কিছু কিছু মানুষকে রাগিয়ে দিতে ভালো লাগে। খালু সাহেব সেই কিছু কিছুদের একজন। তাঁকে রাগিয়ে দেবার জন্যেই আমি তাঁর দিকে দুপা এগিয়ে গেলাম। আমার লক্ষ্য তাঁর পাশে খাটে গিয়ে বসা। তিনি সে সুযোগ দিলেন না। মাছি তাড়াবার মতো ভঙ্গি করে আমাকে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করলেন। আমি যেহেতু মাছি না, সরে গেলাম না। বরং খুঁটি গেড়ে বসার মতো করে তাঁর পাশে বসলাম। তিনি ভেতরে ভেতরে কিড়ামিড় করে উঠলেন। আমি মধুর গলায় বললাম, খালু সাহেব, আমি শুনেছি আপনার সাউন্ড বক্স অফ হয়ে গেছে। খুবই দুঃসংবাদ। আপনি সর্বশেষ যে কথা খালার সঙ্গে বলেছিলেন সেটা নিয়ে গবেষণার মতো করছি। আপনি বলেছিলেন, আচ্ছা ডিম.। সেনটেন্স শেষ করেন নি। বাকিটা কী?
খালু সাহেব ঘোৎ করে উঠলেন। সেই ঘোৎ ভয়াবহ। সাউন্ড বক্স অফ হয়ে গেলেও ঘোৎ-ঘাৎ শব্দ ঠিকই হচ্ছে। আমি বললাম, শেষ বাক্যটা কী–আচ্ছা! ডিম পোচ কেন দিলে? অমলেট চেয়েছিলাম। না-কি অন্য কিছু?
খালু সাহেব এখন আমার দিকে অপলিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর চোখে আগুন খেলা করছে। আমি বললাম, আপনি মোটেই দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি আপনাকে আমার পরিচিত একজন আধ্যাত্মিক মহিলার কাছে নিয়ে যাব। তিনি সব ঠিক করে। দেবেন। ইনশাল্লাহ। আপনি আবার ফুল ভলিউমে কথা বলতে পারবেন।
তিনি আবার হাত ইশারা করে আমাকে উঠে যেতে বললেন। আমি ইশারা না বোঝার ভান করে কথা চালিয়ে যেতে লাগলাম।
মহিলার নাম তারাবিবি, তবে সবাই তাকে মামা ডাকে। আপনাকে যা করতে হবে। তা হলো মামা মামা বলে পায়ে পড়ে যেতে হবে। মুখ দিয়ে শব্দ বের হবে না। তারপরও তারাবিবি বুঝে নেবেন। অত্যন্ত ক্ষমতাধর মহিলা।
খালু সাহেব ঘো ঘোঁ জাতীয় শব্দ করলেন। আমি এই বিকট শব্দে সামান্য বিচলিত হলাম। সাউন্ড বক্স যে এতটা খারাপ হয়েছে তা বোঝা যায় নি। আমি বললাম, একটা দিন-তারিখ ঠিক করে আমাকে জানান, আমি আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে রাখব। আপনার সমস্যা কী তা আগে থেকে জানিয়ে রাখলে সময় কম লাগবে।
খালু সাহেব তাড়াক করে খাট থেকে নেমে অতি দ্রুত জানালার দিকে এগিয়ে গেলেন। যেভাবে এগুলেন তাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে তিনি জানালা দিয়ে লাফিয়ে দোতলা থেকে নেমে পড়তে চাইছেন। বাস্তবে দেখা গেল, জানালার পাশে লেখার বোর্ড বুলানো। বোর্ডের উপর ডাস্টার আছে। লাল-নীল মার্কার আছে। তিনি বড় বড় করে লিখলেন–
GET OUT
আমি বললাম, খালু সাহেব। আপনি রাগ করছেন কেন? আপনি অসুস্থ মানুষহঠাৎ রেগে গেলে আরো খারাপ হতে পারে।
খালু সাহেব। আবার লিখলেন–
I am saying for the last time
Get Out
