হাবিবুর রহমান দুঃখিত গলায় বললেন, হিমু ভাই, কিছু মনে করবেন নাআপনি সবসময় ধোঁয়াটে ভাষায় কথা বলেন, আমি বুঝতে পারি না। আমার খুবই কষ্ট হয়।
বুঝিয়ে দেই?
দরকার নেই, বুঝিয়ে দিতে হবে না। আপনাকে দেখে ভালো লাগছে এটাই বড় কথা। আপনাকে যখনই দেখি তখনই ভরসা পাই। চা খাবেন?
চা-পাতা চিনি এইসব আছে, নাকি কিনে আনতে হবে?
চা-পাতা চিনি আছে। দুধও আছে। আপনি আসবেন জানি, এই জন্যে আনিয়ে রেখেছি।
হাবিবুর রহমান চা বানাতে রান্নাঘরে ঢুকলেন। আমিও তাঁর সঙ্গে গেলাম। পাপপুণ্য বিষয়ক যে থিওরি মাথায় এসেছে, সেই থিওরিটা ব্যাখ্যা না করা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছি।
জি।
হাবিবুর রহমান সাহেব।
জি।
আপনি কি নীলক্ষেতে পশুপাখির দোকানে কখনো গিয়েছেন?
জি।
টিয়া পাখির সিজনে যাবেন, দেখবেন অসংখ্য টিয়া পাখি তারা খাঁচায় বন্দি করে। রেখেছে। পঞ্চাশ টাকা করে পিস বিক্রি করে। আপনি যদি দুটা টিয়া পাখি একশ টাকায় কিনে খাঁচা খুলে পাখি দুটা আকাশে ছেড়ে দেন, ওদের বন্দিদশা থেকে মুক্ত করেন, তাহলে কি আপনার পুণ্য হবে না?
জি, হবার কথা। এখন ভালোমতো চিন্তা করে দেখুন–আপনি যাতে পুণ্য করতে পারেন। তার জন্যে একজনকে পাপ করতে হয়েছে। স্বাধীন পাখিগুলি ধরে ধরে বন্দি করতে হয়েছে। কাজেই যতটুকু পাপ ততটুকু পুণ্য। Conservation of energy-র মতো Conservation of পাপ।
ভাই সাহেব, আপনি খুবই অদ্ভুত মানুষ। চা-টা কি বেশি কড়া হয়ে গেছে?
আমি চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, অসাধারণ চা হয়েছে। না কড়া, না পাতলা।
হাবিবুর রহমান ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ফরিদাও আমার হাতে বানানো চা খুব পছন্দ করে। রাতে ঘুমোতে যাবার সময় সে বলবে–এক কাপ চা বানিয়ে দাও না প্লিজ! আচ্ছা হিমু সাহেব, বেহেশতে কি চা পাওয়া যাবে?
বেহেশতে চা পাওয়া যাবে কি-না এই খোঁজ কেন নিচ্ছেন?
হাবিবুর রহমান অস্বস্তির সঙ্গে বললেন, ফরিদার কথা ভেবে বলেছি। ও যে টাইপ মেয়ে, বেহেশতে যে যাবে এটা তো নিশ্চিত। তার চা এত পছন্দা বেহেশতে চা পাওয়া গেলে সে নিশ্চয়ই আরাম করে খেত।
উনার পছন্দ আপনার হাতে বানানো চা। গোলমানদের হাতের বানানো চা খেয়ে উনি তৃপ্তি পাবেন বলে মনে হয় না। চা যত ভালোই হোক আমার ধারণা উনি ভুরু কুঁচকে বলবেন, বেহেশতের এত নামডাক শুনেছি, কই এখানকার চা তো ইমরুলের বাবার হাতের চায়ের মতো হচ্ছে না।
হাবিবুর রহমান হেসে ফেলে বললেন, মনে হচ্ছে কথাটা আপনি ভুল বলেন নি। ইমরুলের জন্মের পরের ঘটনা কি আপনাকে বলেছি?
কি ঘটনা?
ফরিদা যখন শুনল তার ছেলে হয়েছে, কেন্দো-কেটে অস্থির। ছেলেকে কোলে পর্যন্ত নিবে না।
এমন অবস্থা! কেন?
