আমি বললাম, কেমন আছেন?
হাবিবুর রহমান চমকে উঠলেন। তার ভাব দেখে মনে হবে। আশেপাশে কোথাও ককটেল ফুটেছে। তিনি বললেন, কিছু বলেছেন?
আমি বললাম, চমকে উঠার মতো কিছু বলি নি। জানতে চাচ্ছিলাম কেমন আছেন?
ভালো।
আপনার কি শরীর খারাপ না-কি?
জানি না।
কোনো কারণে কি মন অশান্ত?
জি-না, আমি ভালো আছি।
বলেই তিনি পুরোপুরি ঝিম মেরে গেলেন। এতক্ষণ তিনি চাঃেখের দৃষ্টি স্থির করতে পারছিলেন না। এখন তাঁর দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। তাঁকে এখন দেখাচ্ছে ধ্যানমগ্ন মানুষের মতো। আমি বললাম, রাশিদুল করিম নামের হারামজাদাটার সঙ্গে দেখা হয়েছিল?
হাবিবুর রহমান হতভম্ব গলায় বললেন, কীভাবে বুঝলেন?
আপনি থ মেরে গেছেন। সেখান থেকে অনুমান করছি। দুয়ে দুয়ে চার মেলাচ্ছি।
হাবিবুর রহমান বললেন, কুত্তাটার সাহস দেখে অবাক হয়েছি। বাসায় চলে এসেছে। আমার সঙ্গে দেখা করার জন্যে। সুটি টাই মচমচা জুতা। সেন্ট মেখেছে। গা দিয়ে। ভুরিভুর করে গন্ধ বের হচ্ছিল। পাছায় লাথি দিয়ে বের করে দিতে চেয়েছিলাম।
দিলেন না কেন?
এখন তাই চিন্তা করছি। কেন দিলাম না! মানুষ কুকুরের গায়ে গরম মাড় ঢেলে দেয়। আমার উচিত ছিল কুকুরটার গায়ে গরম মাড় ঢেলে দেয়া। আফসোস হচ্ছে কেন মাড় ঢেলে দিলাম না!
ঘরে বোধহয় মাড় ছিল না।
হাবিবুর রহমান অবাক হয়ে বললেন, ঠাট্টা করছেন? আমার এই অবস্থায় আপনি ঠাট্টা করতে পারছেন। আপনি এতটা হাটলেস?
আমি বললাম, আপনার কাছে এসেছিল কী জন্যে? সে কী চায়?
হাবিবুর রহমান থমথমে গলায় বললেন, মহৎ সাজতে চায়। ফরিদার চিকিৎসার যাবতীয় খরচ দিতে চায়। শুয়োরটার সাহস কতা! বলে কী প্রয়োজনে সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক নিয়ে যাব। আরে কুত্তা, তোর সিঙ্গাপুর-ব্যাংকককে আমি পেসাব করে দেই।
বলেছেন এই কথা?
না। বলা উচিত ছিল। যা যা করা উচিত ছিল তার কিছুই আমি করি নি। এখন রাগে আমার ইচ্ছা করছে নিজের হাত নিজে কামড়াই। গতকাল রাতে আমি এক ফোঁটা ঘুমোতে পারি নাই। দুটা ফ্রিজিয়াম খেয়েছি, তারপরেও ঘুম আসে না। হিমু ভাই, আপনি শুনলে বিশ্বাস করবেন না। আমি উল্টা ঐ কুত্তাটার সঙ্গে হাসি মুখে কথা বলেছি।
চা বানিয়েও তো খাইয়েছেন।
আপনাকে কে বলল?
আমি অনুমান করছি।
হ্যাঁ, কুত্তাটাকে চা বানিয়ে খাইয়েছি। কুত্তাটা আমার সামনে বসে চুকচুক করে চা
খেয়েছে।
শুধু চা? নাকি চানাচুর-টানাচুর কিছু ছিল?
শুধু চা।
চিকিৎসার ব্যাপারে কী বলেছেন?
বলেছি আমি আমার যা সাধ্য করব। কারোর কোনো দান নেব না।
এইটুকুই বলেছেন? আর কিছু বলেন নি?
না, এইটুকুই বলেছি। তবে শক্তভাবে বলেছি। আমার বলার মধ্যে কোনো ধানাইপানাই ছিল না। ভালো বলছি না?
