ইমরুল বারান্দায় বসে ছবি আঁকছিল। আমাকে দেখেই ফিক করে হেসে অন্য দিকে ঘুরে বসল। দুহাত দিয়ে ছবি ঢেকে ফেলল।
আমি বললাম, অন্য দিকে তাকিয়ে আছিস কেন? আমার দিকে তাকা। ইমরুল তাকাল না। গভীর মনোযোগে ছবি আঁকতে থাকল। সে সাধারণ ছবি আঁকতে পারে। না। রাক্ষসেরা ছবি আঁকে। তবে ভয়ঙ্কর রাক্ষস না। প্রতিটি রাক্ষস হাস্যমুখী। আমাকে চিনতে না পারা হলো ইমরুলের স্বভাব। তার সঙ্গে যতবার দেখা হয় ততবারই প্ৰথম কয়েক মিনিট ভাব করে–যেন আমাকে চিনতে পারছে না।
আমি বললাম, তোর খবর কী রে?
ইমরুল জবাব দিল না। আমাকে চিনতে পারছে না–এখন সে এই ভাবের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।
কিসের ছবি আঁকছিস?
রাক্ষসের।
কোন ধরনের রক্ষস? পানির রাক্ষস না-কি শুকনার রাক্ষস?
পানির রাক্ষস।
রাক্ষসটার নাম কী?
নাম দেই নাই।
নাম না দিলে হবে? তোর নিজের নাম আছে আর রাক্ষসটার নাম থাকবে না?
তুমি নাম দিয়ে দাও।
রাক্ষসটা কেমন এঁকেছিস দেখা, তারপর নাম ঠিক করব। চেহারার সাথে তার নামের মিল থাকতে হবে। কানা রক্ষসের নাম পদ্মলোচন রাক্ষস দেয়া যাবে না। তোর বাবা কি বাসায় আছে?
হুঁ।
আমি তোর বাবার কাছে যাচ্ছি। ছবি আঁকা শেষ হলে আমার কাছে নিয়ে আসবি। আকিকা করে নাম দিয়ে দেব।
আকিকা কী?
আছে একটা ব্যাপার। নাম দেয়ার আগে আকিকা করতে হয়। ছেলে রাক্ষস হলে দুটা মুরগি লাগে, মেয়ে রাক্ষসের জন্যে লাগে একটা। তুই যে রাক্ষসটা আঁকছিস সেটা ছেলে না মেয়ে?
ছেলে।
ঠিক আছে, ঐকে শেষ কর। ততক্ষণে তোর বাবার সঙ্গে জরুরি কিছু আলাপ করে নেই।
হাবিবুর রহমান সাহেবের বয়স ত্ৰিশের বেশি হবে না। গত ছমাস ধরে তাকে দেখাচ্ছে পঞ্চাশ বছরের প্রৌঢ়ের মতো। মাথার চুল খাবলা খাব লাভাবে পেকে গেছে। মুখের চামড়া ঝুলে গেছে। গলার স্বরেও শ্লেষ্মা মেশানো বৃদ্ধ ভাব এসে গেছে। শুধু চোখে ছানি পড়াটা বাকি। চোখে ছানি পড়লে ষোলকলা পূর্ণ হয়। গত ছমাস ধরে ভদ্রলোকের চাকরি নেই। তাঁর স্ত্রী ফরিদা গুরুতর অসুস্থ। গত দুমাস ধরে হাসপাতালে আছে। হার্টের ভাম্বে সমস্যা হয়েছে। দূষিত রক্ত, বিশুদ্ধ রক্ত হার্টের ভেতর মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। তাদের মিলমিশ বন্ধ না হলে ফরিদা জীবিত অবস্থায় হাসপাতাল থেকে বের হতে পারবে এমন মনে হয় না। এক লক্ষ টাকার নিচে হাটের অপারেশন হবার সম্ভাবনা নেই। বিশ হাজার টাকা কয়েক দিনের মধ্যে জমা দিতে হবে।
হাবিবুর রহমান ঠাণ্ডা মেঝেতে বালিশ পেতে শুয়েছেন। তাঁর গা খালি। লুঙ্গি অনেকদূর গুটানো। আমাকে দেখে উঠে বসলেন। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে মানুষ যেমন কিছুক্ষণ হকচকানো অবস্থায় থাকে, কী হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছে না। তার সে-রকম হলো। তিনি বিস্মিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কে?
