কিরে ব্যাটা, মাকে দেখতে যাবি না? চল দেখে আসি?
না।
তাহলে একটা কাজ কর— রাক্ষসেরা ছবিটা দিয়ে দে, তোর মাকে দিয়ে আসি। ছবির এক কোনায় লাল রঙ দিয়ে লিখে দে— মা। মা লিখতে পারিস?
পারি।
সুন্দর করে মা লিখে চারদিকে লতা-ফুল-গাছ দিয়ে ডিজাইন করে দে। পারবি না।
পারব।
পারলে তাড়াতাড়ি কর। কান্না বন্ধ। কাঁদতে কাঁদতে যে ডিজাইন করা হয়। সে ডিজাইন ভালো হয় না।
ইমরুল কান্না থামিয়ে ডিজাইন করার চেষ্টা করছে। কান্না পুরোপুরি থামছে না। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো কিছুক্ষণ পর পর উঠে আসছে। আচ্ছা— কান্নার সঙ্গে তো সমুদ্রের খুব মিল আছে। সমুদ্রের জল নোনা। চোখের জল নেন। সমুদ্রে ঢেউ ওঠে। কান্নাও আসে ঢেউয়ের মতো।
কোনো কোনো মানুষকে কি অসুস্থ অবস্থায় সুন্দর লাগে? ব্যাপারটা আগে তেমনভাবে লক্ষ করি নি। ফরিদাকে খুবই সুন্দর লাগছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, সে এইমাত্র গরম পানি দিয়ে গোসল করে সেজেগুজে বসে আছে। কোথাও বেড়াতে যাবে। গাড়ি এখনো আসে নি বলে অপেক্ষা। আমি বললাম, কেমন আছ ফরিদা?
ফরিদা বলল, খুব ভালো।
আমি বললাম, তোমাকে দেখেও মনে হচ্ছে–খুব ভালো আছ। রাতে ভালো ঘুম হয়েছে?
রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাই। ঘুম তো ভালো হবেই। তবে কাল রাতে ভালো ঘুম হয় নি।
কেন?
সেটা আপনাকে বলা যাবে না।
ফরিদা মুখ টিপে হাসছে। দুষ্টুমির হাসি। এইসব দুষ্টুমির ব্যাপার তার মধ্যে আগে ছিল না। ইদানীং দেখা দিয়েছে।
ইমরুল তোমার জন্যে উপহার পাঠিয়েছে, ভূতের ছবি। আমি স্কচ টেপ নিয়ে এসেছি। এই ছবি আমি তোমার খাটের পেছনের দেয়ালে লাগিয়ে দেব। ডাক্তাররা রাগ করবে না তো?
রাগ করতে পারে।
ছেলে মার জন্যে ছবি এঁকে পাঠিয়েছে–এটা জানলে রাগ নাও করতে পারে।
আমি ছবি টানিয়ে দিলাম। ফরিদা মুগ্ধ চোখে ছবির দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখ ছলছল করতে লাগল।
হিমু ভাইজান
বলো।
ইমরুল আমাকে দেখতে আসতে চায় না–এটা কি আপনি জানেন?
জানি না।
ও আসতে চায় না। সে যে-কোনো জায়গায় যেতে রাজি, হাসপাতালে আমাকে দেখতে আসতে রাজি না। কেন বলুন তো।
মনে হয়। হাসপাতাল তার পছন্দ না।
ফরিদা বিছানায় শুয়ে পড়তে পড়তে বলল, আমার ধারণা সে বুঝে ফেলেছে আমি বাঁচব না। এই জন্যে আগে থেকে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছে। আমার ধারণা কি ঠিক হিমু ভাই?
আমি বললাম, ঠিক হতে পারে।
ফরিদা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি মরে গেলে ওর বাবা ওকে নিয়ে বিরাট বিপদে পড়বে। ঠিক না হিমু ভাই?
আমি বললাম, বিপদে তো পড়বেই।
ও কী করবে বলে আপনার ধারণা?
