এই ঘুম চেয়েছিল বুঝি!
রক্তফেনা-মাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি
আঁধার যুঁজির বুকে ঘুমায় এবার;
কোনোদিন জাগিবে না আর।
ফরিদা টানা দুঘণ্টা ঘুমুল। সময়টা আন্দাজ করে বলছি। আমার হাতে ঘড়ি নেই। হাসপাতালের এই কেবিনেও ঘড়ি নেই। দুঘণ্টা আমি চুপচাপ বসে রইলাম। ঘুমের মধ্যে মানুষ নড়াচড়া করে। এপোশ ওপাশ করে। চোখের পাতা কখনো দ্রুত কাঁপে কখনো অল্প কাঁপে। ফরিদার বেলায় সে-রকম কিছুই হলো না। তার নিঃশ্বাসের শব্দ হলো না। চোখের পাতাও কাঁপল না। এক সময় জেগে উঠে বিড়বিড় করে বলল, পানি খাব।
আমি পানি খাওয়ালাম। তার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললাম, ঘুম ভালো হয়েছে
ফরিদা বলল, হ্যাঁ।
ঘুমের মধ্যে কোনো স্বপ্ন দেখেছ?
না। আমি কতক্ষণ। ঘুমিয়েছি?
দুঘণ্টার মতো।
ছিঃ ছিঃ— আপনি দুঘণ্টা বসেছিলেন! আমার খুবই লজ্জা লাগছে। চলে গেলেন না কেন?
তুমি বসে থাকতে বলেছ।
থ্যাংক য়্যু। আমি যে এতক্ষণ। ঘুমিয়েছি নিজেই বুঝতে পারি নি। আমার কাছে মনে হচ্ছিল–চোখ বন্ধ করেই জেগে উঠেছি। মৃত্যু কাছাকাছি চলে এলে সময়ের হিসেবে গণ্ডগোল হয়ে যায়। আমার বোধহয়….
ফরিদা কথা শেষ না করে হাসল। আমি বললাম, তুমি আমাকে কিছু গোপন কথা বলার জন্যে বসিয়ে রেখেছিলো। আমার ধারণা কথাগুলি তুমি এখন বলতে চাও না।
আপনার ধারণা ঠিকই আছে।
আমি কি এখন চলে যাব?
হ্যাঁ, চলে যান।
অনেকক্ষণ তোমার সঙ্গে ছিলাম, তুমি কিন্তু একবারও জানতে চাও নি। ইমরুল
কেমন আছে।
ফরিদা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ইমরুল কেমন আছে?
আমি বললাম, ভালো।
ফরিদা বলল, আপনার সঙ্গে আমার আর মনে হয় দেখা হবে না।
আমি বললাম, আমারও মনে হয় দেখা হবে না।
ফরিদা বলল, আপনাকে নিয়ে আমি খুবই হাসির একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম। স্বপ্নের কথা এখন আর আপনাকে বলতে ইচ্ছা করছে না। তবে আমি একটা কাজ করব।— লিখে ফেলব। তারপর লেখাটা আপনাকে পাঠাব। হিমুভাই, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে। আমি চেষ্টা করলে গল্প-উপন্যাস লিখতে পারব। বিছানায় শুয়ে মজার মজার সব
গল্প আমার মাথায় আসে।
লিখে ফেললেই পোর।
লজা লাগে বলে লিখতে পারি না।
লজা লাগে কেন?
