শেষ করে দেয়।’
মজনু মিয়া ক্যাশ নিয়ে চলে গেল। টিনের থালায় এক থালা ভাত নিয়ে আমরা ছ’জন মানুষ চুপচাপ বসে আছি। বাবুর্চির নাম মোস্তফা। মোস্তফা বসেছে আমার পাশে। সে ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত।মোস্তফা বলল, হিমু ভাই, আফনে খান। রুই মাছটা ভাল ছিল। আরিচার মাছ। খেয়ে আরাম পাইবেন।
‘আমি একা ভাত খাব, আপনারা শুধু তরকারি?’
‘অসুবিধা কিছু নাই ভাইজান।’
‘অসুবিধা আছে। চুলা ধরান, পোলাওয়ের চাল বসিয়ে দিন। পোলাও রান্না করে ফেলুন। ভাল মাছ আছে, পোলাও দিয়ে আরাম করে খাই।
বাবুর্চি অন্যদের দিকে তাকাল। সবার চোখই চকচক করছে।আমি বললাম, মাছের তরকারি ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। গরম করতে হবে। চুলা তো ধরাতেই হবে।
মোস্তফা ক্ষীণ গলায় বলল, মালিক শুনলে খুবই রাগ হইব।
‘শুনবে কেন? শুনবে না। তা ছাড়া আগামী দু’ দিন মালিক দোকানে আসবে না।’
‘পোলাও বসাইয়া দিমু?’
‘দিন।’
‘সকালের জইন্যে মুরগি কাটা আছে। মোরগ-পোলাও বসাইয়া দিমু ভাইজান?’
‘আইডিয়া মন্দ না। যাহা বাহান্ন তাহা পঁয়ষট্টি। পোলাও যখন হচ্ছে মোরগ পোলাওয়ে অসুবিধা কি! কতক্ষণ লাগবে?’
‘ডাবল আগুন দিয়া রানলে আধা ঘণ্টার মামলা ভাইজান।’
‘দিন ডাবল আগুন। সিঙ্গেল আগুনে আজকাল কিছু হয় না।’
মজনু মিয়ার ভাত-মাছের দোকানের কর্মচারীদের চোখ-মুখ আনন্দে ঝলমল করতে লাগল। আমি বললাম, রান্নাবান্না হোক, আমি আধ ঘণ্টা পর আসব।
‘চা বানাইয়া দেই ভাইজান? বইসা বইসা গরম চা খান।’
‘চা খেয়ে খিদে নষ্ট করব না। ভাল-ভাল জিনিস রান্না হচ্ছে।’
আমি চলে গেলাম তরঙ্গিণী ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোরে। ডাকাডাকি করে মুহিব সাহেবের ঘুম ভাঙালাম। তিনি ষ্টোরের ভেতরেই ঘুমান। মুহিব সাহেব দরজা খুলে সহজ গলায় বললেন, কি দরকার হিমুবাবু?
‘ছ’ বোতল ঠাণ্ডা কোক দিন তো!’
মুহিব সাহেব ছ’টা বোতল পলিথিনের ব্যাগে করে নিয়ে এলেন। একবারও জিজ্ঞেস করলেন না, রাত দেড়টায় কোক কি জন্যে।
‘মুহিব সাহেব, সঙ্গে টাকা নেই। টাকা পরে দিয়ে যাব।’
‘জ্বি আচ্ছা। আপনি আমার জন্যে একটু দোয়া করবেন হিমু ভাই। খাসদিলে দোয়া করবেন।’
‘আবার কি হল?’
‘কিছু হয় নি।এম্নি বললাম। আজ আপনার জন্মদিন। একটা শুভদিন।’
‘জন্মদিন আপনি জানতেন?’
‘জানব না কেন? জানি। সকালবেলা একবার আপনার কাছে যাব ভেবেছিলাম—যেতে পারিনি।ছুটি পেলাম না। যাক, তবু শুভদিনে শেষ পর্যন্ত দেখা হল।’
‘শুভ দিনে দেখা হয়নি মুহিব সাহেব—এখন প্রায় দু’টা বাজতে চলল।জন্মদিনের মেয়াদ শেষ। যাই—’
মুহিব সাহেব দুঃখিত চোখে তাকিয়ে রইলেন। ছ’ বোতল কোক নিয়ে আমি বের হয়ে এলাম। মজনু মিয়ার ভাত-মাছের হোটেলের লোকজন নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে আমার জন্যে। ভাল শীত পড়েছে। শীতের সময় সবাই খুব দ্রুত হাঁটে। আমি ধীরে-ধীরে এগুচ্ছি। গায়ে শীত মাখিয়ে হাঁটতে ভাল লাগছে। রাতে হাঁটার সময় আপনাতেই আকাশের দিকে চোখ যায়। প্রাচীণ কালে মানুষ আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ ভ্রমণে বেরুত। সব মানুষই বোধহয় সেই প্রাচীণ স্মৃতি তার ‘জীনে’ বহন করে।
ঘরের ভেতর দুটা চিঠি
ঘরের ভেতর দু’টা চিঠি। একটির খাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে রুপার কাছে থেকে এসেছে। কার্টিস পেপারে ধবধবে সাদা খাম। খামের এক মাথায় রুপালি কালিতে এমবস করা রুপার নাম। সাদার উপর রুপালি ফোটে না, তবুও এটাই রুপার স্টাইল। অন্য চিঠিটি ব্রাউন কাগজের। ঠিকানা ইংরেজিতে টাইপ করা। দু’টা চিঠির কোনোটিতেই স্ট্যাম্প নেই—হাতে হাতে পৌছে দেয়া। আমি রুপার চিঠি পকেটে রেখে অন্যটা খুললাম।
যা ভেবেছি তাই—ইয়াদের লেখা। টাইপ করা চিঠি ।ইংরেজি ভাষায়—টেলিগ্রাফের ধরণে লেখা।