স্পেসিফিকেশনগুলি ঠাণ্ডা মাথায় পড়ে দেখেছিস?
দেখেছি, জটিল ব্যাপার। তবে যত জটিল তত সোজা। সত্যি কথা বলতে কী, আমার হাতেই একজন আছে। প্রয়োজনে চব্বিশ ঘণ্টায় মাল ডেলিভারি দিতে পারি।
খালা বিরক্ত মুখে বললেন, পরিষ্কার বুঝতে পারছি তুই আজেবাজে জিনিস গছিয়ে দেবার তালে আছিস।
তোমরা যাচাই করে নেবে। একটা জিনিস কিনবে, দেখে নেবে না?
জিনিস কেনার কথা আসছে। কোত্থেকে?
একই হলো।
মোটেই এক হলো না। এ ধরনের কথা তুই ভুলেও উচ্চারণ করবি না। যে বাচ্চাটা তোর হাতে আছে তার নাম কী?
ইমরুল।
এটা আবার কেমন নাম! শুনলেই চিকেনরোলের কথা মনে হয়। ইমরুল চিকেনরোল।
তোমার বান্ধবী নিশ্চয়ই নাম বদলে নতুন নাম রাখবে। তাদের যেহেতু টাকার অভাব নেই তারা নাম চেয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে পারে। যার নাম সিলেক্ট হবে তার জন্যে ঢাকা-অস্ট্রেলিয়া-ঢাকা রিটার্ন টিকিট।
খালা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আজ বিকেলের মধ্যে ছেলের একটা ছবি নিয়ে আয়, আমি ইন্টারনেটে পাঠিয়ে দেব। ছবি পছন্দ হলে আসমাকে বলব। সে যেন এক সপ্তাহের মধ্যে চলে আসে।
আমি বললাম, এখন আমাকে বায়নার টাকা দাও।
বায়নার টাকা মানে?
ইমরুলকে বায়না করলে বায়নার টাকা দেবে না?
কত দিতে হবে?
আপাতত বিশ হাজার দাও। জিনিস ডেলিভারির সময় বাকিটা দিলেও হবে।
কিছু না দেখেই বায়নার টাকা দেব? ছবিও তো দেখলাম না। এতগুলো টাকা কোন ভরসায় দেব?
আমার ভরসায় দেবে। আমি কি ভরসা করার মতো না?
মাজেদা খালা বিড়বিড় করে বললেন, তোর উপর ভরসা অবশ্যি করা যায়।
তাহলে দেরি করবে না, এখনি টাকা নিয়ে এসো। টাকা ঘরে আছে না?
আছে।
আমি টাকা শুনছি, এমন সময় খালু সাহেব বের হয়ে এলেন। কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বললেন, কিসের টাকা? আমি জবাব দেবার আগেই খালা বললেন, তোমার এত কথা জানার দরকার কী? খালু সাহেব সঙ্গে সঙ্গে চুপসে গেলেন। ক্ষমতাবান কোনো মানুষকে চোখের সামনে চুপসে যেতে দেখলে ভালো লাগে। আমি খালু সাহেবের দিকে তাকিয়ে মধুর ভঙ্গিতে বললাম, খালু সাহেব, আপনার পেটের অবস্থা কী? তিনি জবাব দিলেন না। চুপিসানো অবস্থা থেকে নিজেকে বের করার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন। লাভ হলো না। ফুটো হওয়া বেলুন ফুলানো মুশকিল। যতই গ্যাস দেয়া হোক ফুস করে ফুটো দিয়ে গ্যাস বের হয়ে যাবে। খালার কাছ থেকে টাকা নিয়ে আমি ইমরুলের বাসার দিকে রওনা হলাম। ইমরুলের বাবার হাতে টাকাটা পৌঁছে দিতে হবে।
টিনের চালের একতলা বাড়ি
যে কয়েকটা জিনিস ঢাকা শহর থেকে উঠে গেছে তার একটা হচ্ছে–টিনের চালের একতলা বাড়ি। বাড়ির সামনে নারিকেল গাছ। হঠাৎ হঠাৎ যখন নারিকেল গাছওয়ালা একতলা বাড়ি দেখা যায়। তখন কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। বাড়ির সৌভাগ্যবান মালিকের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলতে ইচ্ছে করে।
টিনের চালের একতলা বাড়ি। বাড়ির সামনে ছটা নারিকেল গাছ। মরুভূমির মধ্যে ওয়েসিসের মতো। আমি থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। টিনের চালে বৃষ্টি অনেকদিন শোনা হয় না। যে সৌভাগ্যবান ভদ্রলোক এই বাড়িতে থাকেন তার সঙ্গে পরিচয় থাকলে ঘোর বর্ষায় এই বাড়িতে এসে উপস্থিত হওয়া যাবে।
আমি গেট খুলে বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম। দরজায় কলিং বেল নেই। পুরনো আমলের কড়া নাড়া সিস্টেম। কড়া নাড়তেই দরজা খুলে গেল। মধ্যবয়ষ্ক এক ভদ্রলোক ভীত চোখে কিছুক্ষণ আমাকে দেখে বললেন, কে?
