বলিস কী! আসিমার স্বামী বিগড়ে গেল কেন? আসমা তো আমাকে কিছু বলে নি।
এখন আমি কী করব বলো।
আসমা ইমরুলকে দেখতে চাচ্ছে। তুই আসমার কাছে ওকে দিয়ে কেটে পড়।
ঠিক আছে তাই করছি। তুমি খালু সাহেবের ব্যাপারে কী করলে?
ভিসা নিয়ে কী যেন ঝামেলা হচ্ছে। ভিসা পেলেই চলে যাবে।
জবান এখনো বন্ধ?
হ্যাঁ।
মহিলা পীরের চিকিৎসাটা করাবে না?
মহিলা পীরের কোন চিকিৎসা?
বলেছিলাম না তোমাকে–প্ৰচণ্ড আধ্যাত্মিক ক্ষমতা সঞ্চয় করা পীরনি। সবাই যাকে মামা ডাকে। উনার পায়ে পড়লেই…।
ভুলে যা। তোর খালু যাবে মামা ডাকতে!
খালু সাহেবের তো জবানই বন্ধ। আমি উনার হয়ে মামা ডাকব। উনার হাসবেন্ডকে ডাকব মামি।
তার হাসবেন্ডকে মামি ডাকতে হয়?
মহিলাকে যখন মামা ডাকতে হয়। পুরুষকে মামি ডাকতে হবে সেটাই তো স্বাভাবিক।
খামাকা বকবক করবি না। সকালবেলা বকবকানি শুনতে ভালো লাগে না।
টেলিফোন রেখে দেব?
না, রেখে দিবি না। কানে বুলিয়ে বসে থাক। গাধা কোথাকার। টেলিফোন রেখে এক্ষুণি ঐ ছেলেকে আসমার কাছে পৌঁছে দিয়ে আমার এইখানে আয়।
আচ্ছা, আসব।
আমার বাড়িতে এখন নতুন নিয়ম— বাসায় ঢুকে কোনো কথা বলতে পারবি না। ফিসফিস করেও না।
কেন?
তোর খালু কথা বলতে পারে না তো, এই জন্যে কাউকে কথা বলতে শুনলে রেগে যায়। ভয়ঙ্কর রাগে। এই জন্যেই বাড়িতে কথা বলা বন্ধ।
ভালো যন্ত্রণা তো!
মহা যন্ত্রণা। এই যে তোর সঙ্গে কথা বলছি, কর্ডলেস নিয়ে বারান্দায় চলে এসেছি। কথাও বলছি ফিসফিস করে। বুঝলি হিমু— মাসখানিক এই অবস্থা চললে দেখবি আমিও কথা বলা ভুলে গেছি। ইশারা-ইঙ্গিতে কাজ করছি। খুবই খারাপ অবস্থায় আছি রে হিমু!
এই বিষয় নিয়ে তুমি চিন্তা করবে না। আমি ভুজুং ভাজুং দিয়ে খালু সাহেবকে চিকিৎসা করিয়ে আনিব। মামা-চিকিৎসা।
তুই কখন আসবি?
দুএকদিনের মধ্যে চলে আসব।
দুএকদিন না, এক্ষুণি আয়।
দেখি।
কোনো দেখাদেখি না। লাফ দিয়ে কোনো বেবিটেক্সিতে উঠে পড়।
আমি খালার কথামতোই কাজ করলাম। ইমরুলকে মিসেস আসমা হকের দরবারে পৌঁছে দিয়ে লাফ দিয়ে একটা বেবিটেক্সিতে উঠে পড়লাম। তবে আমার গন্তব্য খালু সাহেবের বাড়ি না— হাসপাতাল। ফরিদা কী করছে না করছে এই খোঁজ নেয়া। হাসপাতালে কী ড্রামা হচ্ছে কে জানে! থানা এবং হাসপাতালে মানব জীবনের সবচে বড় ড্রামাগুলি হয়। দর্শক হিসেবে অসাধারণ নাটক দেখতে হলে এই দুজায়গায় হঠাৎ হঠাৎ উপস্থিত হতে হয়। চমৎকার কিছু দৃশ্য হলো, মনে মনে হাততালি দিয়ে ফিরে চলে আসা। আবার নাটক দেখতে ইচ্ছা হলে আবার চলে যাওয়া। আমার (মহানা) বাবা তাঁর মহাপুরুষ বানানোর শিক্ষা প্ৰণালিতে পরিষ্কার করে লিখেছেন–
মৃত্যুপোঠযাত্রী কখনো দেখিয়াছ? কখনো কি তাহার শয্যাপার্শ্বে রাত্রি জাপন করিয়াছ? কখনো কি দেখিয়াছ কী রূপে ছটফট করিতে করিতে জীবনের ইতি হয়। জীবনের প্রতি মানুষের কী বিপুল তৃষ্ণা। আর কিছুই চাই না— শুধু বঁচিবার জন্যেই বাঁচিতে চাই।
