আমার আসল রাগ তো তুমি দেখ নি। আমাদের স্কুলের অঙ্ক টিচার মিস রিনা দাসকে পর্যন্ত একদিন ধমক দিয়েছিলাম। এমন সমস্যা হয়েছিল স্কুল থেকে আমাকে প্ৰায় টিসি দিয়ে দেয়। টিসি দেয়া কী জানো? টিসি দেয়া মানে বের করে দেয়া। বাথটাব থেকে তোমাকে নামিয়ে দেয়ার মতো। বুঝেছি? যেভাবে মাথা নাড়ছ তাতে মনে হচ্ছে সবই বুঝে ফেলছি।
এত জোরে মাথা নাড়বে না। শেষে মাথা ঘাড় থেকে খুলে পড়ে যাবে। তুমি হয়ে যাবে কন্ধকাটা ভূত। তুমি যে এত ভূতের ছবি আঁক কন্ধকাটা ভূতের ছবি একেছ কখনো? বাথটাব থেকে বের হয়ে আমাকে একটা কন্ধকাটা ভূতের ছবি একে দেখাবে।
শোন ইমরুল, শুধু ভূত প্রেতের ছবি আঁকলে হবে না। এখন থেকে ল্যান্ডস্কেপ আঁকবে। ল্যান্ডস্কেপ হচ্ছে নদী, গাছপালা, সূর্যস্ত–এইসব। বুঝতে পেরেছ? বুঝতে পেরেছ বললেই এইভাবে মাথা নাড় কেন? বললাম না। এইভাবে মাথা নাড়লে ঘাড় থেকে মাথা খুলে পড়ে যাবে। পিপি পেয়েছে। নাকি? খবরদার বাথটাবে পিপি করবে না। দাঁড়াও কমোডে বসাচ্ছি।
এক সময় গোসলপর্ব সমাধা হলো। ম্যাডাম কিছুক্ষণ আমার সঙ্গে রাগারগি করলেন কারণ আমি দামি জুতা কিনি নি। আমার উচিত ছিল এডিডাস বা নাইকির জুতা কেনা। ম্যাডাম তারপর শার্টে বোতাম লাগালেন। এই ফাঁকে হোটেলের প্যাডে ইমরুল দুটা কন্ধকাটা ভূত একে ফেলল। একটা ছেলে কন্ধকাটা, একটা মেয়ে কন্ধকাটা।
ইমরুলকে নতুন জুতা পরিয়ে নিয়ে আসব তখন একটা ছোট্ট সমস্যা হলো। ইমরুল মুখ শক্ত করে বলল, আমি যাব না।
আমি রাগী গলায় বললাম, যাবে না। মানে কী?
ইমরুল বলল, আমি আসমার সঙ্গে থাকব।
আমি ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে বললাম, ফাজিল ছেলের কাণ্ড দেখেছেন! চড় দিয়ে দুতিনটা দাঁত তো এক্ষুণি ফেলে দেয়া দরকার। আপনাকে নাম ধরে ডাকছে। কষে একটা চড় দিন তো। দাঁত নরম আছে। কষে চড় দিলে দাঁত পড়ে যাবার কথা।
ম্যাডাম বললেন, চড় দেবার মতো সে কিছু করে নি। শুধু শুধু চড় দেব কেন? আপনাকে আমি নাম ধরে ডাকতে বলেছিলাম। সেখান থেকে শিখেছে। ছেলেটার পিকআপ করার ক্ষমতা অসাধারণ। আমি ইমরুলকে বললাম, দুষ্টছেলে, আবার যদি উনাকে আসমা ডেকেছ তাহলে তোমার খবর আছে। এখন থেকে উনাকে ডাকবে ন-মা।
আসমা বললেন, ন-মা-টা কী?