আমি বললাম, আমার নাম হিমু। কেমন আছেন?
ভদ্রলোক কেমন যেন হকচকিয়ে গেলেন। চুপিসানো গলায় বললেন, ভালো। আপনাকে চিনতে পারলাম না।
আমি বললাম, আমাকে চিনতে পারার কোনো কারণ নেই। আমার সঙ্গে আগে আপনার কখনো দেখা হয় নি। আমি অনেক দিন টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনি না। আপনি যদি অনুমতি দেন কোনো বৃষ্টির দিনে এসে আপনার বাড়ির উঠানে বসে বৃষ্টির শব্দ শুনে যাব।
ভদ্রলোকের চোখে ভয়ের ভাব আরো প্রবল হলো। তিনি কিছুই বললেন না। আমি বললাম, আমাকে মনে হয় আপনি ভয় পাচ্ছেন। আমাকে ভয় পাবার কিছু নেই। আমি খুবই নিরীহ মানুষ। আচ্ছা আজ যাই, কোনো এক বৃষ্টির দিনে চলে আসব।
ভদ্রলোক তারপরেও কোনো কথা বললেন না। দরজার ফাঁক দিয়ে মাধ্যা বের করে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। মাথা ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন না। আমি যখন গোট পার হয়ে রাস্তায় পা দিয়েছি তখন তিনি ডাকলেন—একটু শুনে যান।
আমি ফেরত এলাম। ভদ্রলোক বললেন, এক কাপ চা খেয়ে যান।
হাবিবুর রহমান সাহেবের সঙ্গে পরিচয়ের ঘটনাটা এই। ঝড়-বাদলার দিনে আমি এই বাড়িতে উপস্থিত হই। হাবিবুর রহমান সাহেব আমাকে দেখে খুব যে খুশি হন তা না। কিছুটা সন্দেহ নিয়েই তিনি আমাকে দেখেন, তবে তাঁর স্ত্রী ফরিদা অত্যন্ত খুশি হয়। আনন্দে ঝলমল করতে করতে বলে, বৃষ্টি-ভাই আসছে। আমার বৃষ্টি-ভাই আসছে। বৃষ্টি-বাদলা উপলক্ষে ফরিদা বিশেষ বিশেষ রান্না করে। প্রথম দফায় হয় চালভাজা। কাচামরিচ, সরিষার তেল, পিঁয়াজ দিয়ে মাখানো চালভাজাকে মনে হয় বেহেশতি কোনো খানা। রাতে হয় মাংস-খিচুড়ি। সামান্য খিচুড়ি, ঝোল ঝোল মাংস এত স্বাদু হয় কিসের গুণে কে জানে!
ফরিদা আমাকে দেখে যে রকম খুশি হয়— তার ছেলে ইমরুলও খুশি হয়। এই খুশির কোনোরকম ন্যাকামি সে দেখায় না। বরং ভাব করে যেন আমাকে চিনতে পারছে। না। শুধু যখন আমার চলে যাবার সময় হয় তখন মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে। কাঁদতে থাকে। কান্নার ফাঁকে ফাঁকে বলে–হিমু যাবে না। হিমু থাকবে।