বাবা হিমালয়, তুমি অবশ্যই তোমার জীবনের কিছু সময় মৃত্যুপথযাত্রীদের জন্যে আলাদা করিয়া রাখিবে। তাহাদের শয্যাপার্শ্বে রাত্রি যাপন করিবে। যে হাহাকার নিয়া তাহারা যাত্ৰা করিতেছে সেই হাহাকার অনুভব করার চেষ্টা করিবে।
বাবা সামান্য ভুল করেছেন। তিনি ভুলে গেছেন সব মানুষই মৃত্যুপথযাত্রী। যে শিশুটি হেসে খেলে ছুটে বেড়াচ্ছে সেও মৃত্যুপথযাত্রী। তার চোখের দিকে তাকালেও জীবনের প্রতি মানুষের বিপুল তৃষ্ণার খবর পাওয়া যায়। এই খবর জানার জন্যে হাসপাতালে বসে থাকার প্রয়োজন নেই।
ফরিদার বিছানার পাশে সোনালি চশমা পরা যে যুবকটি বসে আছে তার নামই বোধহয় রাশেদুল করিম। সাদা ফুলপ্যান্টের সঙ্গে আকাশি নীল রঙের হাওয়াই শার্ট পরেছে বলেই পোশাকটা ইউনিফর্মের মতো লাগছে। মনে হচ্ছে ক্যাডেট কলেজের ছাত্র। শুধু চেহারা দেখে প্রেমে পড়ার বিধান থাকলে সব মেয়েই এই ছেলের প্রেমে পড়ত। তারা দুজন মনে হয় মজার কোনো কথা বলছিল। দুজনের মুখই হাসি হাসি। আমাকে দেখে রাশেদুল করিমের মুখের হাসি বন্ধ হয়ে গেল। ফরিদা কিন্তু হাসতেই থাকল। মেয়েদের এই ব্যাপারটা আছে। কোনো রসিকতা তাদের মনে ধরে গেলে তারা অনেকক্ষণ ধরে হাসে।
রাশেদুল করিম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। দীর্ঘদিনের পরিচিত মানুষের মতো বললেন, হিমুভাই, কেমন আছেন? বলেই হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়ালেন।
আমি এখন মজার একটা খেলা খেলতে পারি। রাশেদুল করিমের হাত অগ্রাহ্য করে তাকে খুবই বিব্রত অবস্থায় ফেলতে পারি। বিব্রত অবস্থায় সে কী করে এটাই তার আসল চরিত্র।
আমি রাশেদুল করিমের দিকে তাকালাম। তাঁর বাড়িয়ে দেয়া হাতের দিকে তাকলাম। নিজে হাত বাড়ালাম না। ভদ্রলোক হাত নামিয়ে নিলেন এবং হেসে ফেললেন। আবারো বললেন, হিমুভাই, কেমন আছেন?
ভালো।
আপনার কথা এত শুনেছি যে আপনাকে না দেখে যদি আপনার ছায়া দেখতাম তাহলেও বলে ফেলতে পারতাম— এই ছায়া হিমু সাহেবের।
ছায়া দেখে চিনতে পারতেন না। সব মানুষ আলাদা কিন্তু তাদের ছায়া একরকম।
এটা কি কোনো ফিলসফির কথা?
অতি জটিল ফিলসফির কথা। অবসর সময়ে এই ফিলসফি নিয়ে চিন্তা করবেন। কিছু না কিছু পেয়ে যাবেন।
ফরিদার মাথায় এখনো বোধহয় রসিকতাটা ঘুরপাক খাচ্ছে। সে হেসেই যাচ্ছে। আমি তার দিকে তাকাতেই সে মুখে শাড়ির আঁচল চাপা দিয়ে হাসি সামলাবার চেষ্টা করল। রোগ যন্ত্রণায় কাতর রোগীর আনন্দময় হাসির চেয়ে সুন্দর আর কিছুই হতে পারে না। আমি মুগ্ধ হয়ে হাসি দেখছি। রাশেদুল করিম বললেন, হিমুভাই, আপনি কি দয়া করে ফরিদকে একটু বুঝবেন? আমি নিশ্চিত সে আপনার কথা শুনবে।