আমি বললাম, আমি হিমু।
ও আচ্ছা আচ্ছা, আপনি কিছু মনে করবেন না। সরি। আমার মাথা পুরাপুরি আউলা অবস্থায় চলে গেছে। বৃষ্টির শব্দ শুনতে এসেছেন? বৃষ্টি হচ্ছে নাকি?
হচ্ছে না। তবে হবে। আপনি ঠাণ্ডা মেঝেতে শুয়ে আছেন কেন?
হাবিবুর রহমান হতাশ গলায় বললেন, হিমু ভাই, শরীর চড়ে গেছে। সারা শরীরে জ্বালাপোড়া। সিমেন্টের ঠাণ্ডা মেঝেতে শুয়ে থাকলে আরাম হয়। তা-ও পুরোপুরি জ্বলুনি কমে না। বরফের চাঙের উপর শুয়ে থাকতে পারলে ভালো লাগত।
আমি বললাম, মাছপট্টি থেকে বরফের একটা চাঙ কিনে নিয়ে আসেন। দাম বেশি পড়বে না।
সত্যি কিনতে বলছেন?
হ্যাঁ। সব চিকিৎসার বড় চিকিৎসা হলো মন-চিকিৎসা। মন যদি কোনো চিকিৎসা করতে বলে সেই চিকিৎসা করে দেখা দরকার। চলুন যাই, বড় দেখে একটা বরফের চাঙ কিনে নিয়ে আসি।
হাবিবুর রহমান হতাশ গলায় বললেন, আপনাকে এত পছন্দ করি। কিন্তু আপনার কথাবার্তা বেশিরভাগই বুঝতে পারি না। কোনটা রসিকতা কোনটা সিরিয়াস কিছুই ধরতে পারি না। ফরিদা দেখি ধরতে পারে। তার বুদ্ধি বেশি। তার তুলনায় আমি পাঠাশ্রেণীর।
ফরিদা আছে কেমন?
ভালো না। ভাব দেখাচ্ছে ভালো আছে। দেখা করতে গেলে ঠাট্টা ফাজলামিও করে। কিন্তু আমি তো বুঝি!
আপনি কীভাবে বুঝবেন? এইসব সূক্ষ্ম বিষয় বুঝতে হলে সূক্ষ্ম বুদ্ধি লাগে। আপনার বুদ্ধি তো পাঠ্য-শ্রেণীর।
হাবিবুর রহমান বললেন, এইসব জিনিস বোঝা যায়। আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি, ফরিদা পনেরো-বিশ দিনের বেশি নাই। ইমরুলকে নিয়ে কী করব আমি এই চিন্তায় অস্থির। আমার একার পক্ষে ইমরুলকে বড় করা সম্ভব না।
দত্তক দিয়ে দিন। ছেলেপুলে নেই এমন কোনো ফ্যামিলির কাছে দিয়ে দিন। ওরা পেলে বড় করুক। বড় হবার পর আপনি পিতৃপরিচয় নিয়ে উপস্থিত হবেন। ছেলে সব ফেলে-ফুলে বাবা বাবা বলে আপনার কাছে ছুটে আসবে। কোকিল। যেমন কাকের বাসায় সন্তান পালন করে, অনেকটা সে-রকম।
হিমু ভাই।
জি।
আপনি কি ঠাট্টা করছেন?
ঠাট্টা করব কী জন্যে?
আমি আমার এত আদরের সন্তানকে অন্যের হাতে তুলে দেব? আমার কষ্টটা দেখবেন না?
অবশ্যই আপনার কষ্ট হবে। আপনার যতটুকু কষ্ট হবে ঠিক ততটুকু আনন্দ হবে। যে ফ্যামিলি আপনার ছেলেকে নেবে। একে বলে ন্যাচারাল ইকুইলিবিয়াম। সাম্যাবস্থা। একজনের যতটুক আনন্দ অন্যের ততটুকু দুঃখ। Conservation of Happiness। হিমুর সেকেন্ড ল অব মেন্টাল ডিনামিক্স।
হিমুর সেকেন্ড ল অব মেন্টাল ডিনামিক্স?
জি, থর্মোডিনামিক্সের লর সঙ্গে কিছু মিল আছে।