আমি বাবার উপদেশমতো ফরিদার চিঠি কুচি কুচি করে হাওয়ায় উড়িয়ে দিলাম। দক্ষিণের মৌসুমী বায়ুর কারণে চিঠির কুচিগুলো কিছুক্ষণ হাওয়ায় উড়ল। যে-কোনো উড়ন্ত জিনিসই দেখতে ভালো লাগে। আমার মনে কিছুক্ষণের জন্যে ভালো লাগার বোধ তৈরি হলো। ভালো লাগার বোধ তৈরি হলেই ভালো মানুষদের সঙ্গ পেতে ইচ্ছা! করে। মাজেদা খালার বাড়িতে যাওয়া নিষেধ। যোগাযোগের মাধ্যম টেলিফোন। ঠিক করলাম খালু সাহেব টেলিফোন ধরলেই গলা মোটা করে বলব— আচ্ছা এটা কি মােহাম্মদপুর দমকল বাহিনী? এই মুহূর্তে আমার একটা দমকল দরকার।
টেলিফোন ধরলেন খালা। আমি কিছু বলার আগেই খালা বললেন, হিমু না কি?
আমি বললাম, বুঝলে কী করে, আমি তো এখনো হ্যালো বলি নি।
খালা বললেন, খুব প্রিয় কেউ টেলিফোন করলে বোঝা যায়। টেলিফোনের রিং
অন্যরকম করে বাজে।
খালু সাহেব কেমন আছেন?
ভালো।
কথা বলে যাচ্ছেন তো?
সারাক্ষণই কথা বলছে। বিরক্ত করে মারছে। অনেকদিন কথা বলতে পারে নি, এখন পুষিয়ে নিচ্ছে।
মাথায় চুল উঠেছে?
উঠেছিল। নাপিত ডাকিয়ে আবার পুরো মাথা কামিয়েছে।
কেন?
জানি না কেন। তবে সে সুখে আছে।
খালা আনন্দের হাসি হাসলেন। আমি বললাম, অসুখ সেরে যাওয়ায় খালু সাহেব নিশ্চয়ই খুশি।
খুশি তো বটেই। তোর উপর কেন জানি খুবই নারাজ। আমি তোর খালুকে বললাম, বেচারা হিমু এত কষ্ট করে চিকিৎসা করিয়ে তোমাকে ভালো করেছে। তুমি কেন তার উপর নারাজ?
তার উত্তরে খালু সাহেব কী বলেছেন?
সে চিৎকার করে বলেছে–শাটতাপ। তোর নামই সে শুনতে পারে না। নাম শুনলেই চিৎকার চোঁচামেচি করে। আচ্ছা হিমু, ঐ মহিলা পীর কী চিকিৎসা করেছিলেন বল তো?
শুনে কী করবে? বাদ দাও। চিকিৎসায় ফল হয়েছে–এটাই আসল কথা।
অবশ্যই।
মনে করা যাক চিকিৎসা হিসেবে সে গু খাইয়ে দিয়েছে। তখন ধরতে হবে গু হলো কোরামিন ইনজেকশন। ঠিক না খালা?