প্রথম কিছুদিন খুব কান্নাকাটি করবে। তারপর ইমরুলের দেখাশোনা দরকার–এই অজুহাতে অল্পবয়সী একটি তরুণী বিয়ে করবে। তরুণীর মন জয়ের জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা চালাতে থাকবে। প্রমাণ করার চেষ্টা করবে। যে তার প্রথম স্ত্রীর চেয়ে এই স্ত্রী মানুষ হিসেবে অনেক ভালো। প্রায় তুলনাহীন।
ফরিদা হাসছে। প্ৰথমে চাপা হাসি, পরে শব্দ করে হাসি। সে মনে হলো খুবই মজা পাচ্ছে। হাসি থামাবার জন্যে তাকে মুখে আচল চাপা দিতে হলো।
হিমু ভাই।
বলো।
আমার মৃত্যুর পর আপনি যা করবেন তা হলো ছেলে-মেয়ে নেই এমন কোনো পরিবারে ইমরুলকে দত্তক দিয়ে দেবেন। যাতে ওরা তাকে নিজের সন্তানের মতো মানুষ করে।
আমি বললাম, আচ্ছা।
ফরিদা দুঃখিত গলায় বলল, আপনি এত সহজে আচ্ছা বললেন? আপনার আচ্ছা! বলতে একটুও মন খারাপ হলো না? আপনি যে হৃদয়হীন একজন মানুষ–এটা কি আপনি জানেন হিমু ভাই?
আমি হাঁ-সূচক মাথা নাড়লাম।
মিসেস আসমা হক পিএইচডি
মিসেস আসমা হক
পিএইচডি
পরম শ্রদ্ধাভাজনেষু,
আমার সালাম গ্ৰহণ করুন। আশা করি মঙ্গলময়ের অসীম করুণায় আপনি সুস্থ দেহে সুস্থ মনে শান্তিতে বাস করিতেছেন। আপনার স্বামীকেও আমার আসসালাম। আল্লাহপাকের কাছে আপনাদের সুখ কামনা করি। আল্লাহপাক গুনাহগার বান্দার দেয়া কবুল কর। আমিন।
এখন কাজের কথায় আসি— জনাবা, আমার কোম্পানি হিমু শিশু সাপ্লাই কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড] আপনার জিনিস ডেলিভারি দিবার জন্য প্ৰস্তুত আছে। আমার কোম্পানি আপনার জন্য যে শিশুটি বাছিয়া রাখিয়াছে ইনশাআল্লাহ সে এক্সপোর্ট কোয়ালিটি। আপনি মাজেদা খালার পূর্বপরিচিত। আপনার কাছে বাজে মাল গছাইব না। এতে কোম্পানির সম্মানহানী হয় এবং আত্মীয়স্বজনের কাছেও মুখ ছোট হয়। আমার কোম্পানি একদিনের ব্যবসায়ী নয়। সুনামের সাথে আমরা দীর্ঘদিন ব্যবসা করিব ইহাই আমাদের অঙ্গীকার। আমার কোম্পানি যে শিশুটিকে ঠিক করিয়াছে তাহার নাম ইমরুল। আপনি যে-সব শর্ত আরোপ করিয়াছেন এই শিশুটি ইনশাল্লাহ সব শর্তই পূরণ করে। দুই একটি ক্ষেত্রে একটু উনিশ-সাড়ে উনিশ হইতে পারে। ইহা নিজগুণে ক্ষমা করিবেন। আপনি শিশুটির ওজন পঁচিশ হইতে ত্ৰিশ পাউন্ডের ভিতর থাকিতে হইবে–এমন শর্ত দিয়াছেন। ইমরুলের ওজন তার চেয়ে কম।
সে খুব অসুখ-বিসুখে ভুগে বলিয়া শরীরের ওজনের তেমন বৃদ্ধি নাই। কয়েকদিন যাবত সে হামে শয্যাশায়ী। খাওয়া-দাওয়া কমিয়া গিয়াছে। সে আরোগ্য লাভ করা মাত্র হাইপ্রোটিন ডায়েটের মাধ্যমে তার ওজন বৃদ্ধি করা হইবে। আপনি শুনিয়া আনন্দিত হইবেন যে বাংলাদেশে চিকন স্বাস্থ্য মোটা করিবার ভালো ব্যবস্থা আছে। বড় বড় রাস্তার দুই পাশে সচিত্র বিজ্ঞাপন আছে— চিকন স্বাস্থ্য মোটা করা হয়। আমি এদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়া সঠিক পন্থা অবলম্বন করিব। শিশু ডেলিভারি নিবার পূর্বে আপনার সামনে তাকে ওজন করা হইবে।