ন-মা হলো নকল মা। বাইরের যারা শুনবে তাদের কাছে মনে হবে না-মা হলো নতুন মা।
আপনার কথাবার্তা খুবই কনফিউজিং। আমি নকল মা কেন হব? আমি এই ছেলেকে নিয়ে যাব। আমি হব তার আসল মা। আমি সারা পৃথিবীকে দেখিয়ে দেব। পেটে সন্তান না নিয়েও আসল মা হওয়া যায়।
কথা বলতে বলতে আসমার গলা ভারী হয়ে গেল। তিনি প্ৰায় কেঁদে ফেলেন এমন অবস্থা। পরিস্থিতি আরো মলিন করে তুলল। ইমরুল, সে খাটের পায়া ধরে ঝুলে পড়ল। সে কিছুতেই যাবে না। এখানেই থাকবে।
মিসেস আসমা হকের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। তার মতো মানুষ বাইরের একজন মানুষের সামনে এভাবে কাঁদবে এটা ভাবাই যায় না। এই যে তিনি চোখের পানি ফেলছেন তার জন্যে তিনি লজাও পাচ্ছেন না। আমার ধারণা তিনি বুঝতেও পারছেন না যে তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।
আমি বললাম, ম্যাডাম, আপনার জন্যে একটা সুসংবাদ আছে।
তিনি ধরা গলায় বললেন, কী সুসংবাদ?
ইমরুলকে আপনার অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যেতে হবে না। আপনারা অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যাবেন তাকে ছাড়া।
এটা সুসংবাদ হলো?
হ্যাঁ, সুসংবাদ কারণ আপনাকে নামা হতে হবে না। আপনি হবেন–আমা। অর্থাৎ আসল মা। বাইরের একটা শিশুর প্রতি আপনি যে মমতা দেখিয়েছেন তার পুরস্কার হিসেবে আপনার কোলে আসবে আপনার নিজের শিশু। আপনি আমার দিকে এভাবে তাকবেন না। আমি অনেক কিছু আগে ভাগে বুঝতে পারি।
ইমরুল হাত-পা ছুড়ে কাঁদছে। তাকে জোর করে ধরে নিয়ে আসছি। আসমা ঠিক আগের জায়গায় বসে আছেন। তার চোখে এখন কোনো পানি নেই। কিন্তু আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি তার চোখ দিয়ে অশ্রুবন্যা বয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু অশ্রু আছে চোখে দেখা যায় না।
হিমু সাহেব!
জি।
আপনি কি ইমরুলকে নিয়ে যাচ্ছেন?
নিয়ে যাওয়াটাই কি ভালো না? ইমরুলের প্রতি মমতা দেখানোর আপনার আর কোনো প্রয়োজন নেই। নিজের জিনিস আসছে।
দয়া করে আপনি আমাকে মিথ্যা স্বপ্ন দেখাবেন না। কোনটা হবার কোনটা হবার না তা আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না। ইমরুলকে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন নিয়ে যানএকটা ছোট্ট কাজ কি করতে পারবেন। রাত দশটার দিয়ে টেলিফোন করতে পারবেন?
অবশ্যই পারব। কেন বলুন তো?
ইমরুল কান্না থামিয়ে শান্ত হয়েছে কি হয় নি এটা জানার জন্যে।
আমি টেলিফোন করে আপনাকে জানাব।
ভুলে যাবেন না কিন্তু।
আমি ভুলে যাব না।
রাত দশটার দিকে টেলিফোন করার কথা, আমি কাঁটায় কাঁটায় রাত দশটায় টেলিফোন করলাম। একজন পুরুষমানুষ টেলিফোন ধরলেন এবং গঞ্জীর গভীর বললেন–আপনি কি হিমু?
আমি বললাম, জি।
আমার নাম ফজলুল আলম। আমি…
পরিচয় দিতে হবে না। আপনি কে বুঝতে পারছি।
ভদ্রলোক কাঁটা কাঁটা গলায় বললেন, আমি বলছি মন দিয়ে শুনুন। আপনি আর কখনোই আমার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন না। তাঁকে বিরক্ত করবেন না। আপনি মানসিকভাবে তাঁকে পঙ্গু করে ফেলেছেন। ভদ্রলোক খট করে টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন।
হাবিবুর রহমান সাহেবের ব্রেইন
হাবিবুর রহমান সাহেবের ব্রেইন যে একেবারেই কাজ করছে না তা তার চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে। চোখের দৃষ্টি এলোমেলো। তিনি স্থির হয়ে তাকাতে পারছেন না। মানুষের মন যেমন ছটফট করে, চোখও করে। মনের ছটফটানি ধরার কোনো উপায় নেই। চোখেরটা ধরা যায়।