বুঝতে পারছি না কেন। আচ্ছা ঠিক আছে, লজ্জা লাগুক বাঁ না লাগুক আমি একটা গল্প লিখে ফেলব।
বিস্ময়কর ঘটনা শেষপর্যন্ত ঘটেছে
বিস্ময়কর ঘটনা শেষপর্যন্ত ঘটেছে। খালু সাহেবকে নিয়ে আমি মহিলা পীরের উদ্দেশে রওনা হয়েছি। মাজেদা খালা সঙ্গে যেতে চেয়েছিলেন। খালু সাহেব তাঁর দিকে তাকিয়ে ধমক দিলেন। ধমক দিলেন বাক্যটা ঠিক হলো না। তিনি ধমক দেয়ার মতো মুখে বিকট ভঙ্গি করলেন, মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হলো না। এতেই মাজেদা খালা ঘাবড়ে গেলেন। আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, ঝামেলা তুই নিয়ে যা।
যাত্রাপথ দীর্ঘ। প্রথমে আমরা খালু সাহেবের গাড়িতে করে বাদামতলী ঘাট পর্যন্ত গেলাম। সেখান থেকে বুড়িগঙ্গা পার হবার জন্যে নৌকা নিলাম। নৌকায় উঠে তিনি আমার দিকে সুচ-চোখে তাকিয়ে রইলেন। যে চোখের সৃষ্টি সুচের মতো বিধে সেটাই সুচ-চোখ। তিনি তাঁর চোখ দিয়ে আমার শরীরের নানান জায়গায় ফুটা করতে লাগলেন। এক পর্যায়ে পকেট থেকে ডায়েরি বের করে লিখলেন—আর কত দূর? আমি কিছু বললাম না; মধুর ভঙ্গিতে হাসলাম। মধুর ভঙ্গির হাসি সব সময় সুখকর নয়। খালু সাহেবকে দেখে সেটা বোঝা যাচ্ছে। যতবারই হাসছি ততবারই উনি চিড়বিড়য়ে উঠছেন। নৌকায় আছেন বলে উল্টে দিকে হাঁটা দিতে পারছেন না। তার মনের যে অবস্থা এতে তিনি যে আমাকে ফেলে হাঁটা দিতেন এটা প্ৰায় নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে। বুড়িগঙ্গার মাঝামাঝি এসে তিনি ডায়েরি বের করে লিখলেন—আমি কোথাও যাব না। নৌকা ঘুরাতে বলো। আমি আবারো আগের মতো হাসলাম। তবে এই হাসির প্যাটার্ন একটু অন্যরকম। দুষ্ট শিশুর অন্যায় আবদার শুনে মুরুব্বিারা যে হাসি হাসেন আমি হাসলাম সেই হাসি। খালু সাহেব চিড়বিড়িয়ে উঠলেন।
নৌকা থেকে নেমে আমরা একটা টেম্পো নিলাম। টেম্পো থেকে নেমে গরুর গাড়ি। দিনের আলো তখনো আছে। তবে দ্রুত কমে আসছে। খালু সাহেব অস্থির হয়ে উঠলেন। তাঁর ভাবভঙ্গি এরকম যে যে-কোনো মুহূর্তে তিনি গরুর গাড়ি থেকে নেমে পড়বেন। তিনি আবারো পকেট থেকে ডায়েরি বের করে লিখলেন—আর কতদূর? আমি আগের চেয়েও মধুর ভঙ্গিতে হাসলাম। মধুরতম হাসি খালু সাহেবের গায়ে মনে হলো পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে ধরিয়ে দিল।
আমি বললাম, খালু সাহেব এত অস্থির হচ্ছেন কেন? দৃশ্য দেখুন। কী সুন্দর দৃশ্য! বাংলার গ্রাম। পল্লীবধু কলসি কাখে নদীতে পানি আনতে যাচ্ছে। গরু অলস ভঙ্গিতে শুয়ে শুয়ে জােবর কাটছে। আকাশে দিনের শেষের কন্যা সুন্দর আলো ঝলমল করছে। ঐ কবিতাটা কি আপনার মনে আছে খালু সাহেব? তুমি যাবে ভাই–যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গায়?
খালু সাহেব ঘোৎ করে এমন এক শব্দ করলেন যে গরুর গাড়ির গারোয়ান চমকে উঠে বলল, উনার ঘটনা কী?
ঘটনা ব্যাখ্যা করলাম না, তবে আমি চুপ করে গেলাম। খালু সাহেবকে আর ঘটানো ঠিক হবে না। যে-কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটে যাবে।
আমরা গরুর গাড়ি থেকে নোমলাম সন্ধ্যা মিলাবার পর। এখন হাটপথ। ক্ষেতের আল বেয়ে হাঁটা। খালু সাহেবের ইটালিয়ান জুতা কান্দাপানিতে মাখামাখি হয়ে গেল। তার চেয়েও ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটল বিল পার হওয়ার সময়। খালু সাহেবের বাঁ পা হাঁটু পর্যন্ত কাদায় ডেবে গেল। পা সহজেই টেনে তোলা গেল। কিন্তু সেই পায়ের জুতা কাদার ভেতর থেকে গেল। আমি শান্ত গলায় খালু সাহেবকে বললাম, এক পায়ের জুতা কি থাকবে? না-কি এটা ফেলে আমার মতো খালি পায়ে যাবেন? খালু সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে কিছু নিশ্চয়ই বললেন। ভাগ্যিস তার জবান বন্ধ— কী বললেন শুনতে পেলাম না। শুনতে পেলে অবশ্যই ভালো লাগত না।