আসমা হক বিরক্ত গলায় বললেন, ছেলেটাকে একটা জুতা পরে বের না করে দোকান থেকে এক জোড়া জুতা কিনে দিতেন।
আমার টাকা-পয়সার কিছু সমস্যা আছে ম্যাডাম।
মিসেস আসমা হক আরো ভুরু কুঁচকে ফেললেন। এই মহিলা মনে হয় ভুরু কুঁচকে তাকাতে পছন্দ করেন। তাঁর কপালে ভুরু কুচকানোর স্থায়ী দাগ পড়ে গেছে।
এর শার্টেরও দেখি বোতাম নেই। বোতাম আছে এমন শার্ট ছিল না? নাকি বাকি শার্টগুলিও কুকুর নিয়ে গেছে?
এইটি ইমরুলের প্রিয় শার্ট। এই শার্ট ছাড়া সে বাইরে বের হয় না।
আমার ধারণা— আপনি মিথ্যা কথা বলছেন। অদ্ভুত একটা পোশাক পরিয়ে ছেলেটাকে নিয়ে এসেছেন। এক ধরনের শো-ডাউন। শো-ডাউন আমার পছন্দ না।
আমি বিনীত গলায় বললাম, ম্যাডাম, আমার সমস্যা হচ্ছে আমি যখন সত্যি কথা বলি তখন সবাই ভাবে মিথ্যা কথা বলছি। আবার যখন মিথ্যা বলি তখন সবাই ভাবে সত্যি বলছি। ইমরুলের পোশাকের ব্যাপারে। আমি একশ ভাগ সত্যি কথা বলছি। আমার কথা বিশ্বাস করলে সুখী হব ম্যাডাম।
আমাকে ম্যাডাম ডাকবেন না।
তাহলে ডাকব কী?
নাম ধরে ডাকবেন। আমার নাম আসমা। তাসমা ডাকবেন।
সর্বনাশ!
সর্বনাশ কেন?
একজন পিএইচডিকে নাম ধরে ডাকব?
পিএইচডিওয়ালাদের কি নাম থাকে না?
কাউকে নাম ধরে ডাকলে তুমি করে বলতে হয়। আপনার সঙ্গে পথেঘাটে দেখা হলে আমাকে বলতে হবে।— আসমা তুমি কেমন আছ? সেটা কি ঠিক হবে?
আপনি দেখি অকারণে খুবই বকবক করতে পারেন। বকবকানি আমি একদম সহ্য করতে পারি না। ইমরুল ছেলেটা তো খুব চুপচাপ। আপনার বকবকানি স্বভাব পায় নি।
ইমরুল খোঁচার অপেক্ষা করছে। খোঁচা খেলেই বিড়বিড় করে কথা শুরু করবে,
তখন আপনার মাথা ধরে যাবে।
খোঁচার অপেক্ষা করছে মানে কী? কী খোঁচা?
কথার খোঁচা।
কিছুই বুঝতে পারছি না।— প্লিজ আপনি স্বাভাবিকভাবে কথা বলুন। কথার খোঁচাটা কী?
আমি কোনো জবাব দেবার আগেই ইমরুল খিলখিল করে হেসে উঠল। আসমা বিস্মিত হয়ে বলল, এই ছেলেটা হাসছে কেন?
আমি বললাম, আপনি ইমরুলকেই জিজ্ঞেস করুন কেন হাসছে। সে কেন হাসছে। এটা তো তারই জানার কথা।
আসমা ইমরুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই ছেলে, তুমি হঠাৎ হেসে উঠলে কেন ?
ইমরুল স্পষ্ট করে বলল, তুমি শুধু হাসির কথা বলে এই জন্যে আমি হাসি।
আসমাকে দেখে মনে হলো সে খুবই অবাক হয়েছে। এত সুন্দর করে গুছিয়ে বাচ্চা একটা ছেলে কথা বলবে এটা হয়তো আসমা ভাবে নি।
আমি হাসির কথা বলি?
হুঁ।
আমার কোন কথাটা হাসির?