কারণ আমি চেয়েছিলাম মেয়ে হোক। ফরিদার সব কিছু আমাকে ঘিরে। এখন সে মারা যাবে বিনা চিকিৎসায়, আমি কিছুই করতে পারছি না–এটা হলো কথা।
বিশ হাজার টাকা জোগাড় হয় নি?
হাবিবুর রহমান ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, না। চেষ্টাও করি নি।
কেন?
বিশ হাজার টাকা। যদি জোগাড় করি, বাকিটা পাব কোথায়?
আমি বললাম, সেটা অবশ্য একটা কথা।
হাবিবুর রহমান বললেন, ফরিদা আমার সঙ্গে থাকবে না–মানসিকভাবে এই সত্যি আমি মেনে নিয়েছি। ইমরুলকে কীভাবে বোঝাব মাথায় আসছে না।
আমি বললাম, এইসব জটিল জিনিস ছোটরা খুব সহজে বুঝতে পারে। ইমরুলকে নিয়ে আপনি মোটেই চিন্তা করবেন না।
আরেক কাপ চা কি দেব হিমু ভাই?
দিন আরেক কাপ।
আমি দুকাপ চা শেষ করে উঠে দাঁড়ালাম। হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললাম, ও আচ্ছা, ইমরুলের জন্মদিনের উপহার তো দেয়া হলো না। আজ উপহার নিয়ে এসেছি। ঐদিন খালি হাতে জন্মদিনে এসেছিলাম। তখনই ভেবে রেখেছি। পরে যখন আসব। কোনো উপহার নিয়ে আসব।
হাবিবুর রহমান বললেন, কী যে আপনি করেন হিমু ভাই। গরিবের ছেলের আবার জন্মদিন কী? তারিখটা মনে রেখে আপনি যে এসেছেন এই খুশিই আমার রাখার জায়গা নাই। কী গিফট এনেছেন?
ক্যাশ টাকা এনেছি। গিফট কেনার সময় পাই নি।
আমি টাকার বান্ডিলটা হাবিবুর রহমান সাহেবের দিকে এগিয়ে দিলাম। হাবিবুর রহমান সাহেব অনেকক্ষণ টাকার বান্ডিলের দিকে তাকিয়ে থেকে শান্ত গলায় বললেন, এখানে বিশ হাজার টাকা আছে, তাই না?
আমি বললাম, হুঁ।
তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। চোখের পানি বিষয়ে আমার কিছু বক্তব্য আছে। আমি লক্ষ করেছি, শুধুমাত্র কুমারী মেয়েদের চোখের পানি দেখতে ভালো লাগে। পুরুষ মানুষের চোখের পানি দেখা মাত্রই রাগ ভাব হয়। বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধার চোখের পানি বিরক্তি তৈরি করে।
আমি হাবিবুর রহমান সাহেবের চোখের পানি কিছুক্ষণ দেখলাম। আমার রাগ উঠে গেল। আমি তার দিকে না তাকিয়ে বললাম, যাই। তিনি জবাব দিলেন না। আমি চলে এলাম বারান্দায়। ইমরুল এখনো ভূতের ছবি একে যাচ্ছে। আমি বললাম, ইমরুল যাই। সে মাথা নিচু করে ফেলল। এটা তার কান্নার প্রস্তুতি। আমি চলে যাচ্ছি— এই দুঃখে সে কিছুক্ষণ কাঁদবে। আগে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদত। এখন মা পাশে নেই। কাঁদার ব্যাপারটা তাকে একা একা করতে হয়।
কাঁদছিস না-কি?
হুঁ।
ভালোই হলো। বাপ-বেটা দুজনের চোখেই জল। চোখের জলে চোখের জলে ধুল পরিমাণ। মাকে দেখতে যাবি?
না।
না কেন? মাকে দেখতে ইচ্ছা করে না?
ইমরুল জবাব দিল না। চোখ মুছে ফোঁপাতে লাগল। ইমরুলের চরিত্রের এই ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হচ্ছে না। যে মায়ের জন্যে তাঁর এত ভালোবাসা অসুস্থ হবার পর সেই মারি প্রতি তার কোনো আগ্রহ নেই কেন? সে কি ধরেই নিয়েছে মা আর সুস্থ হয়ে ফিরবে না?