অবশ্যই ঠিক।
খালা, কথা শেষ, টেলিফোন রাখি।
খালা টেলিফোনে চেঁচিয়ে উঠলেন, না না খবরদার। আমি আসল কথা বলতে ভুলে গেছি। আমার কী হয়েছে কে জানে, দুনিয়ার কথা টেলিফোনে বলি, আসল কথা বলতে ভুলে যাই।
আসল কথাটা তাড়াতাড়ি বলো। নয়তো আবার ভুলে যাবে।
আসমা তোকে খুঁজছে। পাগলের মতো খুঁজছে।
উনি যখন খোঁজেন পাগলের মতো খোঁজেন। এটা নতুন কিছু না।
এইবার সত্যি সত্যি পাগলের মতো খুঁজছে। আমার মনে হয় ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেছে।
আমি সূর্যাস্ত দেখছি
আমার বিছানার পাশে কে যেন বসে আছে। সূর্যের আলো ভালোমতো ফোটে নি। যে বসে আছে তাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। তারপরেও চেনা চেনা লাগছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই লোকটাকে চিনে ফেলব। আমি তাকিয়ে আছি। হঠাৎ মনে হলো এত কষ্ট করে চেনার কি কোনো প্রয়োজন আছে? শীত শীত লাগছে। গায়ের উপর পাতলা চাদর থাকায় আরামদায়ক ওম। চেনাচেনি বাদ দিয়ে আরো খানিকক্ষণ ঘুমানো যেতে পারে। বিছানার পাশে যে বসে আছে বসে থাকুক। ঘুম ভাঙার পর দিনের প্রথম আলোয় তার সঙ্গে পরিচয় হবে। দিনের প্রথম আলোয় বিভ্ৰম থাকে না। পরিচয়ের জন্যে বিভ্রমহীন আলোর কোনো বিকল্প নেই।
আমি চাদরটা মাথা পর্যন্ত টেনে দিলাম। আমার মাথার ভেতর জটিল গবেষণামূলক আলোচনা আসি আসি করছে। তাকে প্রশ্ৰয় না দিয়ে আরাম করে কিছুক্ষণ ঘুমানো দরকার। পৃথিবীতে সবচে সুখী মানুষ কে? যার কাছে ঘুম আনন্দময় সে-ই পৃথিবীর সবচে সুখী মানুষ। কথাটা কে বলেছেন? বিখ্যাত কেউ নিশ্চয়ই বলেছেন। সাধারণ মানুষ যত ভালো কথাই বলুক কেউ তা বিবেচনার ভেতরও আনবে না। কথাটা বলতে হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজনকে।
পৃথিবীর সবচে সুখী মানুষের মতো আমি ঘুমালাম। ঘুম ভাঙার পরেও বিছানায় উঠে বসলাম না। ছোটবেলার মতো চোখ বন্ধ করে মটকা মেরে পড়ে রইলাম। আমার বিছানার পাশে বসে থাকা লোকটা এখনো আছে। তাকে এখনো চিনতে পারছি না। তবে চিনে ফেলব। সমস্যা হচ্ছে তাকে চিনতে ইচ্ছা! হচ্ছে না।
হিমু সাহেব!
জি।
মনে হচ্ছে আপনার ঘুম ভেঙেছে। আমি ফ্লাস্ক ভর্তি চা নিয়ে এসেছি। মুখ না ধুয়ে চা খাওয়ার অভ্যাস কি আপনার আছে?
আছে।
এক কাপ চা কি দেব?
দিতে পারেন।
আমাকে কি আপনি চিনতে পেরেছেন?
না।
আপনাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমি নিজেই আমাকে চিনতে পারছি না। আয়নার দিকে তাকিয়ে আতকে উঠে ভেবেছি–এ কে? গত রাতে আমি গোঁফ ফেলে দিয়েছি। এতেই চেহারাটা অনেকখানি পাল্টে গেছে। তার উপর গায়ে দিয়েছি কটকট হলুদ পাঞ্জাবি। কড়া হলুদ রঙ যে আইডেনটিটি ক্রাইসিস তৈরি করতে পারে তা জানতাম না।
ভদ্রলোক শরীর দুলিয়ে ঘর কাঁপিয়ে হাসলেন। হাসি থামার পরেও আমার খাট দুলতে লাগল।
আমি চোখ মেলে। ভদ্রলোককে দেখলাম। বিছানায় উঠে বসলাম। ভদ্রলোক আমার দিকে গরম চা ভর্তি মগ ধরিয়ে দিলেন। আমি বললাম, আপনি কে?
ভদ্রলোক বললেন, আমি আপনার আসমা ম্যাডামের হাজবেন্ড। নাম ফজলুল আলম।
আপনি এখানে কেন?
আমি ঠিক করেছি আজ। সারাদিন আমি আপনার সঙ্গে থাকব। এই উপলক্ষে একটা হলুদ পাঞ্জাবি বানিয়েছি। আমি এসেছিও খালি পায়ে।
আমি কিছু বললাম না। চায়ে চুমুক দিলাম। ভদ্রলোক বললেন, চাটা কি ভালো হয়েছে?
হ্যাঁ।
আমি কি আজ সারাদিন আপনার সঙ্গে থাকতে পারি?
থাকতে চাচ্ছেন কেন?
আপনি সারাদিনে কী কী করেন সেটা দেখার ইচ্ছা।
আমি সারাদিনে কিছুই করি না।
আমি এই কিছুই করি না-টাই দেখব। ভালো কথা, আমি ইমরুল ছেলেটির মায়ের চিকিৎসার সব ব্যবস্থা করেছি। এই মহিলাকে তার স্বামী এবং সন্তানসহ দেশের বাইরে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেছি।