ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাজি করতে পোর। কিনা দেখ। এক লাখ ডলার খরচ করে বিদেশে যাবার দরকার কী? যেখানে এক ছটাক গাজায় কাজ হচ্ছে।
অসম্ভব! ওই প্ৰসঙ্গ বাদ দে।
আচ্ছা যাও বাদ দিলাম। তোমাদের ডলার আছে। ডলার খরচ করে চিকিৎসা করে আস।
তুই আসমার সঙ্গে কবে দেখা করবি?
যখন বলবে তখন। ঠিকানা দাও, নাশতা খেয়ে চলে যাই।
মাজেদা খালা অবাক হবার ভঙ্গি করে বললেন–তুই আসমাকে কী ভেবেছিস? সে চুনাপুটি না। অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া সে দেখা করবে না।
বলো কী!
সোনারগাঁও হোটেলে উঠেছে। টেলিফোন নাম্বার নিয়ে যা–অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে। তারপর যাবি। এক কাজ করি— আমি টেলিফোনে ধরে দেই,–তুই কথা বল।
বাংলায় কথা বলা যাবে? আমার তো আবার ইংরেজি আসে না।
রসিকতা করিস না হিমু। সব সময় রসিকতা ভালো লাগে না।
খালা টেলিফোন করতে গেলেন। এই ফাঁকে খালু সাহেব একবার খাবার ঘরে উঁকি দিলেন। আমার দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে (বর্শা যেভাবে নিক্ষেপ করা হয় সেইভাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ) আবার নিজের ঘরে ঢুকে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
মিসেস আসমা হক পিএইচডিকে টেলিফোনে পাওয়া গেল। তিনি বরফশীতল গলায় বললেন, হিমু সাহেব বলছেন?
আমি অতি বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, ইয়েস ম্যাডাম।
আপনি আজ বিকেল পাঁচটায় হোটেলে আসুন।
ইয়েস ম্যাডাম।
ঠিক পাঁচটায় আসবেন, তার আগেও না, পরেও না।
ইয়েস ম্যাডাম।
আপনার খালার কাছ থেকে আপনার সম্পর্কে যে-সব তথ্য পেয়েছি তারপর আর আপনার উপর ভরসা করা যায় না। তারপরও আসুন।
ইয়েস ম্যাডাম।
কখন আসবেন বলুন তো?
বিকেলে।
বিকাল সময়টা দীর্ঘ। তিনটা থেকে বিকাল শুরু হয়, সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত থাকে। আপনাকে আসতে হবে। পাঁচটায়।
ইয়েস ম্যাডাম।
ইমরুল ছেলেটার বিষয়ে আমরা ফাইনাল ডিসিশান নিয়ে নিয়েছি। ওকে আমরা নেব না। কাজেই আপনাকে অন্য কিছু ভাবতে হবে। আমি এখন টেলিফোন রেখে দিচ্ছি। দীর্ঘ সময় ধরে টেলিফোনে বকবক করতে আমাব ভালো লাগে না।
ম্যাডাম, একটা ছোট্ট কথা ছিল।
আবার কী কথা?
আপনার কুশল জিজ্ঞেস করা হয় নি। শরীরটা কেমন আছে?
তার মানে?
নোংরা আবহাওয়া, জীবাণুমাখা খাবার খেয়ে অসুখে পড়ে। আপনাদের সে-রকম কিছু হলো কি-না।
আপনি খুবই আপত্তিকর কথা বলছেন তা কি জানেন?
জি-না। জানি না।
আপনি আমাকে নিয়ে রসিকতা করার চেষ্টা করছেন। দয়া করে এই কাজটা করবেন না। মনে থাকবে?