অবশ্যই ভালো বলেছেন। তবে এই সঙ্গে আরো দুএকটা কথা যুক্ত করে দিলে আরো বালো হতো।
কী কথা?
আপনার বলা উচিত ছিল–এই কুত্তা, তুই খবরদার আমার স্ত্রীকে দেখতে যাবি না। আমার স্ত্রী তোর লাইলী না। আর তুইও মজনু না। তোকে যদি হাসপাতালের ত্ৰিসীমানায় দেখি তোর ঠ্যাং ভেঙে দেব। টান দিয়ে তোর বাঁকা ল্যাজ সোজা করে দেব। বাকি জীবন সোজা লেজ নিয়ে হাটবি। কুকুর সমাজে আর মুখ দেখাতে পারবি না।
হাবিবুর রহমান আহত গলায় বললেন, হিমু ভাই, আপনি তো হৃদয়হীন একজন মানুষ। আমার এমন অবস্থায় আপনি আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছেন?
ঠাট্টা করছি কেন বলছেন?
অবশ্যই ঠাট্টা করছেন। আপনি বলছেন টেনে লেজ সোজা করে দেবেন। সোজা লেজ নিয়ে সে কুকুর সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না। এগুলো ঠাট্টার কথা না? আপনি আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছেন না। বুঝতে পারলে রসিকতা করতেন না।
মনের অবস্থা কি খুবই খারাপ?
আমি চার পাতা ফ্রিজিয়াম কিনেছি। এক এক পাতায় আটটা করে মোট বত্ৰিশটা ফ্রিজিয়াম। কাল রাতে ভেবেছিলাম। সবগুলো খাব।
খেলেন না কেন?
ইমরুল আমার সঙ্গে থাকে। সে ভোরবেলা জেগে উঠে দেখবে একটা মারা মানুষকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। প্ৰচণ্ড ভয় পাবে এই জন্যে খাই নি।
আমি সহজ ভঙ্গিতে বললাম, আজ রাতে যদি এ ধরনের পরিকল্পনা থাকে তাহলে আমি বরং ইমরুলকে নিয়ে যাই।
হাবিবুর রহমান জবাব দিলেন না। মানসিক রোগীদের মতো অস্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন। আমি বললাম, ইমরুলকে নিয়ে যােব কি-না বলুন। বত্ৰিশটা ট্যাবলেটের ভেতরে দুটা মাত্র খেয়েছেন। আরো ত্ৰিশটা আছে। এই ত্ৰিশটায় কাজ হয়ে যাবার কথা।
আপনি আমাকে ঘুমের ওষুধ খেতে বলছেন?
হুঁ।
কেন বলছেন? যাতে আমার মৃত্যুর পর ঐ কুত্তাটা ফরিদাকে বিয়ে করে সুখে ঘর-সংসার করতে পারে।
সেই সম্ভাবনা যে একেবারেই নেই তা-না। আপনার তো আপনার স্ত্রীর জন্যে কোনো প্ৰেম নেই। ঐ ভদ্রলোকের আছে। সবাই চায় প্রেমের জয় হোক।
আমার স্ত্রীর প্রতি আমার কোনো প্ৰেম নেই?
না।
কী করে বুঝলেন? আমার কপালে লেখা আছে?
কপালে লেখা থাকে না। প্ৰেম আছে কি নেই তা লেখা থাকে চোখে। আপনার দুটা চোখেই লেখা–প্ৰেম নেই।
আপনি কি চোখের ডাক্তার?
চোখের ডাক্তার চোখের লেখা পড়তে পারে না।
হাবিবুর রহমান ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, আপনি মহা তালেবার। আপনি চোখের লেখা পড়তে শিখে গেছেন?
তা শিখেছি। অবশ্যি চোখের লেখা যে পড়তে পারে না তার পক্ষেও বলা সম্ভব যে আপনার মধ্যে আপনার স্ত্রীর প্রতি কোনো প্ৰেম নেই।
তাই?
জি। প্ৰেম থাকলে আপনার একমাত্ৰ চিন্তা থাকত আপনার স্ত্রীর জীবন রক্ষা করা। তার চিকিৎসার টাকা কে দিল সেটা হতো তুচ্ছ ব্যাপার। রশীদ সাহেবের টাকা নিতে আপনার অহঙ্কারে বাঁধছে। প্রেমিকের কোনো অহঙ্কার থাকে না।