আমি বললাম, ঠিক আছে এখন চলে যাচ্ছি। কিন্তু যে-কোনো একদিন এসে আপনাকে তারা মামার কাছে নিয়ে যাব। উনি খুবই পাওয়ারফুল স্পিরিচুয়েল লেডি— সাউন্ড বক্স ঠিক করা উনার কাছে কোনো ব্যাপারই না।
খালু সাহেব এবার লাল কালি দিয়ে বড় বড় করে লিখলেন–
SHUT UP
আমি ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। আর থাকা ঠিক হবে না। খালু সাহেব যে-কোনো মুহুর্তে ডাস্টার ছুড়ে মারতে পারেন। ডাস্টারটা তিনি একবার ডান হাত থেকে বাম হাতে নিচ্ছেন, আবার বাঁ হাত থেকে ডান হাতে নিচ্ছেন। লক্ষণ সুবিধার না।
নাশতার টেবিলে খালা নাশতা দিয়েছেন। গোশত, পরোটা, ভাজি, সিজনাল ফুটস হিসেবে সাগর কলা। যা যা চেয়েছিলাম। সবই আছে। বাড়তি আছে সুজির হালুয়া। খালাকে খুশি করার জন্যে আমি প্রায় হামলে পড়লাম। অনেক দিনের ক্ষুধার্তা বাঘ যে ভঙ্গিতে হরিণশিশুর উপর ঝাঁপ দিয়ে পড়ে সেই ভঙ্গিতে ঝাঁপিয়ে পড়া।
খালা স্নেহমাখা গলায় বললেন, আস্তে আস্তে খা। এমন তাড়াহুড়া করছিস কেন? খাওয়া তো পালিয়ে যাচ্ছে না। খেতে ভালো হয়েছে?
আমি বললাম, এই পরোটাকে ভালো বললে ভালোর অপমান হয়। বাংলা ভাষায় এই পরোটার গুণ বৰ্ণনার মতো বিশেষণ নেই। ইংরেজি ভাষায় আছে।
ইংরেজি ভাষায় কী আছে?
The grand.
তুই এমন পাম দেয়া কথা কীভাবে বলিস? জানি সবই মিথ্যা, তার পরেও শুনতে
ভালো লাগে।
খালা বসেছেন আমার সামনের টেবিলে। তাঁর চোখেমুখে আনন্দ ঝরে পড়ছে। কাউকে খাওয়াতে পারলে তার মতো সুখী হতে আমি কাউকে দেখি নি। ভিক্ষুক শ্রেণীর কাউকে যদি তিনি খেতে দেন তখনো সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। তাঁর চোখ দিয়ে স্নেহ গলে গলে পড়ে।
খালা, তুমি খালু সাহেবের চিকিৎসার কী করেছ?
এখনো কিছু করা হয় নি। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালের এক ডাক্তারের সঙ্গে তোর খালু ই-মেইলে যোগাযোগ করেছেন। সামনের মাসে যাব। মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালের ঢাকা অফিস আছে। ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি।
সিঙ্গাপুরে যেতে চাও যাও। তার আগে মামাকে দিয়ে একটা চিকিৎসা করালে হয় না?
কোন মামা?
তারা-মামা। আধ্যাত্মিক চিকিৎসা। খরচ নামমাত্র। এক ছটাক গাজা লাগবে। এক নম্বরি গাঁজার পুরিয়া। দুই নম্বরি হলে চলবে না। তিনি লাথি দিয়ে ফেলে দেবেন, তখন হিতে বিপরীত হবে। এখন তো কথা বলতে পারছেন না, তখন দেখা যাবে কানেও শুনছেন না।
ঐ মহিলা গাঁজা খায়?
আমি কখনো খেতে দেখি নি। তবে গাঁজা ছাড়া তিনি চিকিৎসা করেন না। গাঁজার পুরিয়া পায়ের কাছে রেখে তারপর কদমবুসি করতে হয়। গাঁজা ছাড়া কদমবুসি করতে গেলে গোদা পায়ের লাথি খেতে হবে।
কদমবুসি করতে হবে?
অবশ্যই।
তোর খালু কোনোদিনও ঐ মহিলার কাছে যাবে না।