ভদ্রমহিলা খট করে টেলিফোন রেখে দিলেন। আমাকে শেষবারের মতো ইয়েস ম্যাডাম বলার সুযোগ দিলেন না।
ইমরুলের সাজসজ্জা
ইমরুলের সাজসজ্জা আজ চমৎকার।
টকটকে লাল শার্ট। শার্টের চারটা বোতামের মধ্যে একটা বোতাম শুধু আছে। বাকি তিনটা মিসিং। মা হাসপাতালে, শার্টের বোতাম লাগানোর কেউ নেই। বোতাম আছে এমন শার্ট তার আছে কিন্তু ইমরুল এই শার্ট ছাড়া অন্য কোনো শার্ট পারবে না। এমনিতে সে জেদি ছেলে না। সবার কথা শোনে। কিন্তু এই শার্টটির জন্যে তার দুর্বলতা আছে। ঘরে কোনো সেফটিপিন পাওয়া গোল না। বোতামহীন ফুটোগুলি আটকানো গেল না।
শার্টের চেয়েও ভয়াবহ ব্যাপার হলো তার একটা পায়ে শুধু জুতা। বাম পায়ে। ডান পায়ের জুতা নাকি একটা কুকুর কামড় দিয়ে নিয়ে গেছে। এক পায়ে জুতা পরেই সে বের হবে। খালি পায়ে যাবে না।
উদ্ভট পোশাকের ইমরুলকে নিয়ে আমি যথাসময়ে সোনারগাও হোটেলে উপস্থিত। হলাম। মিসেস আসমা হকের ঘরে। আদবের সঙ্গে কিলিংবেল টিপলাম। আদবের সঙ্গে কলিংবেল টেপা হলো ফুস করে একটা টিপ দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা। মিসেস আসমা হক দরজা খুললেন। চোখ সরু করে কিছুক্ষণ ইমরুলকে দেখলেন। রোবটদের মতো গলায় বললেন–Please Come in.
আমি বললাম, কেমন আছেন। আপা?
উনি জবাব দিলেন না। ভুরু কুঁচকে ফেললেন। আমার মুখে আপা ডাকটা মনে হলো তার পছন্দ হলো না। তিনি এখন তাকিয়ে আছেন ইমরুলের দিকে। ইমরুলকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়েছি। সে গটগট করে হেঁটে বিছানার কাছে রাখা চেয়ারে উঠে বসল। হাতলে দুহাত রেখে গভীর ভঙ্গিতে পা দোলাতে শুরু করল। সোনারগাও হোটেলের সুইটে ঢুকলে যে-কোনো সাধারণ মানুষের আক্কেলগুড়ুম হয়ে যায়। শিশুরা সাধারণ মানুষ না। অসাধারণ মানুষ। সহজে তাদের আক্কেলগুড়ুম হয় না।
মিসেস আসমা হক বললেন, আমি কি জানতে পারি। এই ছেলে কে?
আমি বললাম, এর নাম ইমরুল।
আমি এরকমই ভেবেছিলাম। ওকে নিয়ে এসেছেন কেন? আমি বলেছিলাম না। এই ছেলের ব্যাপারে আমরা ইন্টারেস্টেড না! ওকে কেন দেখাতে এসেছেন?
ওকে দেখাতে আনি নি। আমার সঙ্গে বেড়াতে বের হয়েছে। তারপর আপা বলুন, এতদিন পর দেশে এসে আপনার কেমন লাগছে?
আমাকে অ্যাপা ডাকবেন না।
জি আচ্ছা।
আমি কী করব বুঝতে পারছি না। দাঁড়িয়ে থাকব না-কি ইমরুলের মতো কোনো একটা চেয়ারে বসে পড়ব? ঘরে দ্বিতীয় যে চেয়ারটা আছে সেখানে মিসেস আসমা হক বসেছেন। বসতে হলে আমাকে বসতে হবে বিছানায়। সেটা মিসেস আসমা হক
পছন্দ করবেন না।
ছেলেটার নাম যেন কী?
ইমরুল।
ও হ্যাঁ, ইমরুল। আমার সমস্যা হচ্ছে মানুষের নাম মনে থাকে না।
ভিমরুলের কথা মনে রাখবেন। হুল ফোটায় যে ভিমরুল সেই ভিমরুল। ভিমরুল মনে থাকলে ইমরুল মনে পড়বে। এসোসিয়েশন অব ওয়ার্ডস।
এর পায়ে একটা জুতা কেন?
ডান পায়ের জুতাটা কুকুর নিয়ে গেছে। মানুষের ব্যবহারী জিনিসের মধ্যে জুতা নিয়ে যায় কুকুর এবং সাবান নিয়ে যায় কাক।