সব কথা।
আমার সব কথা হাসিরা এই বিচ্ছ বলে কী? আমি হাসির কথা বলি— আজি পর্যন্ত কেউ আমাকে এ ধরনের কথা বলে নি। বরং বলেছে। আমি না-কি সিরিয়াস টাইপ। আমার মধ্যে কোনো ফানি বোন নেই। আমার সেন্স অব হিউমার নেই।
আমি কিছু বললাম না। লক্ষ করলাম মহিলার ভুরু সরল হয়ে এসেছে। তিনি হঠাৎ আনন্দ পেতে শুরু করেছেন। প্রাণী হিসেবে মানুষ অতি বিচিত্র। সে যখন আনন্দ পেতে শুরু করে তখন সব কিছুতেই আনন্দ পায়। তার সঙ্গে কেউ খারাপ ব্যবহার করলেও আনন্দ পায়।
হিমু সাহেব।
জি।
বোতাম নিয়ে আসুন তো!
কী নিয়ে তাসব?
বোতাম। আমি এই ছেলের শার্টে বোতাম লাগিয়ে দেব। হোটেলে সুই সুতা থাকে। শুধু বোতাম আনলেই হবে। পারবেন না?
পারব।
আর ভিমরুলের জুতাটা খুলে নিয়ে যান। এই মাপে তার জন্যে এক জোড়া জুতা নিয়ে আসবেন। আমি টাকা দিয়ে দেব। পারবেন না?
পারব।
ভিমরুল কি এতক্ষণ আমার সঙ্গে থাকতে পারবে একা একা?
বলেই ভদ্রমহিলা ইমরুলের দিকে তাকাল।
ইমরুল গম্ভীর গলায় বলল, আমার নাম ভিমরুল না। আমার নাম ইমরুল। তুমি আমাকে ভিমরুল ডাকবে না।
সরি সরি! আর ভুল হবে না। ইমরুল তুমি কি একা একা কিছুক্ষণ আমার সঙ্গে থাকতে পারবে?
হুঁ।
তোমার কি ক্ষিধে পেয়েছে? কিছু খাবে?
হুঁ।
দাঁড়াও, তোমার খাবার ব্যবস্থা করছি। তোমার সঙ্গে আমিও খাব। আমারও ক্ষিধে পেয়েছে।
আসমা জুতা কেনার টাকা দেবার সময় গলা নামিয়ে বললেন, এই ছেলেকেই আমার পছন্দ হয়েছে। আমি একেই নেব।
আমি হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, দেরি হয়ে গেছে। দেরি হয়ে গেছে মানে? আপনি ইমরুলকে বাতিল করে দিয়েছিলেন, এই জন্যে আমি আবার অন্য পার্টির সঙ্গে কথা ফাইনাল করেছি। উট পার্টি।
উট পার্টি মানে?
উটের জকি হিসেবে যারা বাচ্চা নিয়ে যায়। পার্টি হিসেবে এরা ভালো। গুড পেমেন্ট। পেমেন্টে কোনো গণ্ডগোল করে না।
আপনাকে পুলিশের কাছে হ্যান্ডওভার করে দেয়া যায়, এটা জানেন? আপনি বিরাট ক্রিমিন্যাল।
তা ঠিক।
আমার কাছে ক্ষমতা থাকলে প্ৰকাশ্য রাজপথে আপনাকে গুলি করে মারতাম। হাসছেন কেন? আমি হাসির কোনো কথা বলছি না। আই মিন ইট। যান, জুতা নিয়ে আসুন।
জুতা দেবেন। কিনা ভেবে দেখুন। ইমরুলকে তো আর আপনারা রাখতে পারছেন না। খামাখা কিছু টাকা খরচ করবেন। দেখা যাবে আপনার দেয়া জুতা পরে সে উটের পিঠে বসল।
জুতা আনতে বলছি আনুন। বোতাম আনতে আবার যেন ভুলে যাবেন না।
নতুন এক জোড়া জুতা (রঙ টকটকে লাল), শার্টের বোতাম (রঙ লাল), দুটা বিশাল বেলুন (রঙ লাল) কিনে হোটেলে ফিরে দেখি বাথটাব ভর্তি পানিতে ইমরুল ঝাঁপাঝাঁপি করছে। ইমরুলের পাশে রাগত মুখে (কপট রাগ) কোমরে হাত দিয়ে আসমা ম্যাডাম দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি একাই কথা বলে যাচ্ছেন–
ইমরুল, দুষ্ট ছেলে, এইসব কী করছ? বাথটাবের পানি খােচ্ছ। ইমরুল, তুমি খুবই দুষ্ট ছেলে। দুষ্ট ছেলে আমি পছন্দ করি না। এরকম করলে আর কিন্তু তোমাকে বাথটাবে নামাব না। আমি খুবই রাগ করছি। আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলে লাভ হবে। না। আমি হাসিতে ভোলার মানুষ না।